এই বিশ্বকাপে মোহাম্মদ আশরাফুল পুরোদস্তুর মিডিয়াকর্মী। অফিসিয়াল ব্রডকাস্টারদের হয়ে কাজ করছেন, বিশ্লেষণ করছেন। প্রেসবক্স থেকে শুরু করে চারপাশে তার বিচরণ। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ম্যাচের আগে তিনি যেন অনেকটাই হয়েই উঠলেন প্রতীকী। তাকে দেখে যেমন মনে পড়ে অস্ট্রেলিয়াকে হারাতে পারে বাংলাদেশ, তার উপস্থিতিই তেমনি জানান দেয়, এরপর আর কখনও অস্ট্রেলিয়াকে হারাতে পারেনি বাংলাদেশ!
২০০৫ সালে ইংল্যান্ডে ন্যাটওয়েস্ট ট্রফিতে কার্ডিফে তার মহাকাব্যিক সেঞ্চুরিতে অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়েছিল বাংলাদেশ। সেই প্রথম, এখনও পর্যন্ত সেটিই একমাত্র। পরাক্রমশালী দলটিকে গত সাড়ে ১৮ বছরে আর ওয়ানডেতে হারানো যায়নি। সেই বদ্ধ দুয়ার খোলার আরেকটি সুযোগ বিশ্বকাপের মঞ্চে। পুনেতে যে ম্যাচ দিয়ে শেষ হবে বাংলাদেশের বিশ্বকাপ অভিযান।
মহারাষ্ট্র ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন স্টেডিয়ামে বাংলাদেশ সময় সকাল ১১টায় শুরু ম্যাচ। বিশ্বকাপে বাংলাদেশের প্রথম ম্যাচটিও ছিল দিনের ম্যাচ। সেদিন আফগানিস্তানকে হারিয়ে বিশ্বকাপ শুরু করেছিল সাকিব আল হাসানের দল। সেই সাকিব ছিটকে গেছেন বিশ্বকাপ থেকে। বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জ জয় দিয়ে বিশ্বকাপ শেষ করার।
‘চ্যালেঞ্জ’ বললেও আসলে বোঝানো যায় না, কাজটা কতটা কঠিন। কার্ডিফের পর এখনও পর্যন্ত ১৫টি ওয়ানডে খেলেছে এই দুই দল। বাংলাদেশ আর একবারও হাসিমুখে মাঠ ছাড়তে পারেনি।
যদিও এই ১৫ ম্যাচের বেশির ভাগই হয়েছে সেই সময়টায়, যখন বাংলাদেশ মাঠেই নামত মূলত সম্মানজনক পরাজয়ের জন্য। ওয়ানডেতে সমীহ জাগানিয়া শক্তি হয়ে ওঠার পর লড়াই হয়েছে স্রেফ তিনটি। ২০১৫ বিশ্বকাপের ম্যাচটিতে টসই হতে পারেনি বৃষ্টির কারণে। ২০১৭ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ম্যাচ বৃষ্টিতে পরিত্যক্ত হয় অস্ট্রেলিয়া জয়ের পথে থাকা অবস্থায়। ২০১৯ বিশ্বকাপে বাংলাদেশ হারে ৪৮ রানে।
অতীতে যেমন প্রেরণার উৎস নেই, তেমনি বর্তমান বাস্তবতাও বাংলাদেশের জন্য বিরুদ্ধ। সেমি-ফাইনাল নিশ্চিত করে নিয়ম রক্ষার এই ম্যাচ খেলতে নামছে অস্ট্রেলিয়া। টানা দুই হার দিয়ে বিশ্বকাপ শুরুর পর নিজেদের ‘অস্ট্রেলিয়ান সত্ত্বা’ ফিরে পেয়ে তারা ছুটে চলেছে অপ্রতিরোধ্য পথচলায়। টানা ৬ জয়ের পথে সবশেষ ম্যাচে গ্লেন ম্যাক্সওয়েলের রূপকথাময় ইনিংসে আফগানিস্তানের বিপক্ষে অবিশ্বাস্য এক জয়ের পর তাদের আত্মবিশ্বাস এখন উত্তুঙ্গ।
অস্ট্রেলিয়ার স্পিন বোলিং কোচ ড্যানিয়েল ভেটোরি ম্যাচের আগের দিন সংবাদ সম্মেলনে বললেন, তাদের কাছে এই ম্যাচটি শুধু আনুষ্ঠানিকতা রক্ষারই নয়, বরং ম্যাচ জিতে পয়েন্ট টেবিলে দুই নম্বরে থেকে প্রাথমিক পর্ব শেষ করতে চান তারা।
সেখানে বাংলাদেশের লক্ষ্য, তলানির দুইয়ে যেন থাকতে না হয়!
গত ম্যাচে দিল্লিতে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে দারুণ এক জয় ধরা দিয়েছে বটে, সেই জয়ের আত্মবিশ্বাসও হয়তো দলের সঙ্গী হবে। কিন্তু শুধু কিছুটা আত্মবিশ্বাসের হাওয়ায় তো অস্ট্রেলিয়াকে দুলুনি দেওয়া সম্ভব নয়! টক্কর দিতে হবে স্কিলের লড়াইয়েও। সেখানে বাংলাদেশ এমনিতেই অনেক পেছনে। আরও খর্বশক্তির হয়ে গেছে তারা সাকিবকে হারিয়ে। তিনি তো শুধু অধিনায়কই নন, দলের সমন্বয় ভারসাম্যপূর্ণ করে দেওয়া একজন অলরাউন্ডারও।
কোনোভাবে অস্ট্রেলিয়াকে হারাতে পারলে তো কথাই নেই, এমনকি খুব বাজেভাবে না হারলেও চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির লড়াইয়ে প্রবলভাবে টিকে থাকবে বাংলাদেশ।
ম্যাচের আগের দিন সংবাদ সম্মেলনে কোচ চান্দিকা হুথুরুসিংহে অবশ্য দাবি করলেন, চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সমীকরণে তাদের চোখ নেই, বরং নজর তাদের জয়ে। আগের দিন নিউ জিল্যান্ডের কাছে শ্রীলঙ্কা বাজেভাবে হারায় বাংলাদেশের সম্ভাবনা একটু উজ্জ্বল হয়েছে বটে। তবে বাংলাদেশ কোচ ঠিকঠাক করতে চান নিজেদের কাজটুকু।
“এই ম্যাচটি আমাদের খেলতে হবে, কালকের ম্যাচ। এটাই আমাদের ভাবনায় আছে। অস্ট্রেলিয়াকে হারাতে হলে খুব ভালো খেলতে হবে আমাদের। আমাদের মনোযোগ সেদিকেই। অবশ্যই (শ্রীলঙ্কার) সেই ম্যাচের প্রভাব কিছুটা থাকবে, তবে সেটাও নির্ভর করবে আমাদের ফলাফলের ওপর। এই মুহূর্তে (চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির) ওসব দৃশ্যপট আমরা চিন্তা করতে পারি না।”
তবে বিশ্বকাপের মঞ্চে অস্ট্রেলিয়াকে হারানো যে ক্রিকেটের সবচেয়ে কঠিন কাজগুলির একটি, তা অকপটেই মেনে নিলেন হাথুরুসিংহে।
“অস্ট্রেলিয়া অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। বিশ্বকাপ ইতিহাসে সবচেয়ে সফল দল তারা। খুবই ভালো দল তারা, সর্বোচ্চ পেশাদারিত্বে প্রস্তুতি নেয় তারা। খুবই পেশাদার দল, এই মুহূর্তে দারুণ খেলছে। শুরুটা কিছুটা ধীরে করেছিল তারা, কিন্তু এর মধ্যেই সেমি-ফাইনালে উঠে গেছে। তাদের বিপক্ষে খেলা অনেক বড় চ্যালেঞ্জ।”
সেই চ্যালেঞ্জ জয়ের একাদশ ঠিক করাও বড় ঝামেলার। সাকিবের জায়গায় একজন বোলার নেওয়া হবে বলে নিশ্চিত করেছেন কোচ। তবে সেই বোলার কে বা তিনি পেসার নাকি স্পিনার, তা বলেননি। তবে দিনের ম্যাচ যেহেতু, শিশিরের শঙ্কা নেই, পরের দিকে কিছুটা হলেও স্পিন ধরতে পারে উইকেটে, কাজেই সাকিবের বদলি একজন স্পিনার হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। বাঁহাতি স্পিনার হওয়ায় নাসুম আহমেদের সুযোগ থাকবে। তবে ব্যাটিংয়ের শক্তি কিছুটা ধরে রাখতে চাইলে শেখ মেহেদি হাসানকে খেলানোর সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
আপাতদৃষ্টিতে এই ম্যাচের ফলাফলের কোনো গুরুত্ব অস্ট্রেলিয়ার কাছে নেই। পয়েন্ট টেবিলে দুই ও তিন নম্বর দল হিসেবে সেমি-ফাইনালে তাদের প্রতিপক্ষ দক্ষিণ আফ্রিকা নিশ্চিত হয়ে গেছে। তবে দলটা তো অস্ট্রেলিয়া! নিজেদের তাড়িত করার উপায় তারা ঠিকই বের করে ফেলেছে। তাদের স্পিন বোলিং কোচ ড্যানিয়েল ভেটোরি বললেন, “ইডেন গার্ডেনসের অ্যাওয়ে ড্রেসিং রুমের চেয়ে হোম ড্রেসিং রুমটা ভালো। আমরা তাই চাই পয়েন্ট তালিকায় দুই নম্বরে থেকে ভালো ড্রেসিং রুমে থাকতে…।”
এই রসিকতা থেকে যদি মনে করেন যে তারা ম্যাচটাকে মজা হিসেবেই নিচ্ছেন, তাহলে তাদেরকে অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটের শিক্ষা দিতে পারে ভেটোরির পরের কথাটি।
“আমার মনে হয়, প্রতিটি ব্যাপারই ভাবনায় রাখতে হবে… বৃষ্টির কোনো ভূমিকা থাকে কি না, জানি না। দুই নম্বরে থেকে শেষ করা তবু গুরুত্বপূর্ণ। হয়তো এটির বাড়তি সুবিধা খুব সামান্য। তবে এই লক্ষ্যে দল মনোযোগী থাকতে পারবে যে ম্যাচটি জিততে পারলে আমরা দুইয়ে থাকব।”
“নিজেদের একটা মানদণ্ড তো আমরা বেঁধে দিয়েছি। কঠিন শুরুর পরও আমরা যে টানা ৬টি ম্যাচ জিতেছি, এ মোমেন্টাম সেমি-ফাইনালে নিয়ে যেতে চাই। এই ছোট ছোট ব্যাপারগুলো… এছাড়া ব্যক্তিগত পারফরম্যান্স তো আছেই। আমাদের কয়েকজন অসাধারণ একটি আসর কাটাচ্ছে, কয়েকজন সেভাবে সুযোগ পায়নি। তারা চাইবে এই অবস্থায় নিজেদের মেলে ধরতে।”
বাংলাদেশকে নিয়ে যথেষ্ট ‘হোমওয়ার্কও’ সেরে নিয়েছে অস্ট্রেলিয়া। ভেটোরি তো বলেই দিলেন, দুই মেহেদির দুজনই, মানে মেহেদী হাসান মিরাজ ও শেখ মেহেদি হাসান একাদশে থাকবেন বলে ধারণা তার।
অস্ট্রেলিয়ার একাদশেও আসতে পারে পরিবর্তন। আগের ম্যাচে পায়ে ক্র্যাম্প নিয়ে অতিমানবীয় ইনিংস খেলা গ্লেন ম্যাক্সওয়েল এখনও ‘রিকভারির’ পর্যায়ে আছেন। তাকে এই ম্যাচে বিশ্রাম দেওয়া হতে পারে। পেসারদের একজন-দুজনকে বিশ্রাম দিয়ে শন অ্যাবট, স্পিনে অ্যাশটন অ্যাগারকে বাজিয়ে দেখা হতে পারে। ক্রিকেটীয় স্কিলে তারাও কম যান না!
এই লড়াইয়ে কিছু ভূমিকা থাকতে পারে প্রকৃতিরও। ম্যাচের আগের সন্ধ্যায় উথাল-পাথাল বৃষ্টিতে মাঠের চারপাশ যেন ভাসিয়ে নিল প্রায়। মাঠের পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা অবশ্য দারুণ। তবে আবহাওয়ার পূর্বাভাস বলছে, ম্যাচের দিন আকাশ দিনজুড়েই মেঘলা থাকতে পারে। কিছুটা শঙ্কা আছে বৃষ্টির।
শেষ পর্যন্ত বৃষ্টির জয় যদি হয়, বাংলাদেশ দল তা উপভোগ করবে বলেই মনে হয়!