৮ মাস পর লাল বলের ক্রিকেটে খেলতে নেমেই সেঞ্চুরি করলেন তিনি, রেকর্ড গড়া ইনিংসের পরও তার কণ্ঠে আক্ষেপ আরও ভালো করতে না পারায়।
Published : 29 Nov 2023, 07:27 PM
চা বিরতির সময় ৬৬ রান হয়ে গেছে কেন উইলিয়ামসনের। ক্লান্তিও বেশ থাকার কথা। বিরতিতে শরীরটাকে একটু বিশ্রাম দেবেন, একটু তাজা হয়ে উঠবেন। কিন্তু তার ভাবনায় তখন নাঈম হাসান। বাংলাদেশের এই অফ স্পিনার কিছুটা ভোগাচ্ছিলেন উইলিয়ামসনকে। চা বিরতির সময় তাই তিনি কোচের সঙ্গে আলোচনা করে উপায় খুঁজছিলেন নাঈমকে পাল্টা আক্রমণ করার।
দিন শেষে সেই গল্প শোনালেন নিউ জিল্যান্ডের ভারপ্রাপ্ত কোচ লুক রনকি। অন্যদের সঙ্গে গ্রেট ক্রিকেটারদের পার্থক্য কোথায়, সেটিও ফুটে উঠল এখানে। এই যে খেলা চলার সময়ও নিজেকে আরেকটু সমৃদ্ধ করার তেষ্টা, প্রতিপক্ষের চেয়ে এগিয়ে থাকার তাড়না, এসব মিলিয়েই তারা আলাদা।
উইলিয়ামসন সেটি ব্যাটিংয়েও দেখিয়ে চলেছেন প্রতিনিয়ত। সিলেট টেস্টের আগে নিউ জিল্যান্ড সবশেষ টেস্ট খেলেছে সেই মার্চ মাসে। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ওয়েলিংটনে সেই টেস্টে ২১৫ রানের ইনিংস খেলেছিলেন উইলিয়ামসন। পরের সময়টায় লাল বলের ক্রিকেটে কোনো ম্যাচ খেলেননি তিনি। ভয়ঙ্কর এক চোট নিয়েই তো মাঠের বাইরে ছিলেন লম্বা সময়। কিন্তু আবার সাদা পোশাকে খেলতে নেমে ঠিকই করে ফেললেন সেঞ্চুরি। কে বলবে, ৮ মাস পর লাল বলের ক্রিকেট খেলছেন তিনি!
লম্বা বিরতিতে যে তার ব্যাটে মরচে পড়ে না একটুও, সেটি তিনি সম্প্রতি বিশ্বকাপেও দেখিয়েছেন। গত ৩১ মার্চ আইপিএলের প্রথম ম্যাচেই ফিল্ডিংয়ের সময় গুরুতর চোট পেয়ে মাঠের বাইরে ছিটকে পড়েন। অস্ত্রোপচার করাতে হয়। বিশ্বকাপের শুরুতেও পারেননি মাঠে নামতে। পরে বাংলাদেশের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে ফিরলেন। সাড়ে ছয় মাস পর ম্যাচ খেলতে নেমেই উপহার দিলেন ৭৮ রানের ম্যাচ জেতানো ইনিংস।
ওই ম্যাচেই হাতে চোট পেয়ে আবার ছিটকে পড়তে হলো মাঠের বাইরে। এবার তিন সপ্তাহের বিরতি। এরপর ফিরেই পাকিস্তানের বিপক্ষে দুর্দান্ত ব্যাটিংয়ে খেললেন ৭৯ বলে ৯৫ রানের ইনিংস।
কোনো জাদুমন্ত্র করে নিশ্চয়ই এমন পারফরম্যান্স তিনি করেন না! তার স্কিল, সামর্থ্য, টেম্পারমেন্ট, এসব তো আছেই। সঙ্গে কার্যকর কোনো প্রক্রিয়াও আছে। প্রস্তুতিতে তিনি সেই প্রক্রিয়াই অনুসরণ করেন। নিজেকে এমনভাবে তৈরি করেন যে, থিতু হয়েই যেন উইকেটে যান!
সিলেট টেস্টের দ্বিতীয় দিনে যেমন। ক্রিজে গিয়ে এতটাই নির্ভরতা ও আস্থায় খেলতে শুরু করলেন, যেন ড্রেসিং রুম থেকেই থিতু হয়ে এসেছেন। হাতের ব্যাট যেন তার বশ। তিনি যেভাবে বলেন, ব্যাট সেভাবেই চলে। কিছু বোঝার আগেই দেখা গেল, তিনি ২০ রান পেরিয়ে গেছেন! এরপর তো স্রেফ এগিয়ে যাওয়ার পালা।
৬০ পেরিয়ে অবশ্য একটু মনোযোগ হারালেন। নাঈমের এক ওভারেই বেশ ভুগলেন। জোরাল আবেদন থেকে রক্ষা পেলেন। অল্পের জন্য শর্ট লেগে ক্যাচ হলেন না। পরে তো সহজ ক্যাচই দিয়ে বসলেন সুইপ শট খেলে। কিন্তু তাইজুল পারলেন না তা মুঠোয় জমাতে। চা বিরতির পর সুযোগ দিলেন আরও একবার। বাংলাদেশ ব্যর্থ হলো সেটিও নিতে।
এমনিতে তার যে নিবেদন, থিতু হয়ে গেলে যেভাবে ধ্যানমগ্ন ঋষির মতো উইকেটে পড়ে থাকেন, ফিফটি পেরিয়ে তার এরকম দুই দফায় মনোযোগ হারানো বিরল ব্যাপারই বটে। তবে এভাবে বেঁচে যাওয়ার পর তো কাজে লাগাবেনই। সেঞ্চুরিতে পৌঁছে যান তাই অনায়াসেই।
তার ২৯তম টেস্ট সেঞ্চুরি। শতকের সংখ্যায় এখন তিনি সর্বকালের সেরা স্যার ডন ব্র্যাডম্যান ও এই সময়ের সেরাদের একজন ভিরাট কোহলির পাশে।
ব্র্যাডম্যানের ২৯ সেঞ্চুরি এসেছে ৮০ ইনিংসের ক্যারিয়ারে। তার সঙ্গে কারও তুলনাই চলে না। তবে উইলিয়ামসন এক দিক থেকে ছাড়িয়ে গেছেন কোহলিকেও। ১৮৭ ইনিংস খেলে এখন ২৯ সেঞ্চুরি ভারতীয় গ্রেটের। ২২ ইনিংস কম খেলেই তাকে ছুঁলেন উইলিয়ামসন।
নিউ জিল্যান্ডের ইতিহাসে তার কোনো ব্যাটসম্যানের ২০টি টেস্ট সেঞ্চুরিও নেই।
নিউ জিল্যান্ডের হয়ে আরেকটি প্রথম কীর্তিও তিনি উপহার দিয়েছেন এই সেঞ্চুরিতে। প্রথম কিউই ব্যাটসম্যান হিসেবে করলেন টানা চার টেস্টে সেঞ্চুরি।
সেঞ্চুরির পর অবশ্য আর লম্বা করতে পারেননি ইনিংস। দ্বিতীয় নতুন বলে তাইজুল ইসলামের দুর্দান্ত এক ডেলিভারিতে ভেঙে যায় তার রক্ষণ।
মজার ব্যাপার হলো, ১০৪ রান করেও বাংলাদেশের বিপক্ষে তার ব্যাটিং গড় একটু কমে গেল!
বাংলাদেশকে পেলে তিনি এতটাই জ্বলে ওঠেন যে এই ম্যাচের আগে গড় ছিল ১১৩.৮৩। এই ইনিংসের পর একটু কমে হয়েছে ১১২.৪২।
বাংলাদেশের বিপক্ষে ৯ ইনিংস খেলে তার সেঞ্চুরি ৪টি, ফিফটি ৪টি।
তবে শুধু বাংলাদেশের বিপক্ষে অতিমানবীয় পারফরম্যান্স দেখিয়েই তো তিনি গ্রেট হয়ে ওঠেননি। স্রেফ জিম্বাবুয়ে ছাড়া একাধিক টেস্ট সেঞ্চুরি করেছেন তিনি সব দলের বিপক্ষেই। দক্ষিণ আফ্রিকা ছাড়া সেঞ্চুরি আছে সব দেশেই।
দিনের খেলা শেষে উইলিয়ামসনের গ্রেটনেসের সেই দিকটিই তুলে ধরলেন কোচ রনকি।
“২৯টি সেঞ্চুরি করে ফেলল সে। বিশ্বের সব জায়গাতেই সে দুর্দান্ত। বিভিন্ন বোলিং আক্রমণের বিপক্ষে সে যেভাবে খেলে, একেকটি দল কতভাবে তাকে আউট করার চেষ্টা করে, উইকেট কত ভিন্ন থাকে… সবকিছুর মধ্যেও সে যেভাবে পারফর্ম করে আসছে এবং যতটা স্থির সে থাকে, এটা স্রেফ অসাধারণ।”
ক্রিকেটার বা ব্যাটসম্যান হিসেবে তিনি কোন উচ্চতায়, তা তো পরিসংখ্যানেই ফুটে ওঠে। তবে ক্রিকেট বিশ্বজুড়ে তিনি দারুণ সম্মান পান তার অসাধারণ ব্যক্তিত্বের কারণেও।
সেই ব্যক্তিত্বেরই একটা অংশ, নিজেকে কখনোই বড় কিছু হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টাও তিনি করেন না। নিজের অর্জন, রেকর্ড বা কীর্তি নিয়ে কথা বলতে খুব একটা স্বচ্ছন্দ বোধ করেন না। নিজের প্রসঙ্গেও বরাবরই টেনে আনেন দলকে। নিউ জিল্যান্ডের প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে টানা চার টেস্টে সেঞ্চুরির রেকর্ড নিয়েও তেমনিই বললেন দলের কথাই।
“অবশ্যই এটি সম্মানের (রেকর্ড গড়তে পারা), তবে পাশাপাশি মূল মনোযোগটা সবসময় দলকে ঘিরেই। দলকে সেরা অবস্থানে নেওয়ার চেষ্টা করা, যতটা সম্ভব জুটির অংশ হতে পারা… এসবই সবসময় লক্ষ্য থাকে। আজকে তা কিছুটা করতে পারা অবশ্যই সন্তুষ্টির। তবে দিনের শেষ পর্যন্ত টিকে থাকতে পারলে ভালো হতো।”
এই যে অতৃপ্তি, সেঞ্চুরির পরও দলের জন্য সর্বোচ্চটুকু করতে না পারার আক্ষেপ, এসব কারণেই তিনি উইলিয়ামসন। এসব মিলিয়েই তারা কিংবদন্তি।