একসময় দুজনের সম্পর্কের টানাপোড়েন নিয়ে চর্চা হতো প্রচুর, এখনও খুব কাছের বন্ধু নন দুজন, তবে দেশের স্বার্থে দলের জন্য কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করে দুই বছরে দলকে দুটি আইসিসি ট্রফি এনে দিলেন ভারতীয় ক্রিকেটের দুই মহাতারকা।
Published : 10 Mar 2025, 01:58 PM
দুজনের উদযাপন পর্ব চলছিল দুই দিকে। এক পর্যায়ে দুজনে ছুটলেন মাঠের মাঝখানে। হাতে তুলে নিলেন একটি করে স্টাম্প। শিরোপার স্মারক। এরপর পরস্পরের দিকে চোখ পড়তেই স্টাম্প খেলায় মেতে উঠলেন দুজন, গুজরাটের ঐত্যিবাহী ‘ডান্ডিয়া’ খেলার মতো। প্রাণখোলা হাসিতে একে অপরকে আলিঙ্গনে জড়ালেন। গলাগলি ধরে উদযাপন, নাচানাচি চলল। মনে হচ্ছিল, পৃথিবীর সবচেয়ে সুখি দুজন মানুষ। যেন কত দিনের বন্ধুত্ব তাদের!
আদতে ব্যাপারটি একসময় উল্টো ছিল বলেই খবর জানা যেত। ভিরাট কোহলি ও রোহিত শার্মার সম্পর্কের টানাপোড়েন নিয়ে মুখরোচক নানা কিছু খবরে এসেছে নানা সময়ে। বিশেষ করে, কোহলির নেতৃত্বের অধ্যায় শেষের পথ ধরে রোহিত যখন অধিনায়ক হলেন, দুজনের সম্পর্কের অবনতি ছিল অনেকটা ‘ওপেন সিক্রেট।’ কিন্তু সেই দিনগুলি এখন অতীত। বরং ভারতীয় ক্রিকেটের দুই মহাতারকার সম্পর্কের উষ্ণতা বড় ভূমিকা রেখেছে ভারতীয় ক্রিকেটে সোনালি দিন বয়ে আনায়।
নাহ, এখনও তাদেরকে খুব কাছের বন্ধু বা পরস্পরের প্রিয় মানুষ ধরে নেওয়ার প্রয়োজন নেই। সেটা জরুরিও নয়। গুরুত্বপূর্ণ হলো, দলের জন্য এক হয়ে ওঠা। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়ানো। একই লক্ষ্যে একই মানসিকতায় ছুটে চলা। তরুণদের সামনে উদাহরণ গড়ে তোলা। ব্যক্তিগত টানাপোড়েনের খেরোখাতা মাঠের বাইরে রেখে আসা। ড্রেসিং রুমকে একটি পরিবার করে তোলা। দেশের জার্সি গায়ে চাপিয়ে, পতপত করে উড়তে থাকা দেশের পতাকার দিকে তাকিয়ে, জাতীয় সঙ্গীত গেয়ে মাঠে নামার সময় সবাই সহযোদ্ধা হয়ে দেশ ও দলের জন্য শতভাগ উজাড় করে দেওয়া। ব্যস!
ঠিক এই কাজগুলিই করছেন কোহলি ও রোহিত।
ভারত যে আইসিসি আসরে এত এত সাফল্য পাচ্ছে, এসব কোনো কাকতাল নয়। দেশের ক্রিকেট কাঠামো, প্রতিভার প্রচুর জোগান, জাতীয় দলের ম্যানেজমেন্ট, পেশাদারিত্ব, সব কিছু তো আছেই। তবে এই সাফল্যে বড় অবদান দেশের ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় দুই তারকার মানসিকতাও।
অতীতের টানাপোড়েনের সমাপ্তি যেভাবেই হোক, সেটা কোহলির চাওয়ায় হোক বা রোহিতের উদ্যোগে, তৃতীয় কারও হস্তক্ষেপে হোক বা অন্য কোনোভাবে, ভারতীয় ক্রিকেটের জন্য এটি এসেছে আশীর্বাদ হয়ে। এমন দুই মহীরুহ, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে যাদের হাজার হাজার রান, অসংখ্য রেকর্ড-অর্জন-কীর্তি, দেশজুড়ে কোটি কোটি ভক্ত, যাদের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে স্পন্সররা, অনেকের কাছেই যারা ইশ্বরের কাতারে, এমন দুজন যখন দলের জন্য হাতে হাত রেখে এগিয়ে যেতে পারেন ব্যক্তিগত ‘ইগো’ ভুলে, তখন তরুণ থেকে শুরু করে সবার কাছেই একটি বার্তা যায়, দলের চেয়ে বড় কিছু নেই।
ক্রিকেটীয় আত্মত্যাগও করতে হয়েছে। অধিনায়ক হিসেবে এখানে নিঃস্বার্থ চিন্তা করেছেন রোহিতই। ওয়ানডে ক্রিকেটে তিনটি ডাবল সেঞ্চুরি তার, বরাবরই বড় ইনিংস খেলতে ভালোবাসেন, শুরুতে সময় নিয়ে খেলে পরে তা পুষিয়ে দেওয়া ছিল তার ধরন। কোহলিও অনেকটা একই পথে অনুসরণ করতেন। এই সময়ের ক্রিকেটে দুজন সিনিয়র ক্রিকেটার এমন থাকলে দলের জন্য দুর্ভাবনার বিষয়। এখানেই এগিয়ে এলেন রোহিত।
এত বছর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলার পর তিনি নিজেকে ভাঙলেন আবার। এই রোহিতের কাছে আক্রমণই শেষ কথা। শুরু থেকে মারকাটারি ব্যাটিংয়ে দ্রুত রান তুলতে হবে, প্রতিপক্ষের বোলিং ও মনোবল গুঁড়িয়ে দিতে হবে। এই ঝুঁকির পথে তার বড় ইনিংসের সংখ্যা কমে গেল অনেক। কিন্তু দলের জন্য কার্যকর ইনিংস তো বেড়ে গেল!
রোহিত চললেন নতুন পথে। কোহলি রইলেন আগের মতো। যুগলবন্দি হয়ে উঠল সাফল্য প্রসবা।
২০২৩ বিশ্বকাপে রাজত্ব করলেন দুজনই। আগ্রাসন দিয়ে রোহিত, ধারাবাহিক রান স্রোতে কোহলি।
সাচিন টেন্ডুলকারের রেকর্ড ছাড়িয়ে এক বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ স্কোরের বিস্ময়কর কীর্তি গড়লেন কোহলি ৭৬৫ রান করে। ১১ ইনিংসে ৩টি সেঞ্চুরি, ৬টি ফিফটি। গড় ৯৫.৬২, স্ট্রাইক রেট ৯০.৩১।
রানের তালিকায় ঠিক পরের নামটিই ছিল রোহিতের। ১১ ইনিংসে তার রান ৫৯৭। সেঞ্চুরি তার কেবল একটি, ফিফটি ৩টি। গড় ৫৪.২৭। তবে স্ট্রাইক রেট প্রায় ১২৬! দলের জন্য যেটা বেশি জরুরি ছিল।
দুজনের এমন স্বপ্নময় পারফরম্যান্সের পরও শেষটা ছিল স্বপ্নভঙ্গের বেদনায়। ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার কাছে হেরে যায় ভারত।
ভাঙা হৃদয় জোড়া লাগিয়ে আবার একই পথে ছুটতে শুরু করেন দুজন। সাফল্য আর কত পালিয়ে বেড়াবে! ২০২৪ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জিতে ভারতের ১১ বছরের আইসিসি ট্রফির খরা ঘুচে যায়। সেখানে বড় নিয়ামক যথারীতি এই দুজন।
বিশ্বকাপ জিতে টি-টোয়েন্টিকে বিদায় জানালেন দুজন। কিন্তু ওয়ানডের অভিযান তো তখনও বাকি!
সেই তাড়নাই দুবাইয়ে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির শ্রেষ্ঠত্বের মঞ্চে তুলে দিল ভারতকে। আবারও ট্রফি নিয়ে উল্লাসে মেতে উঠলেন দুজন।
বারবাডোজে ফাইনালে ৭৬ রান করে ম্যাচ সেরা হয়েছিলেন কোহলি। এবার চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ফাইনালে ঠিক ৭৬ রান করেই ম্যাচ সেরা রোহিত।
এটা অবশ্যই কাকতাল।
কিংবা নিয়তিই দুজনকে গেঁথে ফেলল এভাবে এক সুতোয়।
ওয়ানডে বিশ্বকাপটা একসঙ্গে জয় করা এখনও বাকি। রোহিত অবসর নিচ্ছেন না। কোহলিও থাকছেন। আড়াই বছর পরের বিশ্বকাপে দুজন থাকবেন কি না, তা বলবে সময়।
তবে এই সময়টা বলছে, কোহলি-রোহিতের বন্ধন ভারকীয় ক্রিকেটে এনেছে আলোর দিন। আদুরে দিন।
বারবাডোজে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জয়ের পর যে আবেগে পরস্পরকে আলিঙ্গনে জড়িয়েছিলেন দুজন, চোখের কোণে চিকচিক করছিল আনন্দাশ্রু, দুবাইয়ে এই যে দুনিয়া জয়ের হাসিতে স্টাম্প নিয়ে ‘ডান্ডিয়া’ খেলায় মেতে উঠলেন দুজন, এই মুহূর্তগুলোই তুলে ধরছে ভারতীয় ক্রিকেটকে।
ভারতীয় ক্রিকেটের দুই গ্রেট ব্যক্তিগত ইগোকে হারিয়ে জিতিয়ে দিয়েছেন দেশকে।