৪৬ বল ৩৬ রান ৬ উইকেট: একটি ব্যাটিং ধসের ইতিবৃত্ত

পাকিস্তানের বিপক্ষে প্রথম ১০ ওভারে ভালো ভিত গড়তে পারলেও পরে গুঁড়িয়ে যায় বাংলাদেশের ব্যাটিং।

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিঅ্যাডিলেইড থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 Nov 2022, 03:43 PM
Updated : 6 Nov 2022, 03:43 PM

একটি রিভার্স সুইপ। আম্পায়ারের একটি বাজে সিদ্ধান্ত। একের পর এক আত্মহত্যা। সব মিলিয়ে একটি ব্যাটিং ধস। নতুন যদিও নয়। তবু হতাশাও শেষ হওয়ার নয়। পুরনো সেই ভূতের নতুন থাবায় বাংলাদেশের সেমি-ফাইনাল স্বপ্নের অপমৃত্যু। দিনশেষে প্রাপ্তি সেই পুরনো আক্ষেপ, আর ২০-২৫ রান যদি বেশি থাকত!

সাকিব আল হাসানের বিস্ময়কর আউটের সিদ্ধান্ত এ দিন আলোচনার ঝড় তুলেছে অনুমিতভাবেই। শুধু প্রশ্নবিদ্ধ নয়, এটি নিশ্চিতভাবেই টিভি আম্পায়ারের বড় ভুল। কিন্তু অন্যদের ব্যর্থতা তো আর তাতে আড়াল হয় না! দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে নেদারল্যান্ডসের স্মরণীয় জয়ে চমকপ্রদভাবে যে সুযোগ এসেছিল সামনে, সাকিবের দল তা হাতছাড়া করেছে চরমভাবে। বিশ্বকাপ সেমি-ফাইনালে খেলার সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া হয়েছে ব্যাটিং দীনতায়।

আইসিসির কোনো প্রতিযোগিতায় সেমি-ফাইনালে খেলতে পারা মানে বড় অর্জন অবশ্যই। সেটা যদি হয় অস্ট্রেলিয়ার মতো জায়গায়, সেই অর্জনের বিশেষত্ব, ওজন ও প্রভাব বেড়ে যায় বহুগুণে। অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ড-দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেট মহলে সজোরে কড়া নাড়তে হলে, তাদের মনোযোগে টোকা দিতে হলে এই দেশগুলোতে সফরে গিয়ে দারুণ কিছু করতে হয়। বিশ্বকাপে খুব ভালো কিছু করতে না পারলেও অভাবনীয়ভাবে সেই সুযোগটা এসেছিল বাংলাদেশের সামনে।

কিন্তু আরও একটি ব্যাটিং ব্যর্থতায় সেই সুযোগ মিলিয়ে গেল অ্যাডিলেইডের হাওয়ায়। পড়ে রইল কেবল দীর্ঘশ্বাস।

প্রথম ১০ ওভারে যে ভিত গড়ে উঠেছিল, তা পরে তাসের ঘরের মতোই ভেঙে পড়ল হালকা হাওয়ায়। ১ উইকেটে ৭৩ রানের শক্ত ভিত দুমড়ে মুচড়ে পরিণত হলো ৭ উইকেটে ১০৯ রানের ধ্বংসস্তুপে।

৪৬ বলের মধ্যে স্রেফ ৩৬ রানে ৬ উইকেট হারালে সেই দলের আবার মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো কঠিন। 

টিভি আম্পায়ারের ভুল সিদ্ধান্তে সাকিবের আউট নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের জন্য ছিল বড় ধাক্কা। সাকিবের নিজের জন্য তো বটেই। ব্যাট হাতে এই আসর ভুলে যাওয়ার মতোই কেটেছে তার। মনে রাখার মতো কিছু করার বড় সুযোগ ছিল পাকিস্তানের বিপক্ষে এই ম্যাচে। শেষ পর্যন্ত স্মরণীয় কিছুই হলো বটে। তবে দারুণ ব্যাটিংয়ের কারণে নয়, টিভি আম্পায়ারের বিরল ভুলে।

তার বিদায়ে ব্যাটিংয়ের মোমেন্টাম ও ছন্দে বড় চোট লাগে নিশ্চিতভাবেই। বড় জুটি ভাঙার পরপরই সাকিবের মতো অভিজ্ঞ একজন ব্যাটসম্যানকে হারানোও কখনও আদর্শ কিছু নয়। তবে একটি আউটে ভেঙে পড়ার কারণও তো নেই। কোনো দলের ব্যাটিং লাইন আপ নিশ্চয়ই এক খুঁটির ঘর হতে পারে না!

তৃতীয় ওভারে লিটন দাসের বিদায়ের পর নাজমুল হোসেন শান্ত ও সৌম্য সরকার যে জুটি গড়েন, তা আদর্শ না হলেও কার্যকর হতে পারত যথেষ্টই। উইকেট বেশ শুষ্ক, সেখানে টার্নও মিলেছে কিছু। ১৫০ রানের আশেপাশে কোনো স্কোর একদম নিরাপদ না হলেও হতে পারত বেশ ভালো স্কোর। বাংলাদেশ ছিল সেই ঠিকানার পথেই। শান্ত ও সৌম্যর জুটিতে ৫২ রান আসতে যদিও লেগে যায় ৪৭ বল, তবু ১০ ওভারে দলের রান দাঁড়ায় ১ উইকেটে ৭০।

৯ উইকেট হাতে নিয়ে পরের ১০ ওভারে ন্যূনতম প্রত্যাশা করার কথা আরও অন্তত ৮০ রান। তাহলেই ১৫০ হয়ে যায়। সঙ্গে আরও ১০ রান কোনোভাবে যোগ করতে পারলেই ১৬০ রান, মানে এই উইকেটে ও এমন চাপের ম্যাচে প্রায় জয়ের মতোই স্কোর। বাংলাদেশের একাদশে এ দিন ছিল একজন বাড়তি স্পিনার। সবকিছুই ছিল বাংলাদেশের পক্ষে। কিন্তু প্রথম ১০ ওভারের সেই সাজানো বাগান এলেমেলো হয়ে গেল পরের সময়টায়।

সৌম্যর রিভার্স সুইপ দিয়ে শুরু। একটি করে চার ও ছক্কা মারলেও প্রান্ত বদলাতে এ দিন ধুঁকছিলেন তিনি। সেই জাল ছেঁড়ার জন্যই হয়তো বেছে নেন রিভার্স সুইপের পথ। উইকেটও বিলিয়ে দেন সেই চেষ্টায়।

দুর্ভাবনার কালো মেঘ তখনও পর্যন্ত দেখা যায়নি। ২০ ওভারের ইনিংসে ১১ ওভার চলছে, বিপর্যয়ের কোনো আভাস মেলেনি। কিন্তু সৌম্যর বিদায়ের পরের বলেই সাকিবের সেই আলোচিত আউট। মাঠে কিছুটা উত্তেজনা। ডাগ আউটে বিস্ময়ের রেশ। গ্যালারিতে হইচই। এরপর আতঙ্কের স্রোতে ব্যাটিং লাইন আপের ভেসে যাওয়া!

শাহিন শাহ আফ্রিদির ফুল লেংথ বলের লাইন মিস করে বোল্ড মোসাদ্দেক হোসেন। একই ওভারে ছক্কায় ওড়ানোর চেষ্টায় আউট নুরুল হাসান সোহান। আফ্রিদির পরের ওভারে বিদায় তাসকিন আহমেদেরও।

ব্যাটিংয়ের সেই পুরনো কঙ্কাল প্রকাশ আবার। ম্যাচ সচেতনতার ঘাটতির চেনা চিত্র দৃশ্যমান আরেক দফায়।

আফিফ হোসেন এক প্রান্তে থাকলেও আরেক প্রান্তে উইকেট পতনের মিছিলের স্বাক্ষী হন তিনি। ম্যাচ বাংলাদেশের হাত থেকে বেরিয়ে যায় মূলত এই সময়েই।

২০ বলে ২৪ রানে অপরাজিত থাকা আফিফ ম্যাচ শেষে বললেন, একজন সঙ্গীর অভাবে দলকে তিনি কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে নিতে পারেননি।

“উইকেটে যখন ছিলাম... ব্যাক টু ব্যাক উইকেট পড়ছিল। তখন টার্গেট ছিল একটা সেট ব্যাটসম্যান যদি থাকে, শান্ত ভাই থাকলে ভালো হতো... কিন্তু উইকেট পড়ে গেছে। তারপর আমাদের টার্গেট ছিল যেই কয়টা ওভার আছে, ওগুলো কাজে লাগিয়ে রানটা যেন ১৫০-এর আশপাশে যেতে পারি। তাহলে ভালো হতো।”

৪৮ বলে ৫৪ রানের ইনিংস খেলে আউট হন শান্ত। টি-টোয়েন্টিতে কোনো ধরনের উইকেটে কোনো প্রেক্ষাপটেই আদর্শ ইনিংস এটি নয়। শুরুতে যে সময়টুকু নিয়েছেন, তা তিনি পুষিয়ে দিতে পারতেন ফিফটির পর দ্রুত রান তুলতে। কিন্তু তখনই তিনি আউট হয়ে যান। নিজের সেই আউট নিয়ে হতাশা লুকালেন না তিনি।

“আমার মনে হয়, উইকেট আজকে ১৪০-১৫০ রানের ছিল। আমি বুঝছিলাম, শেষ করাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। এটা আমি করতে পারিনি, এজন্য আফসোস লেগেছে। শেষের ব্যাটাররা আরেকটু ভালো করলে হয়তো প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ম্যাচ হতো।”

সব মিলিয়ে সেই পুরনো আক্ষেপের গল্প, ‘এমন করলে তেমন হতো’, কিংবা ‘এমন হতো পারত।’ অ্যাডিলেইড ওভালের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয় টরেন্স নদীর মতোই যে বাস্তবতার স্রোত বাংলাদেশের ক্রিকেটে চিরবহমান!