সুযোগ-সুবিধায় ঘাটতিসহ দেশের ক্রিকেটের সামগ্রিক অনেক বাস্তবতার প্রভাব বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ে পড়ছে বলে মনে করেন সিনিয়র সহকারী কোচ মোহাম্মদ সালাউদ্দিন।
Published : 20 Apr 2025, 09:22 PM
ক্রিকেটারদের মধ্যে রানের প্রতিযোগিতা সবসময়ই উপভোগ্য বিষয়। যে কোনো দলের চাওয়াই থাকে এটি। কিন্তু সিলেট টেস্টের প্রথম দিন বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা যেন নামলেন বাজে আউটের প্রতিযোগিতায়। কে কার চেয়ে বেশি হতাশ করতে পারেন, সেই লড়াই করলেন মুমিনুল হক, মুশফিকুর রহিমরা। যেটির ফল, কুৎসিত প্রদর্শনীতে মাত্র ১৯১ রানে গুটিয়ে যাওয়া।
দিনের খেলা শেষে প্রতিপক্ষ দলের বোলিং কোচ শার্ল ল্যাঙ্গাভেল্ট বলেন, স্বাগতিক ব্যাটিংয়ের এই দশার কারণ হতে পারে মানসিকতায় গড়বড়। তবে নির্দিষ্ট কোনো ব্যাখ্যা দেননি বাংলাদেশের সিনিয়র সহকারী কোচ মোহাম্মদ সালাউদ্দিন। তিনি তুলে ধরেন দেশের ক্রিকেটের সামগ্রিক বাস্তবতা।
ম্যাচের আগে স্পোর্টিং উইকেটে খেলার বার্তা দিয়েছিলেন বাংলাদেশের অধিনায়ক নাজমুল হোসেন, ও প্রধান কোচ ফিল সিমন্স। তাদের চাওয়া মতোই বানানো হয় উইকেট। পরে টস ভাগ্যও পাশে পান শান্ত। নিজের পছন্দমতো আগে ব্যাটিংও নেন তিনি। কিন্তু ব্যাটিংয়ে নামার পর আর কিছুই প্রত্যাশামতো হয়নি বাংলাদেশের।
প্রথম সেশন শেষে আশার আলো হয়ে টিকে ছিলেন শান্ত ও মুমিনুল। লাঞ্চের পর নামে ধস। মাত্র ৭০ রানে ৫ উইকেট হারিয়ে তারা পড়ে যায় অল্পেই গুটিয়ে যাওয়ার শঙ্কায়। পরে জাকের আলির লড়াইয়ের পরও দুইশও হয়নি দলের স্কোর।
জিম্বাবুয়ের বোলারদের কৃতিত্ব কিছু তো আছেই। তবে দায় বেশি ব্যাটসম্যানদের একের পর এক কাণ্ডজ্ঞানহীন শটেরও। দারুণ খেলতে খেলতে লাফিয়ে ওঠা এক ডেলিভারিতে কাট শটের মতো খেলতে গিয়ে পয়েন্টে ক্যাচ দিয়ে বসেন শান্ত। মুমিনুল, মুশফিকরাও বাজে শটে ছুড়ে আসেন উইকেট।
নিজ দলের বোলারদের পারফরম্যান্সে স্বাভাবিকভাবেই খুশি ল্যাঙ্গাভেল্ট। মাঝে কয়েক মাস বাংলাদেশ দলে কাজ করা সাবেক দক্ষিণ আফ্রিকান পেসার ব্যাখ্যাহীন সব আউটের পেছনে দায় দেন মনস্ত্বাত্ত্বিক সমস্যার।
“ব্যাটসম্যানদের এমন হতে পারে। আমি 'মেন্টাল এরর' বলি। যেকোনো ব্যাটিং লাইনআপে এটি হতে পারে। এমন না যে (শান্ত) খুব খারাপ শট খেলেছিল। মুজারাবানি একটি ক্রস সিম ডেলিভারি করেছিল, যা বাড়তি লাফিয়ে ওঠে। এই জায়গা দিয়ে সে অনেক রান করে। তো এমনটা কখনও কখনও হতে পারে।”
ঘরের মাঠে খেলা, উইকেট-কন্ডিশন পুরোপুরি চেনা, টসের ফলও এলো পক্ষে- তবু নিদারুণ ব্যাটিং ব্যর্থতা! টস জিতে আগে ব্যাটিং করা এর আগের তিন ম্যাচেও অবশ্য দুইশ করতে পারেনি বাংলাদেশ। কিন্তু তুলনামূলক দুর্বল প্রতিপক্ষ ও নির্বিষ বোলিং আক্রমণের বিপক্ষেও হতাশাময় ব্যাটিং স্বাভাবিকভাবেই জন্ম দেয় অনেক প্রশ্নের।
দীর্ঘদিন এসব ক্রিকেটারদের কাছ থেকে দেখার অভিজ্ঞতা থেকে এই বিষয়ে সবচেয়ে ভালো ব্যাখ্যা দিতে পারতেন সালাউদ্দিন। সেই পথে হাঁটেননি তিনি। শান্ত, মুমিনুলদের টেকনিক্যাল ভুলের কথা অবশ্য বলেন জাতীয় দলের সিনিয়র সহকারী কোচ।
“টেকনিক্যালি আমরা কিছু ভুল করেছি। হঠাৎ বাজে শট খেলেছি। যখনই ঘুরে দাঁড়ানোর পথে ছিলাম, একজন সেট ব্যাটসম্যান আউট হয়ে গেছে। এটা পুরোটাই আসলে মানসিক ব্যাপার। আমি মনে করি, ওদের হয়তো রুটিন বা প্রসেস ভালো হয়নি। প্রতিটি বল কিভাবে খেলতে হবে, সেই প্রক্রিয়ায় থাকেনি।”
“এখানে আমাদের দ্রুত কাজ করতে হবে। প্রতিটি বল খেলার আগে কীভাবে আমাদের রুটিন ওয়ার্ক করার কথা, সেটা করতে হবে। অন্য ফরম্যাটে আপনি একবারই সুযোগ পাবেন। টেস্ট ক্রিকেটে আপনাকে দ্বিতীয় সুযোগ দেয়। সেখানে ভালো করাটা অনেক বেশি জরুরি।”
টেকনিক্যাল কিংবা মানসিক সমস্যার চেয়েও প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছিল ব্যাটসম্যানদের পরিস্থিতি পড়তে পারার ব্যর্থতা। তৃতীয় উইকেটে জুটি গড়ে ওঠার সময় হুট করে আউট হয়ে যান শান্ত। পরে মুশফিকও বাজে শট খেলে ড্রেসিং রুমের পথ ধরেন।
দ্রুত উইকেট হারানোয় মুমিনুলের ওপর ছিল ইনিংস টেনে নেওয়ার দায়িত্ব। কিন্তু তিনি বেছে নেন স্লগ করার পথ। যা ওই সময় কোনো প্রয়োজনই ছিল না। অযথাই বড় শটের চেষ্টায় উইকেট বিলিয়ে আসেন ৫৬ রান করা অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যান।
এসব আউটের পেছনে পরিস্থিতির দাবি মেটাতে না পারার ব্যর্থতা মেনে নেন সালাউদ্দিন।
“ম্যাচ অ্যাওয়ারনেসে ঘাটতির উত্তর আসলে সবাই জানে। এটা থেকে কিভাবে আমরা উত্তরণ করতে পারি, সেটা বের করতে হবে। তারা যেন তাড়াতাড়ি ম্যাচ অ্যাওয়ারনেস ঠিক করতে পারে। হবে না, আমি বলব না। তাড়াতাড়ি করতে হবে। ভুল আপনি করতে পারেন। কিন্তু ভুলগুলো যেন পুনরাবৃত্তি না হয়। সেটা তাহলে আরও ভুল হবে।”
‘ম্যাচ অ্যাওয়ারনেসের’ এই ঘাটতি নিয়েও আলোচনা তো বছরের পর বছর ধরেই হয়ে আসছে। উন্নতি কোথায়? সালাউদ্দিন ছড়িয়ে দিলেন সমস্যার সীমানা। দেশের ক্রিকেটের সামগ্রিক বাস্তবতা তুলে ধরলেন দিনি। জাতীয় দলে ফল পাওয়ার জন্য ঘরোয়া ক্রিকেট বা অন্যান্য পর্যায়ে কঠিন চ্যালেঞ্জ উতরে আসার কথা বলেন দেশের অভিজ্ঞ কোচ।
“একটা দেশের ক্রিকেট আসলে নির্দিষ্ট কয়েকজন ক্রিকেটারের ওপর নির্ভর করে না। পুরো দেশের ক্রিকেটের কাঠামোটা কেমন, ওরা কতটা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়ে সামনে আসছে। সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য অনেক খেলা খেলতে হবে। সেটা 'এ' দল বা এইচপিতে হবে। আপনাকে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে খেলতে হবে।”
টেস্ট সিরিজের দলে যোগ দেওয়ার আগে ওয়ানডে সংস্করণের ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ খেলেছেন শান্তরা। সপ্তাহখানেকের প্রস্তুতি নিয়েই নেমে যেতে হয়েছে লাল বলের ক্রিকেট খেলতে। দলের পক্ষ থেকে প্রস্তুতির ঘাটতির কথা বলা হয়নি একবারও। সালাউদ্দিনও প্রস্ততির দিকে আঙুল তোলেননি।
তবে সার্বিকভাবে ক্রিকেটারদের বেড়ে ওঠার পথ ও প্রক্রিয়া ঠিক করার দিকে জোর দিলেন সিনিয়র সহকারী কোচ।
“ক্রিকেটাররা প্রিমিয়ার লিগ খেলে এসেছে। ওখানে উইকেটের ব্যবহার যেরকম, এখানে কিন্তু ভিন্ন খেলা খেলতে হচ্ছে। এগুলোতে কতটা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে এসেছেন এবং কীভাবে ছেলেগুলো বড় হচ্ছে সেটার উপর নির্ভর করবে ক্রিকেট কাঠামো।”
“শেষ ৬টা টেস্টে আমাদের ব্যাটসম্যানরা ভালো করেনি। তাহলে নতুন কাউকে খোঁজেন। তাকেও আবার তৈরি করতে সময় দিতে হবে। তাকে আমরা সুযোগ দিতে থাকব। একটা সময়ে আমরা মনে করব, তাকে দিয়ে হবে। কিন্তু রিসোর্স খুবই কম আছে। ওইটা নিয়েও চিন্তা করলে হবে না যে, আসলে কি নেই। এর মধ্যে থেকে আমরা কীভাবে বের হতে পারি সেটা নিয়ে জরুরি কাজ করা উচিত।”
সিরিজ শুরুর আগে টেস্ট সংস্কৃতি গড়ার দিকে জোর দিয়েছিলেন শান্ত। সেজন্য এই ম্যাচ থেকেই নতুন কিছু করার আশার কথাও বলেছিলেন বাংলাদেশ অধিনায়ক। প্রথম দিন অবশ্য দেখা গেছে পুরোনো বাংলাদেশই।
নতুন কিছু পেতে ক্রিকেটারদের মাঠের খেলার বাইরেও আরও আনুষঙ্গিক বিষয়ের গুরুত্বের কথা বলেন সালাউদ্দিন।
“একটা কথা বলি। একটা দেশ যদি ধরেন, অর্থনৈতিক দিক দিয়ে অনেক শক্তিশালী। আপনি কি একটা দিকে দিয়ে কখনও শক্তিশালি হতে পারবেন? আপনার ভালো প্রশাসন লাগবে, ভালো রাস্তাঘাট লাগবে, ভালো লোকজন লাগবে। সবকিছুই লাগবে। যদি বলেন খেলোয়াড়রা চেষ্টা করছে না, এটা ভুল বলা হবে। কারণ আমি খুব কাছ থেকে দেখতেছি। তারা চেষ্টা করছে।”
“এটার সঙ্গে তো আনুসঙ্গিক অনেক ব্যাপার থাকবে। আমার ভালো কোচ লাগবে, আমরা ভালো কোচিং করাই না। আমরা তো তৃণমূল থেকে ভালো কোচিং করাই না। আমরা ভালো মাঠ দিতে পারিনি। যারা পাকিস্তানে গেছেন, তারা তো দেখছেন, সাধারণ একটা একাডেমি মাঠে কী সুযোগ-সুবিধা আছে। আমাদের কী সেরকম সুবিধা… (আছে?)”
ব্যর্থতার দায় স্বীকার করা কিংবা সামনে ভালো করার তাগিদ দেওয়া অথবা আশাবাদী মন্তব্য করা দেশের ক্রিকেটের নিয়মিত চিত্র। কিন্তু ধারাবাহিকভাবে ইতিবাচক ফল কখনও পাওয়া যায়নি। সেজন্য কত দিন অপেক্ষা করতে হবে, সেই প্রশ্ন রাখলেন সালাউদ্দিনও।
“একটা দেশের ক্রিকেট কীভাবে এগোবে... এখানে সবারই সাহায্য করতে হবে। এখানে কেউ একা বের করতে পারবে না। আমার কোচ ভালো হলেও চলবে না, আমার খেলোয়াড় ভালো হলেও চলবে না, আমার সঙ্গে আরও অনেক কিছু ভালো হতে হবে। এখন যদি বলেন এর জন্য কতদিন অপেক্ষা করতে হবে, এটা আমার নিজেরও প্রশ্ন।”