বিপর্যয়ের মধ্যে ৩৫ বলে ৮৮ রানের বিধ্বংসী জুটি গড়লেন এই দুজন, দারুণ জয় দিয়ে বিপিএলের শিরোপা ধরে রাখার অভিযান শুরু করল বরিশাল।
Published : 30 Dec 2024, 06:17 PM
বাউন্ডারি সীমানার বাইরে দিয়ে মাঠময় ঘুরে বেড়াচ্ছিল বিপিএলের মাস্কট ‘ডানা ৩৬।’ মাঠের ভেতরে যেন ডানা পেয়ে গিয়েছিল বল। মাহমুদউল্লাহ ও ফাহিম আশরাফের ব্যাট থেকে বল ডানা মেলে উড়ে যাচ্ছিল গ্যালারির নানা প্রান্তে। ফাহিমের একটি শটে তো বল উড়ে গিয়ে গ্র্যান্ড স্ট্যান্ডের ছাদে আছড়ে পড়ে চলে গেল স্টেডিয়ামেরই বাইরে! সেই বলকে আর ফেরত আনার প্রয়োজন পড়ল না। ওই শটেই ম্যাচের সমাপ্তি।
মাহমুদউল্লাহ ও ফাহিম যখন জুটি গড়েছিলেন, ম্যাচ তখন হেলে পুরোপুরি দুর্বার রাজশাহীর দিকে। ফরচুন বরিশালের প্রয়োজন তখন ৪৬ বলে ৮৬ রান। উইকেট বাকি মোটে চারটি। এই দুজনের ব্যাটের তাণ্ডবে সেই চ্যালেঞ্জ স্রেফ তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিল বর্তমান চ্যাম্পিয়নরা। উইকেটের পতন হলো না আর একটিও। ৩৫ বলে ৮৮ রানের বিধ্বংসী জুটিতে ম্যাচ শেষ ১১ বল বাকি থাকতেই!
টিকেট নিয়ে দুই দিন ধরে উত্তপ্ত অবস্থা, আয়োজনগত নানা ঘাটতি আর ত্রুটিকে সঙ্গী করে শুরু হয়েছে এবারের বিপিএল। তবে মাঠের ক্রিকেটে উদ্বোধনী ম্যাচেই মিলল ইতিবাচকতার বার্তা। ইয়াসির আলি চৌধুরির ৪৭ বলে অপরাজিত ৯৪ রানের দুর্দান্ত ইনিংসে বিপিএল অভিষেকে দুর্বার রাজশাহী তুলেছিল ২০ ওভারে ১৯৭ রান। বর্তমান চ্যাম্পিয়ন বরিশাল ৬১ রানে ৫ উইকেট হারিয়েও শেষ পর্যন্ত জিতে গেল মাহমুদউল্লাহ-ফাহিমের ব্যাটের দাপটে।
নতুন বলে সেই পুরোনো মেয়ার্স
গত বিপিএলে নতুন বলে সুইং বোলিংয়ে ব্যাটসম্যানদের নিয়মিতই ভুগিয়েছেন কাইল মেয়ার্স। এবারও তিনি শুরু করলেন সেই একই রূপে। নিজের প্রথম দুই ওভারেই বিদায় করেন রাজশাহীর দুই ওপেনারকে।
সম্প্রতি জাতীয় লিগ টি-টোয়েন্টিতে সেঞ্চুরিসহ দুর্দান্ত ব্যাটিং করা জিসান আলম বিপিএল অভিষেকে আউট হন শূন্যতেই। মেয়ার্সের ইনসুইংয়ে দৃষ্টিকটূ স্লগ শটে বোল্ড হন তরুণ ওপেনার। গত বিপিএলে বরিশালের শিরোপা জয়ে বড় ভূমিকা রাখা ক্যারিবিয়ান অলরাউন্ডার পরে নিজের বলে ক্যাচ নিয়ে ফেরান রাজশাহীর পাকিস্তানি ওপেনার মোহাম্মদ হারিসকে।
২৫ রানে রাজশাহী হারায় ২ উইকেট।
এনামুল-ইয়াসিরের বিশাল জুটি
জোড়া ধাক্কার পর দারুণ ব্যাটিংয়ে দলকে এগিয়ে নেন এনামুল হক ও ইয়াসির আলি। তৃতীয় ওভারে শাহিন শাহ আফ্রিদিকে দারুণ কে ফ্লিক শটে ছক্কায় শুরু করেন এনামুল। রাজশাহী অধিনায়ক পরে নান্দনিক শটে ছক্কায় ওড়ান মেয়ার্স, রিপন মন্ডল ও তানভির ইসলামকেও।
এনামুল ইনিংস গড়েন নিজের চেনা পথেই। তিনটি চার ও চারটি ছক্কার পরও ফিফটি করতে ৪২ বল লাগে তার। ইয়াসিরও ক্রিজে যাওয়ার পরপর একটি ছক্কা মারলেও এরপর একটু মন্থর গতিতে এগোন। ২২ বলে তার রান ছিল ২২। পরে গতি বদলে ঝড়ে বেড়ে ফিফটিতে পৌঁছে যান তিনি ৩৫ বলে।
ফাহিমের টানা দুই বলে চার ও ছক্কার পর আরেকটির চেষ্টায় এনামুল আউট হন ৫১ বলে ৬৫ রান করে। চারটি চারের সঙ্গে তার ইনিংসে ছক্কা পাঁচটি।
ইয়াসিরকে থামাতে পারেনি বরিশাল। শেষ ওভারেও রিপনকে দুটি ছক্কা ও এক চারে শেষ পর্যন্ত ৯৪ রানে অপরাজিত থাকেন তিনি। সাতটি চারের সঙ্গে ছক্কা মারেন তিনি আটটি। টি-টোয়েন্টিতে তার আগের সর্বোচ্চ ছিল ৭৮।
উইকেটশূন্য আফ্রিদি, বিবর্ণ তানভির, বাইরে রিশাদ
বিপিএল অভিষেকে চার ওভারে ৩৩ রান দিয়ে উইকেট শূন্য থাকেন ক্রিকেট বিশ্বের এই সময়ের সেরা পেসারদের একজন শাহিন শাহ আফ্রিদি।
বরিশালের বোলিং আক্রমণের উল্লেখযোগ্য ব্যাপার ছিল, লেগ স্পিনার রিশাদ হোসেনকে বাইরে রেখে বেছে নেয় তারা বাঁহাতি স্পিনার তানভির ইসলামকে। গত বিপিএলে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সের হয়ে কেবল চারটি ম্যাচ খেলতে পেরেছিলেন রিশাদ। এই বছর বাংলাদেশের হয়ে টি-টোয়েন্টিতে রেকর্ড উইকেট শিকার করেছেন তিনি। কিন্তু বিপিএলে তিনি জায়গা পেলেন না একাদশে।
বিপিএলের নিয়মিত পারফরমার তানভির পারেননি এই ম্যাচে সুযোগ কাজে লাগাতে। চার ওভারে পাঁচটি ছক্কা হজম করেন তিনি, উইকেট পাননি একটিও।
জিসান-চমক ও তাসকিনের তোপ
বরিশালের দুই বাঁহাতি ওপেনার তামিম ইকবাল ও নাজমুল হোসেন শান্তর জন্য রাজশাহী ইনিংস শুরু করেন জিসান আলমের অনিয়মিত অফ স্পিন দিয়ে। কাজে লেগে যায় সেই পরিকল্পনা। ইনিংসের প্রথম বলেই শানতকে এলবিডব্লিউ করে দেন জিসান।
শান্তর ১৬৮ ম্যাচের টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় ‘গোল্ডেন ডাক’ এটি।
তাসকিনের বলে একটি ছক্কা মারার পরই আউট হয়ে যান বরিশাল অধিনায়ক তামিম ইকবাল। দুর্দান্ত ফর্মে থাকা পেসার একটু পর বিদায় করেন বিপজ্জনক কাইল মেয়ার্সকে।
চার ওভারে তিন উইকেট হারায় বরিশাল।
মুরাদের জোড়া ছোবল
বিপর্যয়ের মধ্যেও স্বভাবজাত ব্যাটিংয়ে বরিশালকে লড়াইয়ে রাখার চেষ্টা করেন তাওহিদ হৃদয়। তবে সম্ভাবনাময় ইনিংসটি থেমে যায় ২৩ বলে ৩২ রান করে। তার আগেই বিদায় নেন মুশফিকুর রহিম। দুটি উইকেটই নেন তরুণ বাঁহাতি স্পিনার হাসান মুরাদ।
নবম ওভারে বরিশালের রান হয়ে যায় ৫ উইকেটে ৬১।
আফ্রিদির ক্যামিও
ফাহিম আশরাফ ও মোহাম্মদ নাবির আগে শাহিন আফ্রিদিকে ব্যাটিংয়ে পাঠায় বরিশাল। তিন ছক্কায় ১৭ বলে ২৭ রান করে বরিশালের মৃতপ্রায় আশা নতুন প্রাণের সঞ্চার করেন আফ্রিদি।
ম্যাচ জেতানো জুটি
কিছুদিন আগে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে ওয়ানডে সিরিজে দুর্দান্ত পারফর্ম করা মাহমুদউল্লাহ শুরু করেন দারুণভাবে। ফাহিম আশরাফের ব্যাটিংয়ে শুরুতে ছিল একটু জড়তা। আট বলে তার রান ছিল এক। পরে মুরাদকে টানা তিন ছক্কায় তিনি বুঝিয়ে দেন ব্যাটের তেজ। এরপর সেই তার তাপে খাক হয়ে যায় রাজশাহীর সব আশা।
এক পর্যায়ে ৩৫ বলে ৮৪ রান দরকার ছিল বরিশালের। কিন্তু ফাহিম ও মাহমুদউল্লাহ টর্নেডো ব্যাটিংয়ে জিতে যায় বরিশাল। মুরাদের ওই ওভার থেকে আসে ২০ রান, মৃত্যঞ্জয় চৌধুরির এক ওভারে আসে ১৯, লাহিরু সামারাকুনের ওভারে ফাহিমের তিন ছক্কায় রান আসে ২৫।
শেষ পর্যন্ত পাঁচ চার ও চার ছক্কায় ২৬ বলে ৫৬ রান করে ম্যাচের সেরা হন মাহমুদউল্লাহ। সাত ছক্কায় ২১ বলে ৫৪ রানে অপরাজিত থাকেন ফাহিম।
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
দুর্বার রাজশাহী: ২০ ওভারে ১৯৭/৩ (হারিস ১৩, জিসান ০, এনামুল ৬৫, ইয়াসির ৯৪*, বার্ল ৯*; আফ্রিদি ৪-০-৩৩-০, মেয়ার্স ৩-০-১৩-২, ফাহি, ৪-০-৪২-১, রিপন ৪-০-৫৫-০, তানভির ৪-০-৪৪-০, নাবি ১-০-৩-০)।
ফরচুন বরিশাল: ১৮.১ ওভারে ২০০/৬ (শান্ত ০, তামিম ৭, হৃদয় ৩২, মেয়ার্স ৬, মুশফিক ১৩, মাহমুদউল্লাহ ৫৬*, আফ্রিদি ২৭, ফাহিম ৫৪*; জিসান ১-০-৬-১, তাসকিন ৪-০-৩১-৩, মৃত্যুঞ্জয় ৩.১-০-৪৩-০, মুরাদ ৪-০-৪২-২, সামারাকুন ৪-০-৬৪-০, বার্ল ২-০-১৩-০)।
ফল: ফরচুন বরিশাল ৪ উইকেটে জয়ী।
ম্যান অব দা ম্যাচ: মাহমুদউল্লাহ।