প্রায় ১৪ বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার ও ২০ বছরের পেশাদার ক্যারিয়ারের ইতি টানলেন ভারতীয় ব্যাটসম্যান।
Published : 24 Aug 2024, 12:04 PM
আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার থমকে আছে বছর দুয়েক ধরে। নতুন শুরুর সম্ভাবনা আর ছিল না। আইপিএল পারফরম্যান্সেও ছিল ভাটার টান। চোটের ছোবল তো ছিলই। সব মিলিয়ে শেষের ডাক শুনতে পারছিলেন শিখার ধাওয়ান। সেই ডাকে শেষ পর্যন্ত সাড়া দিলেন তিনি। খেলেয়াড়ি জীবনের ইতি টানলেন ভারতীয় ব্যাটসম্যান।
সামাজিক মাধ্যমে শনিবার সকালে এক ভিডিও বার্তায় বিদায়ের ঘোষণা দেন ৩৮ বছর বয়সী এই ক্রিকেটার। তার কণ্ঠে আবেগের ছোঁয়া থাকলেও মুখে লেগে ছিল এক চিলতে হাসি।
“জীবনের এমন এক মোড়ে দাঁড়িয়ে আছি আমি, যেখানে পেছনে তাকালে এক স্মৃতিগুলোই চোখে ভাসে, আর সামনে তাকিয়ে দেখি পুরো দুনিয়া। আমার সবসময়ই একটিই লক্ষ্য ছিল, ভারতের হয়ে খেলা। সেটি হয়েছেও। এজন্য অনেকের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। প্রথমে আমার পরিবার, ছেলেবেলার কোচরা, আমার সব সতীর্থ, যাদের সঙ্গে অনেক বছর খেলেছি, আরেকটি পরিবার পেয়েছি, নাম গড়েছি, আপনাদের ভালোবাসা পেয়েছি।”
“তবে বলা হয় না, জীবনের গল্পে সামনে এগিয়ে যেতে নতুন অধ্যায় শুরু করা জরুরি। আমিও এমন কিছু করতে যাচ্ছি। আন্তর্জাতিক ও ঘরোয়া ক্রিকেট থেকে অবসরের ঘোষণা দিচ্ছি। ক্রিকেটীয় পথচলার সমাপ্তি টানার দিনটিতে আমার হৃদয়ে একটি শান্তি আছে যে, ভারতের হয়ে অনেক খেলেছি। নিজেকে আমি স্রেফ এটিই বলছি, দেশের হয়ে আর খেলব না বলে দুঃখ পাওয়ার কিছু নেই, বরং এই খুশিটা নিজের কাছে থাকুক যে, দেশের হয়ে অনেক খেলেছি। এটিই আমার জন্য সবচেয়ে বড় ব্যাপার, আমি খেলেছি…।”
প্রায় ১৪ বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে ৩৪ টেস্ট, ১৬৭ ওয়ানডে ও ৬৮ টি-টোয়েন্টি খেলেছেন ধাওয়ান। টেস্টে ৭ সেঞ্চুরিতে তার রান ৪০.৬১ গড়ে রান করেছেন ২ হাজার ৩১৫, ওয়ানডেতে ১৭ সেঞ্চুরি ও ৩৯ ফিফটিতে রান ৪৪.১১ গড়ে ৬ হাজার ৭৯৩। স্ট্রাইক রেট ৯১.৩৫। টি-টোয়েন্টিতে ১১ ফিফটিতে রান ১ হাজার ৭৫৯, গড় ২৭.৯২, স্ট্রাইক রেট ১২৬.৩৬।
ঘরোয়া ক্রিকেটের শীর্ষ পর্যায়ে তার পথচলা শুরু সেই ২০০৪ সালে। সেবার বাংলাদেশে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে ৫০৫ রান করে ম্যান অব দা টুর্নামেন্ট হয়ে নজর কাড়েন তিনি। পরে রঞ্জি ট্রফিতে অভিষেক হয় দিল্লির হয়ে। স্বীকৃত ক্রিকেটে তিন সংস্করণ মিলিয়ে ৭৫৮ ম্যাচ খেলে ৫৭ সেঞ্চুরিতে রান করেছেন ৩০ হাজারের বেশি।
পরিসংখ্যানই বলছে, সবচেয়ে বেশি আলো ছড়িয়েছেন তিনি ৫০ ওভারের ক্রিকেটে। আদতেই ওয়ানডে ক্রিকেটের আধুনিক এক গ্রেট হয়ে থাকবেন তিনি। ওয়ানডে ইতিহাসের স্রেফ আট ব্যাটসম্যানের একজন যিনি, ৫ হাজারের বেশি রান করেছেন ৪০-এর বেশি গড় ও ৯০-এর বেশি স্ট্রাইক রেটে। এই তালিকায় ভারত থেকে আছেন আর কেবল ভিরাট কোহলি ও রোহিত শার্মা।
২০১০ সালে ওয়ানডে ক্রিকেট দিয়েই ধাওয়ানের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার শুরু। অভিষেকে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে শূন্য রানে আউট হওয়ার পর বাদপড়ে যান। পরের বছর ফেরার ম্যাচে করেন ফিফটি। তবে পরের তিন ম্যাচের ব্যর্থতায় আবার ছিটকে পড়েন দল থেকে।
তার আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার পুনরুজ্জীবিত হয় ২০১৩ সালে।, এবার ফেরেন টেস্ট ক্রিকেট দিয়ে এবং অভিষেকেই আলোড়ন তোলেন। মোহালিতে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সেঞ্চুরি করেন ৮৫ বলে, অভিষেকে যা দ্রুততম শতরানের বিশ্ব রেকর্ড। সেই ইনিংসে ১৭৪ বলে করেন তিনি ১৮৭ রান।
সেই পথ ধরে ওয়ানডে ক্রিকেটেও ফেরেন তিনি ২০১৩ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে। ফেরার ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে করেন ৯৪ বলে ১১৪। পরের ম্যাচে অপরাজিত সেঞ্চুরি করেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে। ভারতের শিরোপা জয়ের সেই আসরে সর্বোচ্চ রান করে ম্যান অব দা টুর্নামেন্ট হন তিনি। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।
ওই বছর ৫০.৫২ গড় ও ৯৭.৮৯ গড়ে ১ হাজার ১৬২ রান করেন তিনি। স্রেই রানের স্রোত বইতেই থাকে পরর বছরগুলোয়। ২০১৪ এশিয়া কাপ, ২০১৫ বিশ্বকাপ, ২০১৭ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি, ২০১৮ এশিয়া কাপ, সবগুলিতেই তিনি ছিলেন সর্বোচ্চ রান স্কোরার।
২০১৩ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি থেকে রোহিত শার্মার সঙ্গে তার উদ্বোধনী জুটিরও শুরু। পরের সময়টায় ভারতের অনেক সাফল্যের পেছনে বড় অবদান অসাধারণ যে জুটির। ওয়ানডে ইতিহাসের চতুর্থ সফলতম উদ্বোধনী জুটি তারা (১১৫ ইনিংসে ৫১৪৮)। ভারতের হয়ে শুরুর জুটিতে তাদের চেয়ে বেশি রান আছেন কেবল সাচিন টেন্ডুলকার ও সৌরভ গাঙ্গুলি জুটির (১৩৬ ইনিংসে ৬৬০৯)।
টেস্টে দারুণ শুরুর পর আরও কয়েকটি স্মরণীয় ইনিংস তিনি খেলেছেন। তবে যথেষ্ট ধারাবাহিক হতে পারেননি। ২০১৮ সালের ইংল্যান্ড সফরে টানা চার টেস্টে ব্যর্থতার পর আর সুযোগ পাননি সাদা পোশাকে।
ওয়ানডে ক্যারিয়ারে প্রথম বড় ধাক্কা হজম করতে হয় তাকে ২০১৯ বিশ্বকাপে। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ওভালে ১০৯ বলে ১১৭ রানের ইনিংসের পর চোটের কারণে ছিটকে পড়েন টুর্নামেন্ট থেকে। সেই চোট কাটিয়ে ফেরার পর আগের ধারাবাহিকতা সেভাবে আর ফেরেনি। তার ক্যারিয়ারের শেষ সেঞ্চুরি সেটিই। পরের ৩৫ ম্যাচে আর তিন অঙ্কের স্বাদ পাননি। ৯৬, ৯৭, ৯৮ রানে অবশ্য আউট হয়েছেন তিনটি ইনিংসে। তবে সামগ্রিক পারফরম্যান্সে ভাটার টান ছিল। চোটও আঘাত হানছিল বারবার। সবশেষ ২০২২ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ সফরে তিন ওয়ানডেতে ৭, ৮ ও ৩ রানে আউট হওয়ার পর আবার সুযোগ পাননি দলে।
নানা সময়ে নিয়মিত অধিনায়কের অনুপস্থিতিতে ১২ ওয়ানডে ও ৩ টি-টোয়েন্টিতে দেশকে নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি।
জাতীয় দলে অনিয়িমিত হলেও তিনি আইপিএলে খেলে যাচ্ছিলেন নিয়মিত। পারফর্মও করছিলেন। তবে গত আসরে কেবল ৫টি ম্যাচ খেলতে পারেন। তাতে ফিফটি ছিল একটি। পরে চোটের কারণে ছিটকে পড়েন। এবার সবকিছুর সমাপ্তি।
আইপিএলে তার ক্যারিয়ার থামল ৬ হাজার ৭৬৯ রান নিয়ে। তার চেয়ে বেশি রান করেছেন কেবল ভিরাট কোহলি ( ৮ হাজার ৪ রান)।
দুর্দান্ত ব্যাটসম্যানের পাশাপাশি দারুণ এক চরিত্রও ছিলেন তিনি। ড্রেসিং রুম মাতিয়ে রাখতেন নাচে-গানে। মাঠে ছিলেন প্রাণবন্ত। সতীর্থ-ভক্তরা তাকে মজা করে ডাকতেন ‘গাব্বার’ নামে।