প্রতারিত হয়ে ক্রিকেট ছাড়তে চাওয়া হৃদয় এখন রেকর্ড গড়ার নায়ক

ভুয়া একাডেমির খপ্পরে পড়ে ভাঙা মন নিয়ে তিনি ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন ক্রিকেট খেলা, পরে নানা বাঁক পেরিয়ে এখন ম্যাচ সেরা হলেন তিনি ওয়ানডে ক্রিকেটে অভিষেকেই।

ক্রীড়া প্রতিবেদকসিলেট থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 March 2023, 06:49 PM
Updated : 18 March 2023, 06:49 PM

“আমার আসল নাম হচ্ছে তাওহিদ হৃদয়। তবে সবাই আমাকে তৌহিদ বলে… তাওহিদ ডাকলে আমার ভালো লাগে। তাওহিদের সুন্দর একটা অর্থ আছে তো…”, সংবাদ সম্মেলনের শুরুতে মিষ্টি হাসিতে বললেন হৃদয়। দেশের ক্রিকেটে তার বিচরণ বেশ কয়েক বছর ধরেই। কিন্তু নাম নিয়ে বিভ্রান্তি রয়ে গেছে। ওয়ানডে অভিষেকে যে ইঙ্গিত তিনি দিলেন, তার নাম এখন নিয়মিতই উচ্চারিত হবে এবং লিখতে হবে। সঠিক নামটি জানা জরুরি বটে!

নামের মতো গল্প আছে তার ক্রিকেট জীবনেরও। প্রতারিত হয়ে, বিরক্ত হয়ে, হতাশায় খেলা ছেড়েই দিতে চেয়েছিলেন একটা সময়। সেই হৃদয় এখন দেশের ক্রিকেটের আলোচিত একজন। ওয়ানডে অভিষেকে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড তার। দেশের প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে জিতেছেন এই সংস্করণে অভিষেকে ম্যাচ সেরার পুরস্কার।

বগুড়ার সন্তান হৃদয়ের ইচ্ছে ছিল বিকেএসপিতে ভর্তি হওয়ার। সেই শখ পূরণ হয়নি। পরে তিনি ভর্তি হন ঢাকার বনশ্রীর একটি ক্রিকেট একাডেমিতে। বাবাকে না জানিয়ে জমি বন্ধক রেখে টাকা জোগাড় করে দিয়েছিলেন তার মা। কিন্তু সেই একাডেমি ছিল আসলে ভুয়া। বড় চোট লাগে হৃদয়ের হৃদয়ে। কষ্টের টাকা গচ্চা দিয়ে ভাঙা মন নিয়ে তিনি ফিরে যান। 

বছর তিনেক পর তাকে রাজশাহীর বাংলা ট্র্যাক একাডেমিতে নিয়ে যান বিসিবি পরিচালক ও ওই একাডেমির কোচ খালেদ মাহমুদ। হৃদয়ের ক্রিকেটার হয়ে ওঠার অভিযান শুরু হয় আবার। অভিষেক ম্যাচে ম্যাচ সেরা হয়ে সংবাদ সম্মেলনে হৃদয় ফিরে গেলেন সেই সময়টায়।

“যখন একাডেমিতে গিয়েছিলাম, অনেক কিছু আসলে ক্ষতি করেই গিয়েছিলাম ওখানে। তারপর একটা সময় ক্রিকেট খেলার কোনো ইচ্ছে ছিল না। পরিবার থেকে ওভাবে কখনও সাপোর্ট ছিল না, বাবার সাপোর্ট ছিল না, যদিও বাবা-মা খেলা বোঝেন না। যখন জেদ ধরতাম মায়ের সঙ্গে, তখন মা যতটুকু পেরেছেন আর কী চেষ্টা করেছেন।”

“একটা সময় আমার খেলার ইচ্ছে ছিল না। সেই সময় সুজন স্যার সেই ছোট বেলাতেই, যখন আমি অনূর্ধ্ব-১৬ খেলি, সুজন স্যার ওখান থেকে নিয়ে এসেছেন এবং উনি আসলে সুযোগ করে দিয়েছেন। ওখান থেকে প্রথম বিভাগ খেলে আস্তে আস্তে উঠে আসা।”

আজ সেই বাবা-মা ছেলের সাফল্যে স্বাভাবিকভাবেই উদ্বেলিত। কদিন আগে টি-টোয়েন্টি দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেকেই ছাপ রেখেছেন নিজের। এবার ওয়ানডে অভিষেকে তো দলের জয়ের নায়কদের একজন। তার অর্জনে পরিবারের সবাই গর্বিত।

“প্রতিটা বাবা-মায়ের প্রতিক্রিয়াই ভালো হওয়ার কথা। আমার বাবা-মাও খুশি হয়েছেন। আমার মা বিশেষ করে একটু বেশি খুশি হয়েছেন। উনি তো ছোটবেলা থেকেই আমাকে অন্যভাবে দেখেছেন। পরিবার থেকে পড়াশোনার জন্য সবসময় চাপ দিত, কিন্তু আমি পড়াশোনার দিকে বেশি ফোকাসড ছিলাম না। যতটুকু পেরেছি, বেশির ভাগ সময় মাঠেই থাকতাম। আলহামদুলিল্লাহ, বাবা-মা খুশি হয়েছেন, আশেপাশের আত্মীয়-স্বজনরাও খুশি।”

ক্রিকেটার হয়ে ওঠার ইচ্ছেটা তার মনে গেঁথে যায় আরও অনেক আগে। ২০০৭ বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষে স্মরণীয় জয়ের পর যখন বগুড়ায় যান মুশফিকুর রহিম, তখন তাকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ পান হৃদয়। সেদিনের ঘটনা আজও দোলা দেয় তার মনে।

“আমি অনেক ছোট ছিলাম, ২০০৭ এর একটা কাহিনী। মুশফিক ভাই বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষে জিতে একটা স্টাম্প পেয়েছিলেন। তখন আমি অনেক ছোট একদম, একদিন স্টেডিয়ামে গিয়েছিলাম। একটা প্রোগ্রামে মুশফিক ভাইয়ের কাছে যখন স্টাম্প দেখেছিলাম, তখন থেকেই অনেক অনুপ্রাণিত হই। ওখান থেকেই ইচ্ছে ছিল, যদি আমি একদিন খেলতে পারি জাতীয় দলে।”

জীবনের নানা বাঁক পেরিয়ে, প্রতিবন্ধকতা আর প্রতিকূলতার নানা পথ পেরিয়ে সেই মুশফিকের কাছ থেকেই পেলেন তিনি ওয়ানডে ক্যাপ। মুশফিকের সঙ্গে ৪৯ বলে ৮০ রানের দুর্দান্ত এক জুটিও গড়লেন পরে। তবে সেই জুটির আগে সাকিব আল হাসানের সঙ্গে গড়েন ১২৫ বলে ১৩৫ রানের জুটি। ৮১ রানে ৩ উইকেট হারানোর ধাক্কা সামলে এই জুটিই বাংলাদেশকে এগিয়ে নেয় বড় স্কোরের দিকে।

সাকিবের সঙ্গে জুটিতে তিনি যেমন শিখেছেন অনেক, তেমনি উপভোগও করেছেন দারুণ। তার ব্যাটিং দেখে একটিবারের জন্যও মনে হয়নি তিনি নবীন কেউ। চাপের মধ্যে দারুণ ইতিবাচক ব্যাটিং করে গেছেন, আগ্রাসী মানসিকতার ছাপ রেখেছেন। সেই গল্পও শোনালেন তিনি।

“আমি প্রথম থেকে চেয়েছিলাম ইন্টেন্ট যাতে ঠিক থাকে। কখনও ভাবিনি যে সেট হয়ে নেই একটু বা ওরকম কিছু। চেষ্টা করেছি প্রতিটি বলের মান অনুযায়ী খেলার। সাকিব ভাইয়ের সঙ্গে খেলা ভালো একটা ব্যাপার, কারণ উনি অনেক অভিজ্ঞ। সাকিব ভাইয়ের সঙ্গে ব্যাটিংয়ের সময়ই অনেক কিছু শিখছিলাম। উনিও বলছিলেন, এভাবে-ওভাবে করলে ভালো হবে। উপভোগ করেছি অনেক।”

“যখন মনে হয়েছে কিছু জানার দরকার, তখন জিজ্ঞাসা করেছি যে ভাই কী করলে ভালো হয়। সাকিব ভাই বলেছেন, ‘এটা ওভাবে করতে পারি।’ এছাড়াও সবসময় বলছিলেন যে, ‘ভালো হয়েছে, ধরে রাখ। যতটা লম্বা করা যায় ইনিংস।”

লম্বা তিনি করতে পেরেছেন বটে। অভিষেকে ছাড়িয়ে গেছেন দেশের ইতিহাসের সবাইকে। সেঞ্চুরির সীমানায় অবশ্য পা রাখতে পারেননি। তা নিয়ে আক্ষেপ নেই বলেও জানিয়েছেন। ওয়ানডে অভিষেক আর আসবে না বটে, তবে সেঞ্চুরির সুযোগ তো আসবে!