অনুশীলন সেশনের শুরুতেই হালকা রানিং করে মাঠের এক প্রান্ত থেকে অপরপ্রান্তে চলে গেলেন নিউ জিল্যান্ডের ক্রিকেটাররা। এরপর গোল হয়ে বসে পড়লেন সবাই। মিচেল স্যান্টনার ও গ্লেন ফিলিপস একটু পেছনে পড়ে গিয়েছিলেন। দুজনই ছুটে এসে যোগ দিলেন সেই বৈঠকে। কথা বললেন কেবল একজন, অন্য সবাই মনোযোগী শ্রোতা। বক্তার নাম কেন উইলিয়ামসন।
এই দলের নেতা তিনি। অনুপ্রেরণাদায়ী অধিনায়ক। দলের কাছে সেই সম্মান ও ভালোবাসা পান তিনি পুরোপুরিই। মিনিট দশেকের মতো কথা বললেন উইলিয়ামসন। সবার তালি আর পরস্পর পিঠ চাপড়ে দেওয়া দিয়ে শেষ হলো সেই পর্ব। বিশ্বকাপের সেমি-ফাইনালে ওঠা দল এমনিতেই চনমনে থাকার কথা। অধিনায়কের কথাগুলি শোনার পর যেন আরও উজ্জীবিত হয়ে উঠলেন সবাই। গা গরমের ফুটভলি খেলা, নেটে ব্যাটিং-বোলিং সেশন, সবকিছুতেই ফুটে উঠছিল এই দল কতটা সংঘবদ্ধ, পরস্পরের সঙ্গে কতটা একাত্ম এবং কতটা আত্মবিশ্বাসী।
এসব অবশ্য নতুন নয়। বৈশ্বিক আসর এলেই তো নিউ জিল্যান্ড হাজির হয়ে যায় এই চেহারায়!
ওয়ানডে বিশ্বকাপে এখনও পর্যন্ত শিরোপার স্বাদ পায়নি তারা একবারও। কিন্তু গত পাঁচ বিশ্বকাপে ফিরে তাকালে, সবচেয়ে ধারাবাহিক দল তারাই। এবার নিয়ে টানা পাঁচ বিশ্বকাপে তারা খেলছে সেমি-ফাইনালে!
২০০৭ ও ২০১১ বিশ্বকাপের সেমি-ফাইনালে তারা হেরে যায় শ্রীলঙ্কার কাছে। ২০১৫ আসরে এগিয়ে যায় আরেকধাপ। প্রথমবারের মতো পা রাখে বিশ্বকাপের ফাইনালে। সেখানে অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে লড়াই জমাতে পারেনি। পরের বিশ্বকাপে তারা সেই ঘাটতিও পূরণ করে দেয়। নাহ, ফাইনাল জিততে পারেনি। তবে ক্রিকেটীয় কোনো নিয়মে তাদের হারানোও যায়নি। মূল ম্যাচ ‘টাই’ হওয়ার পর সুপার ওভারও ‘টাই’ হলে তারা শেষ পর্যন্ত ট্রফি ছুঁতে পারেনি বাউন্ডারি কম মারায়।
শেষ ধাপটা পেরিয়ে যাওয়ার সেই লক্ষ্যে এবারও তারা পৌঁছে গেছে সেমি-ফাইনালে।
শুধু কী ওয়ানডে বিশ্বকাপ! গত তিনটি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেই তাদের পা পড়েছে সেমিতে। একবার উঠেছে ফাইনালের মঞ্চেও। আদি সংস্করণ টেস্ট ক্রিকেটের প্রথম বৈশ্বিক আসর আইসিসি টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপেও তারা চ্যাম্পিয়ন হয়ে গেছে এসবের মধ্যেই।
অথচ গত এক বছরে দ্বিপাক্ষিক সিরিজে তারা খুব ভালো করেনি ওয়ানডেতে। গত সেপ্টেম্বরে ইংল্যান্ডে গিয়ে হেরেছে ৩-১ ব্যবধানে, এর আগের সিরিজে পাকিস্তানে হেরেছে ৪-১ ব্যবধানে। গত জানুয়ারিতে ভারতের কাছে ও গত বছরের সেপ্টেম্বরে অস্ট্রেলিয়ার কাছে হয়েছে হোয়াইটওয়াশড। সেই দল বিশ্বকাপে এসে ঠিকই খুঁজে নিয়েছে আপন পথ।
তারা এতটা ধারাবাহিক যে, সেমি-ফাইনালে ওঠাকেও এখন আর উল্লেখযোগ্য কিছু মনে হয় না অনেক সময়। কিন্তু তাদের দেশের যে বাস্তবতা, একটু গভীরে গেলে তো এই সাফল্যকে বলা যায় মহাবিস্ময়!
চোখধাঁধানো সবুজের সমারোহ, স্বচ্ছ নীল জলের লেক, সৌন্দর্যময় সব পাহাড়-পবর্ত, নদী-সমুদ্র মিলিয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি এই দেশ। আয়তনে বেশ বড় হলেও সাম্প্রতিকতম পরিসংখ্যান অনুযায়ী জনসংখ্যা স্রেফ সাড়ে ৫২ লাখ। ঢাকা শহরেই জনসংখ্যা নিঃসন্দেহে এর তিনগুণ!
সেই জনসংখ্যার কজনই বা খেলোধুলায় আসেন। তাদের মধ্যে ক্রিকেটেই বা কজন আসেন!
সেখানে সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা রাগবি। এছাড়া ফুটবল, হকির মতো খেলাগুলি তো আছেই। ক্রিকেটও সেখানে প্রধান খেলাগুলোর মধ্যেই থাকে। তবে নিবন্ধনকৃত ক্রিকেটারের সংখ্যায় তারা বিশ্বের শীর্ষ আর যে কোনো ক্রিকেট খেলুড়ে দেশের চেয়ে পিছিয়ে। বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ক্রিকেট বোর্ডগুলোর মধ্যে নেই তাদের বোর্ড। উপমহাদশের দেশগুলোর মতো জনপ্রিয়তা নেই সেখানে, স্পন্সরদের লাইন পড়ে যায় না তাদের ক্রিকেট বোর্ড বা ক্রিকেটারদের পেছনে। সেই দেশই কিনা বিশ্ব আসরে এমন দাপট দেখিয়ে চলেছে!
এই যে অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটের ঘরানা নিয়ে এত আলোচনা হয়, ২০১৫ বিশ্বকাপের পর থেকে ইংল্যান্ডের হাত ধরে বদলে যাওয়া ওয়ানডে ক্রিকেটকে অনুসরণ করা নিয়ে কথা হয়, নিউ জিল্যান্ডের ক্রিকেটের ধরন নিয়ে আলোচনা সেই তুলনায় হয়ই না। অথচ গবেষণা হওয়া উচিত কিউই ক্রিকেট নিয়েই।
মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে সোমবার অনুশীলনের আগে সংবাদ সম্মেলনে লকি ফার্গুসনের কাছে জানত চাওয়া হলো তাদের এমন সাফল্যের রহস্য। এই ফাস্ট বোলার মুচকি হাসিতে বললেন, “আমি তো জানি না… জানতে পারলে আমার নিজেরও ভালো লাগবে…!”
এটুকু বললেন মজা করেই। হাসির রেশ নিয়েই পরে যোগ করলেন, তাদের নিজস্ব প্রক্রিয়া আছে।
“আমাদের দিক থেকে যদি বলি, টুর্নামেন্টের শুরুতে তো অন্য সব দলের মতোই আমরা জয়ের জন্য নামি। তবে অবশ্যই আমরা জানি যে এটার একটা প্রক্রিয়া আছে। আমাদের দলে আমরা সবাই একসঙ্গে অনেক খেলেছি লম্বা সময় ধরে এবং আমরা নিজেদের প্রক্রিয়ায় অটল থাকি।”
“জানি এটা খুব ক্লিশে শোনাচ্ছে, তবে এটাই আমাদের স্থির থাকতে সহায়তা করে। জাতি হিসেবে এমনিতেই আমরা সবসময় নিজেদের পা মাটিতে রাখতে পছন্দ করি, এটাও ইতিবাচক হিসেবে কাজ করে। আর হ্যাঁ, আমরা বড় টুর্নামেন্টগুলোর জন্য মুখিয়ে থাকি।”
রহস্যের সবকিছু তো তিনি আর খোলাসা করবেন না। তবে ফার্গুসনের কথা থেকে ধারণা পাওয়া যায় কিছুটা। যে প্রক্রিয়ার কথা তিনি বললেন, সেটায় পেশাদারিত্ব মিশে থাকে প্রবল। দল গঠন থেকে শুরু করে নেতৃত্ব, কাছের ও দূরের লক্ষ্য নির্ধারণ এবং সেদিকে ছুটে চলার পথ খুঁজে নেওয়া, বিভিন্ন পরিস্থিতি ও প্রতিকূলতার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া, সবকিছুতেই তারা অনেক গোছানো ও পরিকল্পিত।
কেন উইলিয়ামসনের চোট পরিস্থিতির কথাই ধরুন। যেভাবে তাকে মাঠে ফেরানো হয়েছে, যত আগে থেকে পরিকল্পনা করে তাকে বিশ্বকাপ দলে রাখা হয়েছে এবং বিশ্বকাপের মধ্যেও চোট পাওয়ার পর যেভাবে সামলানো হয়েছে, যে কোনো দলের জন্যই তা উদাহরণ।
পেশাদারিত্ব তো কম-বেশি সব দলেরই আছে। তবে নিউ জিল্যান্ডের ধরনটা তাদের জন্য খুবই কার্যকর। ঘরোয়া ক্রিকেটের সিস্টেম ও তাদের ক্রিকেট বোর্ডের পরিচলন প্রক্রিয়া, সেসবের কথা তো আলাদা করে বলতে হবেই। এজন্যই এত কম সংখ্যক ক্রিকেটারের মধ্য থেকেও এত মানসম্পন্ন ক্রিকেটার উঠে আসে। বিকল্প ক্রিকেটারের ঘাটতি খুব একটা হয় না।
উইলিয়ামসনের মতো ব্যাটসম্যান ও অধিনায়ক এবার বেশির ভাগ ম্যাচেই খেলতে পারেননি চোটের কারণে। দলের সফলতম পেসার টিম সাউদি খেলতে পেরেছেন মোটে তিন ম্যাচ। মাইকেল ব্রেসওয়েলের মতো কার্যকর অলরাউন্ডার আসতেই পারেননি চোটের কারণে। এই টুর্নামেন্টের মাঝপথেও চোটে পড়েছেন আরও কয়েকজন। তারপরও দলটি ঠিকই পৌঁছে গেছে সেমি-ফাইনালে।
এখানে অবশ্য কঠিন চ্যালেঞ্জ তাদের অপেক্ষায়। খেলতে হবে স্বাগতিক ভারতের বিপক্ষে। গত বিশ্বকাপে সেমি-ফাইনালে ভারতকে বিদায় করে দিয়েছিল তারা। তবে এবার খেলা ভারতের মাঠে। শুধু ১১ জনের বিপক্ষে নয়, কিউইদের লড়াই করতে হবে গ্যালারি ঠাসা দর্শক, বিরুদ্ধ আবহ ও আরও অনেক কিছুর সঙ্গে।
তারা পারবেন কি না, উত্তর জানা যাবে পরশুই। তবে যেটুকু তারা পেরেছেন, সেখানেও মিশে আছে অনেক উত্তর, অনেক প্রাপ্তি।
নিউ জিল্যান্ড যা করেছে বা করে চলেছে, বেশির ভাগ দলের জন্যই তো তা স্বপ্নের মতো!