সরাসরি থ্রোয়ে নিজের স্মরণীয় রান আউটগুলোর মধ্যে সাকিব এগিয়ে রাখছেন জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে শেষ সময়ে করা তার রান আউটটি।
Published : 01 Nov 2022, 03:08 PM
ওই ম্যাচের পর ৪৮ ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ দুয়ারে। কিন্তু ঘোর লাগানো ওই মুহূর্তটির রেশ যেন শেষ হওয়ার নয়। সাকিব আল হাসানের ৪ সেকেন্ডের জাদুতে এখনও আচ্ছন্ন অনেকে। গ্যাবায় বাংলাদেশ অধিনায়কের যে থ্রো জিম্বাবুয়েকে জয়ের সম্ভাবনা থেকে ছিটকে দেয় বেশ কিছুটা দূরে।
বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ, ম্যাচের প্রেক্ষাপট কিংবা উপলক্ষ, সবকিছু এক পাশে সরিয়ে যদি স্রেফ ফিল্ডিংয়ের মানটুকু ভাবা হয়, তাহলেও তা অসাধারণ। বিশ্বসেরা ফিল্ডারদেরও গর্ববোধ করার কথা এমন কিছু করতে পারলে। সঙ্গে পরিস্থিতির চাপ, বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশের আরেকটি জয় ও অন্যান্য আরও পারিপার্শ্বিতা মিলিয়ে রান আউটটি হয়ে থাকবে স্মরণীয়। এজন্যই সেই আউটের চর্চা চলছে এখনও।
যদিও সাকিবের জন্য খুব নতুন কিছু এটি নয়। ২০০৯ সালে মিরপুর শের-ই-বাংলা স্টেডিয়ামে ত্রিদেশীয় সিরিজের ফাইনালে শ্রীলঙ্কার রান তাড়ায় প্রথম বলেই সনাৎ জয়াসুরয়াকে এভাবে অসাধারণ সরাসরি থ্রোয়ে রান আউট করেন তিনি। ২০১৮ এশিয়া কাপে আফগানিস্তানের বিপক্ষেও আবু ধাবিতে একই ঝলক দেখিয়ে বিদায় করেন তিনি রহমত শাহকে।
তিনটির মধ্যে কোনো একটিকে এগিয়ে রাখা কঠিন। জয়াসুরিয়া ও রহমতের ক্ষেত্রে আগে ডাইভ দিয়ে বলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে তবেই থ্রো করতে হয়েছে সাকিবকে। উইলিয়ামসের রান আউটে ডাইভ দিতে হয়নি। পুরো প্রক্রিয়া তাই আরেকটু সংক্ষিপ্ত ও তুলনামূলক কিছুটা সহজ ছিল। তবে সাকিব নিজে এগিয়ে রাখলেন উইলিয়ামসকে করা আউট।
শুধু এই দুই-তিনটি নয়, গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু রান আউট তার হাত দিয়ে হয়েছে দীর্ঘ ক্যারিয়ারে। স্টাম্পে বল সরাসরি লাগনোর ক্ষেত্রেও তার জুড়ি মেলা ভার বাংলাদেশ দলে। সাবেক অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা তো বরাবরই দাবি করেন, নিখুঁত নিশানা আর সরাসরি স্টাম্পে হিট করার ক্ষেত্রে সাকিবের ধারেকাছে কেউ নেই বাংলাদেশে।
গ্যাবায় গত রোববার ওই রান আউটের আগে জিম্বাবুয়ের প্রয়োজন ছিল ৯ বলে ১৯ রান। উইলিয়ামস তখন বাংলাদেশ ও জয়ের মধ্যে মূল বাধা হয়ে আছেন এবং দুর্দান্ত ব্যাটিংয়ে খেলছেন ৪১ বলে ৬৩ রানে। তাকে থামানোর পথই পাচ্ছিলেন না কোনো বোলার।
উইলিয়ামস তখন একটু সুযোগ দেন ফিল্ডিংয়ে এবং চ্যাম্পিয়ন ক্রিকেটারের মতোই তা লুফে নেন সাকিব।
বাঁহাতি এই স্পিনারের ওই ডেলিভারিতে একটু জায়গা বানিয়ে অফ সাইডে খেলতে গিয়ে ঠিকঠাক টাইমিং করতে পারেননি উইলিয়ামস। বল যায় শর্ট কাভারের দিকে। ফলো থ্রু দ্রুত সামলে সাকিব ছুটে যান বলের কাছে। বল কুড়িয়ে নিতেও সময় নেননি।
থ্রো করার সুযোগ ছিল তার দুই প্রান্তেই। কিন্তু চোখের পলকে তিনি নিজের লক্ষ্য খুঁজে নেন। বল কুড়িয়ে প্রায় পুরো উল্টো ঘুরে থ্রো করেন নন স্ট্রাইক প্রান্তে। থ্রো করার সময় তার শরীরের ভারসাম্য ছিল না, তাৎক্ষণিক পড়ে যান মাঠে। কিন্তু বল ঠিকই আঘাত করে লক্ষ্যে।
সাকিবের বোলিংয়ের ডেলিভারি থেকে এই পুরো প্রক্রিয়ায় সময় লাগে স্রেফ ৪ সেকেন্ড।
ভারতের বিপক্ষে ম্যাচের আগের অ্যাডিলেইডে বাংলাদেশ দলের কোনো অনুশীলন ছিল না। তবে সংবাদ সম্মেলন করতে অ্যাডিলেইড ওভালে এসেছিলেন বাংলাদেশ অধিনায়ক। পরে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে আলাপচারিতায় রান আউটের প্রসঙ্গ উঠতেই তার মুখে ফুটে উঠল চওড়া হাসি। বোঝা গেল, নিজেও উপভোগ করেছেন।
২০০৯ সালে জয়াসুরিয়াকে আউট করার সময় তিনি কাভারে একটু দৌড়ে ফুল লেংথ ডাইভ দিয়ে বল ধরে দ্রুত রিকভার করে হাঁটু গেড়ে বসেই সরাসরি থ্রোয়ে বল লাগান স্টাম্পে। হতভম্ব জয়াসুরিয়া ফেরেন ড্রেসিং রুমে।
২০১৮ এশিয়া কাপে রহমত শাহর আউটে সাকিব ছিলেন পয়েন্টে। নাজমুল ইসলাম অপুর বলে মোহাম্মদ শাহজাদের কাট শট তিনি থামান ডান দিকে ডাইভ দিয়ে। বল তখনও পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে নিতে পারেননি। এবারও দ্রুত রিকভার করে সরাসরি থ্রোয়ে ভেঙে দেন স্টাম্পস।
তবে ওই দুটি আউটের চেয়ে এবারেরটি তার কাছে এগিয়ে।
“এটিই এগিয়ে রাখব। বেশ কিছু কারণ আছে। এবার নিজের বোলিংয়ে এটা হয়েছে, একটু কঠিন। তাছাড়াও ম্যাচের অবস্থা, বিশ্বকাপ…।”
যদিও সবকিছু খুব দ্রুত হয়ে গেছে, তবু সবটুকু তাকে করতে হয়েছে একদম ঠিকঠাক। শেষ ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ যেটি, তখন তিনি ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন কী হচ্ছে, “থ্রো করার সময়ই মনে হচ্ছিল, লেগে যাবে…।”
ঠিক ওই মুহূর্তে টিভি পর্দায় দেখে মাশরাফিরও মনে হচ্ছিল, কাজ হয়ে যাবে। জয়াসুরিয়ার রান আউটের সময় বোলার ছিলেন মাশরাফি, রহমত শাহকে রান আউটের ম্যাচে মাশরাফি ছিলেন অধিনায়ক। সাকিবকে সরাসরি স্টাম্পে বল লাগাতে এতবার দেখেছেন তিনি, আরও একবার হবে বলেই বিশ্বাস ছিল তার।
“আমার কাছে মনে হচ্ছিল, স্টাম্পে লেগে যাবে। এমন চাপের মধ্যে নার্ভ ধরের রাখার একমাত্র লোকটি হলো সাকিব। প্র্যাকটিস থেকে শুরু করে অনেক ম্যাচে, এই কাজ করতে অনেকবার দেখেছি ওকে। ওর অ্যাকুরেসি নিয়ে কোনো সংশয়ই নাই। বাংলাদেশের সেরা সে এখানেও।”
মাশরাফির মতে, সাকিবের আত্মবিশ্বাস এখানে বড় ভূমিকা পালন করে কার্যকারিতার ক্ষেত্রে।
“এতো ভালো সে কীভাবে পারে, এর ব্যাখ্যা করা তো কঠিন। ন্যাচারাল কিছু ব্যাপার তো আছেই। তবে নিজের প্রতি বিশ্বাস একটা বড় ব্যাপার। চাপের মধ্যে অনেকে খেই হারায়। কিন্তু সাকিব বিশ্বাস করে যে সে পারবে। অনেকে আছে, তিন স্টাম্প সামনে থাকলেও চাপের মধ্যে ভুল করে। সাকিব মাথা ঠাণ্ডা রাখতে পারে।”
“কিছু কিছু ফিল্ডার থাকে, যাদের এটা ভালো। জন্টি রোডস হয়তো সর্বকালের সেরা ফিল্ডার। কিন্তু স্টাম্পে হিট করার অ্যাকুরেসি বেশি ভালো ছিল রিকি পন্টিংয়ের। এমনকি মাইকেল ক্লার্কেরও। এরকম কেউ কেউ থাকে, যাদের এই সামর্থ্য বেশি।”
২০২০ সালে বাংলাদেশের সেরা ফিল্ডার নিয়ে ধারাবাহিক এক আয়োজনে দেশের ইতিহাসের সেরা ফিল্ডার হিসেবে মাশরাফি বেছে নিয়েছিলেন সাকিবকে। এখন এই সময়েও তিনি সাকিবকে মনে করেন সেরাদের একজন।
“হয়তো বয়স হয়েছে, রিফ্লেক্স কমে গেছে। কিন্তু ফিল্ডিং মানে তো শুধু ক্ষীপ্রতা বা দ্রুত দৌড়ানো নয়। ওটা একটা অংশ, তেমনি চাপের মধ্যে নিজের কাজটা করতে পারা আরেকটা অংশ। সাকিবের অ্যাকুরেসি সবসময় ভালো, এখনও সবচেয়ে ভালো। ৯০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেল থেকেও অনেক সময় পারে।”
“ক্যাচ কয়টা মিস করেছে জীবনে? এই ম্যাচেও তো ভালো ক্যাচ নিল (মিল্টন শুম্বার)। ক্যাচের ক্ষেত্রেও খুব নির্ভরযোগ্য সাকিব।”