মিরাজের বিশ্বাসের ভেলায় ভেসে অসাধারণ এই জয়

৯ উইকেট হারানোর পরও জয়ের বিশ্বাস ছিল, বলছেন ভারতকে হারানোর নায়ক মেহেদী হাসান মিরাজ।

ক্রীড়া প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 Dec 2022, 05:19 PM
Updated : 4 Dec 2022, 05:19 PM

হঠাৎ ধসে ৮ রানের মধ্যে উধাও ৫ উইকেট। বাংলাদেশের রান ৯ উইকেটে ১৩৬। জয় তখনও ৫১ রানের দূরত্বে। বাংলাদেশ সেখান থেকে জিতবে, কজন বিশ্বাস করতে পেরেছিলেন? জয় মুঠোয় পেয়েও ফেলে দেওয়ার ঘটনা বাংলাদেশের ক্রিকেটে এত বেশি আছে, হৃদয়ভাঙা হারের যন্ত্রণায় এতবার পুড়তে হয়েছে, সেখানে এই ম্যাচ জয়ের আশা না করলে কাউকে দায় দেওয়ার বিন্দুমাত্র কারণ নেই। কিন্তু একজন ঠিকই বিশ্বাস করেছেন। তিনি তা প্রমাণও করেছেন। নিজের বিশ্বাসকে নিয়ে গেছেন বাস্তবের ঠিকানায়। মেহেদী হাসান মিরাজ। 

জয়ের পর যদিও বিশ্বাসের কথা বলা খুব সহজ। কিন্তু ম্যাচ শেষে সংবাদ সম্মেলনে মিরাজ দাবি করলেন, তিনি মন থেকেই বিশ্বাস করেছেন। যখন ধস নেমেছে, তখন বিশ্বাস করেছেন। একের পর এক সঙ্গী হারিয়ে যখন জুটি হিসেবে পেলেন শেষ ব্যাটসম্যানকে, অর্ধশত রানের দূরত্ব আসলে যখন প্রায় অর্ধ শতাব্দি দূরের মতো, তখনও তিনি বিশ্বাস হারাননি। জোর দিয়েই বললেন। 

“সত্যি বলতে, আমার বিশ্বাস ছিল। অনেকে শুনলে হয়তো বলবে ‘পাগল’, হয়তো মনে করবে যে কিছু...। তবে আমি বিশ্বাস করছিলাম। আমার বিশ্বাস খুব ভালো ছিল। আমার কাছে একবারও মনে হয়নি যে ম্যাচটা হারব।  শুধু একটা কথা বারবার বলছিলাম, আমার মনে যেটা চলছিল, আমি পারব। বারবার নিজেকে বলেছি, ‘আমি পারব, আমি পারব।’ 

মিরাজের বিশ্বাস ছিল, এটি অনেকেই অবিশ্বাস করতে পারেন। তবে তার ব্যাটিং যারা দেখেছেন, তারা বিশ্বাস করতেই পারেন। ব্যাটিংয়েই যে প্রতিফলন পড়েছে তার ভেতরের ভাবনার! 

নিজের বিশ্বাসের কথা আরও শক্ত করে তিনি বোঝাতে চাইলেন ভাবনার অঙ্ক কষে। স্বীকৃত শেষ ব্যাটসম্যান আফিফ হোসেনকে যখন তিনি হারালেন, তখনও জয়ের সম্ভাব্য ছবি মিরাজ এঁকে নিয়েছিলেন। 

“হাসানকে (মাহমুদ) বলেছি যে চার-পাঁচটা বল যদি তুমি খেলতে পারো, তাহলে আমার জন্য কাজ সহজ হয়ে যাবে। আমি যেভাবে চিন্তা করছিলাম, হয়তো ইবাদতকে নিয়ে ১৫ রান করব, হাসানকে নিয়ে ২০ রান করব। মুস্তাফিজকে নিয়ে শেষে ১৫-২০ রান যা লাগে, করবো। এভাবেই আমার চিন্তা ছিল।” 

তবে ১৫-২০ নয়, শেষ ব্যাটসম্যান মুস্তাফিজুর রহমানকে যখন সঙ্গী হিসেবে পেলেন তিনি, জয় আরও অনেকটা দূরে। তাৎক্ষনিক প্রয়োজন ছিল রানের ব্যবধান কিছুটা কমানো আর মুস্তাফিজকেও বিশ্বাস জোগানো। কুলদিপ সেনের এক ওভারে দুর্দান্ত দুটি ছক্কায় সেই কাজটি করেন মিরাজ। স্নায়ু তাতে থিতু হয়। জয় নিয়ে সংশয়ের দেয়ালেও ফাটল ধরে। এরপর পরিকল্পনা মতো ক্রিকেট খেলে সেই দেয়াল গুঁড়িয়ে দেওয়ার পালা। মিরাজ ও মুস্তাফিজ সেই কাজটিও সেরে ফেলেন দারুণ দক্ষতায়। 

একটু একটু করে এগিয়ে পোক্ত হতে থাকে বিশ্বাস। শার্দুল ঠাকুরের বলে মিরাজের আকাশে উঠিয়ে দেওয়া বল গ্লাভসে জমাতে ব্যর্থ হন লোকেশ রাহুল। তাতে মনের বল বাড়ে আরও, আজ হয়তো সত্যিই সম্ভব! 

দিপক চাহারের এক ওভারে মিরাজের তিন বাউন্ডারির পর জয়ের সুবাসও বাতাসে ছাড়াতে শুরু করে। সেই আবহে ভেসেই ধরা দেয় জয়। মিরাজের ব্যাট থেকে জয়সূচক রানটি আসবে, এটিও যেন অবধারিতই ছিল। 

ম্যাচ শেষে মিরাজ ফিরে গেলেন জুটির শুরুটায়। শোনালেন নিজের সেই সময়ের পরিকল্পনা। একটা পর্যায়ে যখন জয় নাগালে এলো, তখন তাকে ভরসা জোগালেন মুস্তাফিজও। 

“শেষ উইকেট যখন ছিল, তখন তো ‘ডু অর ডাই।’ মানে হারানোর কিছু নেই। তখন তো ঝুঁকি নিতেই হবে। ঝুঁকিটা এমন নিয়েছি...মুস্তাফিজের কথা খুব ভালো লেগেছে- ওর কথা কানে বাজছিল তখন নিজের মধ্যে নিজের বিশ্বাস তৈরি হয়েছে। আমি নিজের ভাবনায় পরিষ্কার ছিলাম যে আমি কি করব। ঠিক আমি কী করব, সেই জিনিসটা নিয়ে আমার স্বচ্ছতা ছিল।” 

“যখন ৫০ রানের মতো লাগতো তখন আমি ঝুঁকি নিয়েছি। তা লেগে গেছে। ১৪ রান বা ১০ রানের সময় (জয়ের জন্য) একটু বেশি রোমাঞ্চিত ছিলাম, এত কাছে এসে যদি হেরে যাই! এর আগে এমন হয়েছে আমাদের সাথে। মোস্তাফিজ তখন বলেছে, ‘ওপর দিয়ে খেলার দরকার নাই।” 

হারের দুয়ার থেকে অসাধারণ জুটিতে দলকে জয়ের ঠিকানায় নিয়ে যাওয়ার ঘটনা এই বছরই তার আরেকটি আছে। গত ফেব্রুয়ারিতে চট্টগ্রামে আফগানিস্তানের বিপক্ষে ওয়ানডেতে ২১৬ রান তাড়ায় বাংলাদেশ ৬ উইকেট হারায় ৪৫ রানে। আফিফ হোসেনের সঙ্গে ১৭৪ রানের অবিচ্ছিন্ন জুটিতে তখন দলকে স্মরণীয় জয় এনে দেন মিরাজ। ক্যারিয়ার সেরা ইনিংস খেলে সেদিন মিরাজ অপরাজিত ছিলেন ৮১ রানে। 

দুই ইনিংসের তুলনাও এলো। রানের সংখ্যায় হয়তো ৮১ রানের কাছে ৩৮ রান পাত্তা পাবে না। কিন্তু মিরাজের কাছে এবারের ইনিংসের ওজনই বেশি। 

“দুটি ইনিংসই অনেক গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তবে এটা বেশি স্পেশাল। শেষ উইকেটে ৫১ রান লাগত, আমার জন্য এটা বেশি স্পেশাল। এখানে ব্যাটিং করা কঠিন ছিল। ব্যাটসম্যানরা কনফিউজড হয়ে যাচ্ছিল।”

সব মিলিয়ে মিরাজ এই ম্যাচ কখনও ভুলবেন না। মুস্তাফিজ ভুলবেন না। ওয়ানডে নেতৃত্বের অভিষেকে এই ম্যাচটি লিটন কুমার দাস নিশ্চিতভাবেই স্মৃতির ফ্রেমে বাঁধাই করে রাখবেন। ভুলবেন না আরও ১২-১৩ হাজার দর্শক, যারা শেষ পর্যন্ত মাঠে ছিলেন! 

বাংলাদেশ ৭ উইকেট হারানোর পর থেকেই গ্যালারি ছাড়তে শুরু করেন দর্শকদের অনেকে। ৯ উইকেট পড়ার পর গ্যালারির অর্ধেক প্রায় ফাঁকা। কিন্তু যারা রয়ে যান, মিরাজের মতো বিশ্বাসটা নিশ্চয়ই তাদের অনেকেরও ছিল। তারাও পেয়েছেন পুরস্কার। ভালোবাসার প্রতিদান। বাংলাদেশের ক্রিকেটে এটিই বা কতদিন আর পাওয়া যায়!