ভবিষ্যতে টেস্ট খেলানোর ভাবনায় বাংলাদেশ ‘এ’ দলে আফিফ

লাল বলের ক্রিকেটে আফিফের ভালো করার প্রবল সম্ভাবনা আছে বলে মনে করেন নির্বাচক হাবিবুল বাশার।

স্পোর্টস ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 May 2023, 03:00 PM
Updated : 4 May 2023, 03:00 PM

নির্বাচক হাবিবুল বাশার বৃহস্পতিবার দিনজুড়ে ছিলেন ফতুল্লায়, ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে আবাহনী লিমিটেড ও প্রাইম ব্যাংক ক্রিকেট ক্লাবের ম্যাচে। লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেটে আফিফ হোসেনের প্রথম সেঞ্চুরিটি তাই কাছ থেকেই দেখেছেন তিনি। ইনিংসটি নিয়ে জিজ্ঞেস করতেই হাবিবুল বললেন, “দারুণ ইনিংস… খুবই পরিণত ব্যাটিং করেছে…।” জাতীয় দলে জায়গা হারানো ব্যাটসম্যান যেভাবে ইনিংসটি গড়েছেন, তাতে মুগ্ধ এই জাতীয় নির্বাচক। মজা করে তিনি বললেন, “আফিফ হয়তো দেখতে পেয়েছিল যে মাঠে নির্বাচক আছে…!”

এই সংস্করণে ৯৫ ইনিংস খেলে ১৮ বার পঞ্চাশ ছুঁয়ে অবশেষে প্রথম শতরানের স্বাদ পেলেন আফিফ, এতে উচ্ছ্বাসের চেয়ে স্বস্তিই বেশি থাকার কথা। তবে এই মুহূর্তে দেশের ক্রিকেটে তাকে নিয়ে মূল কৌতূহল আরেক জায়গায়। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ‘এ’ দলের বিপক্ষে আনঅফিসিয়াল টেস্ট ম্যাচ সিরিজের প্রথম দুই ম্যাচের স্কোয়াডে নেওয়া হয়েছে তাকে। অধিনায়কের দায়িত্বও দেওয়া হয়েছে। প্রশ্ন এবং বিস্ময় সেখানেই, আফিফ এই দলে কেন!

গত দেড় বছরে আফিফ কোনো প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলেননি। সবশেষ ২০২১ সালের ডিসেম্বরে বিসিএলের তিনটি ম্যাচ খেলেছিলেন। গত তিন বছরে লাল বলের ম্যাচ তার ওই তিনটিই। তবে সংশয়টা শুধু এখানেই নয়। ২০১৬ সালে বিপিএলে ৫ উইকেট নিয়ে স্বীকৃত ক্রিকেটে অভিষেকের পর থেকে এতদিন ধরে দেশের ক্রিকেটে তার মূল পরিচয় তো সীমিত ওভারের ক্রিকেটারই!

বরাবরই সীমিত ওভারের ক্রিকেটের বিশেষজ্ঞ বলে বিবেচনা করা হয়েছে তাকে। জাতীয় দলের বিবেচনায়ও স্রেফ সাদা বলের ভাবনায়ই এতদিন তাকে রাখা হয়েছে। টেস্ট দলে ডাক পাওয়া তো বহুদূর, প্রাথমিক দলের বিবেচনায়ও সেভাবে তাকে রাখা হয়নি। সেই আফিফকে যখন হুট করে ‘এ’ দলের অধিনায়কের দায়িত্ব দেওয়া হয়, তার মানে তো টেস্ট দলের ভাবনায়ও তাকে রাখা হচ্ছে!

‘হুট করে’ ডাক পাওয়া ব্যাপারটায় অবশ্য আপত্তি করলেন হাবিবুল। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে কথোপকথনে তার দাবি, আফিফকে লাল বলের জন্য তারা ভাবনায় রেখেছিলেন আগে থেকেই।

“হুট করে নয়। আগেও আমাদের ভাবনায় ছিল। আমরা দেখেছি প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ওর ব্যাটিং। হয়েছে কী, ওর পরিচয় হয়ে গিয়েছিল টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটার বা সীমিত ওভারের ক্রিকেটার। ও নিজেও কিন্তু এটা পছন্দ করে না। আমার সবসময়ই মনে হয়েছে, লাল বলের ক্রিকেটে ওর সামর্থ্য আছে।”

“আচমকা তাই কিছু হয়নি। ওকে নিয়ে আমাদের চিন্তাভাবনা ছিল যে ভবিষ্যতে টেস্ট ম্যাচ খেলাব। এখন আন্তর্জাতিক ম্যাচ বেশ কিছু খেলেছে, বেশ অভিজ্ঞতা হয়েছে। আর সত্যি বলতে, সবাই ওকে যেরকম ভাবে, আসলে সে ওরকম নয়। সবাই টি-টোয়েন্টি ব্যাটসম্যান ভাবলেও ও কিন্তু সুযোগ পেলে বড় রান করে। অল্প কিছু ম্যাচ খেলেই ৫টি সেঞ্চুরি করেছে (প্রথম শ্রেণিতে)। সত্যি বলতে, যথেষ্ট পরিণতও এখন। ওর কাছ থেকে ভালো কিছু আশা করি।”

প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ২৬ ম্যাচ খেলে ৫টি সেঞ্চুরি তার, ফিফটি ৩টি। এই পরিসংখ্যান কিছুটা স্বাক্ষ্য দেয় হাবিবুলের কথার পক্ষেই, সুযোগ পেলে বড় রান আফিফ করেন। ২৬ ম্যাচে ৫ সেঞ্চুরি বাংলাদেশের বাস্তবতায় বেশ ভালো অবশ্যই। তবে ৫ সেঞ্চুরির পরও তার ব্যাটিং গড় স্রেফ ৩২.৩৬। এতে বোঝা যায়, অল্প রানেও তিনি কাটা পড়েছেন অনেকবার। 

পাশাপাশি এটিও সত্যি, কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর জন্য ২৬ ম্যাচ খুব বেশি নয়। প্রশ্ন তাই কিছু থাকেই। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, দীর্ঘদিন ধরে লাল বলের ক্রিকেট থেকে তার দূরে থাকাই।

হাবিবুলের দাবির পক্ষে কিছু সত্যতা অবশ্য পাওয়া যায় আফিফের ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে তাকালে। বাংলাদেশ ‘এ’ দলের হয়ে তিনটি আনঅফিসিয়াল টেস্ট ম্যাচ খেলেছেন তিনি। ২০১৮ সালে শ্রীলঙ্কা ‘এ’ দলের বিপক্ষে একটি, ২০১৯ সালে আফগানিস্তান ‘এ’ দলের বিপক্ষে দুটি। পারফরম্যান্স যদিও ভালো নয়। তিন ম্যাচে ফিফটি ছিল স্রেফ একটি।

লাল বলের জন্য আফিফ নির্বাচকদের ভাবনায় ছিলেন, এই দাবির বিপক্ষে যুক্তিও আছে। শুধু ঘরোয়া প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটেই নয়, গত কয়েক বছরে বিসিবি একাদশ কিংবা বাংলাদেশ সফরে আসা বিদেশি দলগুলির প্রস্তুতি ম্যাচেও লাল বলের ক্রিকেটে তাকে রাখা হয়নি। এই ধরনের ম্যাচ আফিফ সবশেষ খেলেছেন সেই ২০১৮ সালে চট্টগ্রামে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে তিন দিনের ম্যাচে।

তবে হাবিবুলের স্থির বিশ্বাস, সুযোগ পেলে টেস্ট দলে জায়গা পাওয়ার জোর দাবি জানাতে পারবেন আফিফ।

“আমার কিন্তু সবসময়ই মনে হয়েছে, এই ছেলেটার সম্ভাবনা আছে লাল বলে ভালো করার। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ওর কিছু ভালো ইনিংস আমি দেখেছি, খুব ইন্টারেস্টিং… ভালো সেঞ্চুরি দেখেছি।”

“প্রথম শ্রেণির ম্যাচে যখন সুযোগ পেয়েছে, বড় রান করেছে। কয়েকটি সেঞ্চুরি আছে, ওপরের দিকে সুযোগ পেলে বড় রান করতে পারে। হ্যাঁ, বলতে পারেন যে অনেক বেশি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ সে খেলেনি। খুব বেশি সুযোগ পায়নি। কিন্তু আমার মনে হয়, এসব জায়গায় যথেষ্ট সুযোগ পেলে সে টেস্ট ক্রিকেটের জন্য শক্ত দাবিদার হতে পারে।”

হাবিবুলের মতে, ব্যাটিং অর্ডারে ওপরের দিকে পর্যাপ্ত সুযোগ পেলে আরও ভালো কিছু উপহার দিতে পারবেন আফিফ।

“কিছু কিছু ক্রিকেটার থাকে, বরাবরই একটু দুর্ভাগা। আফিফ যখন এইচপি-তে ছিল, তখন থেকেই অনেক সময় ও আমাকে বলত, ‘স্যার, আমাকে একটু ওপরে ব্যাট করতে দিন, ওপরে খেলতে চাই।’ কারণ তখন এইচপিতেও ওকে ছয়-সাতেই খেলানো হতো। পরেও নানা কারণে ওপরে ব্যাট করার সুযোগ আসলে খুব বেশি হয়নি ওর। কিন্তু প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে যখনই সুযোগ পেয়েছে, সেট হলে বড় ইনিংস খেলেছে।”

এসব ক্ষেত্রে অনেক সময়ই জাতীয় দল থেকে কোনো ইঙ্গিত বা নির্দেশনা পেলে এভাবে কাউকে সুযোগ দেওয়া হয়। তবে হাবিবুল বললেন, জাতীয় দলের কোচ চান্দিকা হাথুরুসিংহে, টেস্ট অধিনায়ক সাকিব আল হাসান কিংবা টেস্ট দলের টিম ম্যানেজমেন্ট এরকম কিছুই বলেনি আফিফকে নিয়ে।

“নাহ, কোনো ইঙ্গিত দেওয়া হয়নি। সম্ভবত, ও নিজেও অবাক হয়েছে। আমাদেরই আসলে ভাবনায় ছিল…। আমাদের আশা, ও ভালো কিছু করবে।”

সেই আশায় বাধার দেয়াল হতে পারে আফিফের অধিনায়কত্বও। এমনিতে ‘এ’ দলের ম্যাচে চাপ ততটা নেই, অধিনায়কের দায়িত্বও তেমন কোনো বড় বোঝা নয়। তবে লাল বলের ক্রিকেটে যিনি দীর্ঘদিন খেলেন না, যার ব্যাটিংকে পরখ করে দেখা হবে, তার ওপর এমন ভার চাপিয়েও দেওয়াটাও তো প্রশ্নবিদ্ধ!

এই দায় অবশ্য হাবিবুল নিলেন মাথা পেতেই। তিনি শোনালেন, ভালো কিছুর আশা থেকেই মূলত এই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে আফিফকে। 

“অধিনায়কত্ব ওর জন্য বোঝা হবে কি না, এই শঙ্কা কিছুটা আমাদেরও আছে। তবে যে গ্রুপটা পেয়েছে, এই গ্রুপের অধিনায়কত্ব করতে ওর সমস্যা হবে না। ওরা একসঙ্গে খেলেছে অনেক।”

“অনেক সময় আমরা অনেক ছেলেকে ভাবি যে অধিনায়কত্বের রসদ নেই। কিন্তু পরে দেখা যায় যে অধিনায়ক হয়ে আরও ভালো করেছে। প্রশ্ন তো থাকবেই, স্বাভাবিক। আমাদেরও যে একটু দুর্ভাবনা নেই, তা নয়। তবে আশা করি, সমস্যা হবে না। দেশের মাঠে খেলা, সহায়তা করার জন্য অনেকে থাকবে, আশা করি সমস্যা হবে না।”

হাবিবুল আশার রসদ পাচ্ছেন বৃহস্পতিবার আফিফের সেঞ্চুরিটি দেখেও। ঢাকা লিগে আগের চার ম্যাচের দুটিতে তিনি আউট হন শূন্য রানে, দুটিতে ফেরেন ৩১ ও ৩৬ রানে। তবে এই ম্যাচে দলের চাপের সময়ে দারুণ খেলে শেষ পর্যন্ত অপরাজিত থাকেন ৬ চার ও ৫ ছক্কায় ১০১ বলে ১১১ রান করে। হাবিবুলের চোখে এটি ছিল পরিপূর্ণ এক ইনিংস।

“যেটা বললাম, খুবই ভালো ব্যাটিং করেছে। গোটা ইনিংসে মনে হয় মাত্র একটা ফলস শট খেলেছিল। এছাড়া সব ঠিক ছিল। একদম কমপ্লিট ব্যাটসম্যানের মতো ব্যাটিং করেছে।”

“আগেও কিছু ম্যাচে ভালো ব্যাট করেছে। তবে এতটা কমপ্লিট ছিল না। কয়েক ইনিংসে ৩০-৪০-৫০ করে আউট হয়ে গেছে। আজকে সেই ভুল করেনি।”

‘এ’ দলে লাল বলে খেলে টেস্ট দলে দাবি জানানোর আগে আফিফের জন্য জরুরি হয়তো সাদা বলের ক্রিকেটে নিজের জায়গা ফিরে পাওয়া! বিশেষ করে, বিশ্বকাপের আগে সময় তো খুব বেশি বাকি নেই!

গত মাসে লেজেন্ডস অব রূপগঞ্জের বিপক্ষে রান তাড়ায় ৬২ বলে ৮০ রানের ম্যাচ জেতানো ইনিংস তিনি খেলেছিলেন। এরপর এবারের এই সেঞ্চুরি। তাতে আবার জাতীয় দলে ফেরার দাবি তিনি জানাতে পারলেন কি না, এই প্রশ্ন উঠল। হাবিবুল অবশ্য সরাসরি সেই কথার জবাব দিলেন না। তবে আফিফের ব্যাটিংয়ের ধরন তার নজর কেড়েছে, তা বললেন আবারও।

“হয়তো বলতে পারেন (ফেরার দাবি জানিয়েছে)… কিংবা, আসলে ওভাবে বলা ঠিক হবে না বা আমি বলতে চাই না। তবে এটা বলতে পারি, আজকে সে অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যানের মতো ব্যাট করেছে। এরকম অনেক সময়ই হয়েছে ওর ক্ষেত্রে যে, ভালো খেলতে খেলতেই হুট করে লুজ শট খেলেছে বা ফ্যান্সি কিছু করতে গিয়ে আউট হয়ে গেছে। কিন্তু আজকে পুরো দায়িত্ব নিয়ে খেলেছে।”

“আবাহনী তো চাপে ছিল একটা সময়। সেখান থেকে আফিফ ইনিংসের হাল ধরেছে, ইনিংস গড়েছে, সময় হলে মেরে খেলেছে। সত্যিকারের পরিণত ব্যাটসম্যানের মতোই ব্যাট করেছে।”

ক্যারিবিয়ানদের এই সফরে এবার চার দিনের ম্যাচ আছে তিনটি। আপাতত ঘোষণা করা হয়েছে প্রথম দুই ম্যাচের দল। শেষ ম্যাচের দলে কিছু পরিবর্তন হবে বলেও জানিয়ে রাখলেন হাবিবুল।

জুন-জুলাইয়ে আফগানিস্তানের বিপক্ষে বাংলাদেশের পূর্ণাঙ্গ সিরিজ। সেই সিরিজের অনুশীলনের জন্য টেস্ট দলের মুমিনুল হক, সৈয়দ খালেদ আহমেদকে ক্যারিবিয়ানদের বিপক্ষে শেষ আনঅফিসিয়াল টেস্টে খেলানো হবে, জানালেন হাবিবুল।

“মুমিনুল খেলবে শেষ ম্যাচটিতে। ওকে একটি নাকি দুটি ম্যাচে খেলানো হবে, এটা নিয়ে আলোচনা ছিল। পরে আমাদের মনে হলো, শুরুতে যাদের নেওয়া হচ্ছে, তাদেরকে অন্তত দুটি ম্যাচে রাখা উচিত পর্যাপ্ত সুযোগ দিতে। মুমিনুলকে তো আর দেখার কিছু নেই। স্রেফ অনুশীলনের ব্যাপার। শেষ ম্যাচে তা করে নিতে পারবে। সঙ্গে খালেদ ও আরও দু-একজনকেও আনা হতে পারে।”

ক্যারিবিয়ানদের বিপক্ষে বাংলাদেশ ‘এ’ দলের পুরো সিরিজটিই হবে সিলেটে। সিরিজ শুরু ১৬ মে।