Published : 21 Oct 2024, 08:02 PM
“সাকিব ভাই নেই… সাকিব ভাই ছাড়া যে খেলিনি, তা তো না…।”
“সাকিব ভাই থাকলেও আমি সাকিব ভাইয়ের কারণে উইকেট পাই, সাকিব ভাই না থাকলেও সাকিব ভাইয়ের কারণে উইকেট পাই! বিষয়টা এরকম… আসলে খেলি তো আমি!”
“আমাদের দেশে অনেক সময় অনেক কিছুই মুখে মুখে হয়। বিষয়টা হলো যে, অনেকে আছে যে, খারাপ করেও অনেক সময় ট্রল হতে হতেই তারকা হয়ে গেছে।”
ওপরের কথাগুলো দেখে অনেকের কৌতুহল জাগতে পারে। অনেকে বিনোদন পেতে পারেন। কেউ কেউ গভীরে যাওয়ার পথ খুঁজতে পারেন। তবে নিশ্চিতভাবেই সবাই বিস্মিত হবেন, যখন জানবেন, কথাগুলি বলেছেন তাইজুল ইসলাম।
বাংলাদেশের ক্রিকেটে তাইজুল বরাবরই আড়ালের নায়ক। ডাকাবুকো চরিত্র নন তিনি কখনোই। মাইক্রোফোনের সামনে চটকদার বা আকর্ষণীয় বলেও তার পরিচিতি কখনও ছিল না। পারফরম্যান্স ভালো হোক বা মন্দ, পাদপ্রদীপের আলো তাকে স্পর্শ করেছে কমই। তিনি নিজেও সেই আলোয় অবগাহন করার চেষ্টা খুব একটা করেননি। তারকাসুলভ কিছু কখনও তিনি দেখানোর চেষ্টা করেননি বা নিজেকে সেভাবে উপস্থাপন করতে চাননি। নিস্তরঙ্গ ও নির্বিরোধী চরিত্রের এবং মৃদুভাষী হিসেবে তাকে চেনেন সবাই। সেই তাইজুলের অন্য রূপ দেখা গেল এবার।
দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে মিরপুর টেস্টের প্রথম দিনে ব্যাটিংয়ে ১০৬ রানে গুটিয়ে গিয়েও যে বাংলাদেশের আশা টিকে আছে, এটির মূল কারণ তাইজুলের বোলিং। ২০০ টেস্ট উইকেট পূর্ণ করার দিনে ৫ উইকেট নিয়েছেন তিনি। এসব নতুন কিছু নয়। দেশের মাঠে টেস্ট হলে এই চেহারায় তাকে দেখা যায় নিয়মিতই। কিন্তু তাকে অন্যভাবে দেখা গেল দিন শেষে সংবাদ সম্মেলনে।
তার কথায় বারবার হাসির রোল উঠল কক্ষে। তার কথার ধরনে অবাক হয়ে পরস্পরের দিকে মুখ চাওয়া-চাওয়ি সংবাদকর্মীদের অনেকেই। একটু বাঁকা চোখে দেখলে তার কিছু কথায় বিতর্কের উপকরণও মিলতে পারে। কিছু কথায় বিনোদনের খোরাক তো নিশ্চিতভাবেই আছে।
সেসব কথার অনেকগুলো জুড়ে থাকলেন সাকিব আল হাসান। ক্যারিয়ারজুড়েই অবশ্য এই নামটি তাইজুলের সঙ্গে জুড়েই ছিল বরাবরই।
তাইজুলের অভিষেক থেকে শুরু করে এই ১০ বছরে দেশের বাইরে যে ২৯ টেস্ট খেলেছে বাংলাদেশ, এর ১৫টিতেই ছিলেন না তিনি। কারণ, একজন সাকিব যে ছিলেন! দেশের বাইরে যখন এক স্পিনার নিয়ে খেলেছে বাংলাদেশ, অবধারিতভাবেই সাকিব ছিলেন প্রথম পছন্দ। পরে আরেক অলরাউন্ডার মেহেদী হাসান মিরাজের আবির্ভাবে তাইজুলের সুযোগ কমে আসে আরও।
দেশের মাঠে তাকে সেই সমস্যায় পড়তে হয়নি। তার অভিষেকের পর থেকে বাংলাদেশের মাঠে ৩৫ টেস্টের ৩৪টিতেই ছিলেন তিনি।
এই যে থাকা এবং না থাকা, গোটা প্রক্রিয়ায় বারবারই সাকিবের নাম এসেছে। তাইজুলকে অসংখ্যবার এই সংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়েছে। এবার যখন সাকিবের টেস্ট ক্যারিয়ার শেষ বলেই মনে হচ্ছে এখন, তখনও তার প্রসঙ্গ বারবারই এলো তাইজুলের সংবাদ সম্মেলনে। তার উত্তরগুলো হলো বেশ চমকপ্রদ।
প্রথম প্রশ্নটিই ছিল সাকিবের না থাকায় তাইজুলের ভূমিকার সম্ভাব্য বদল নিয়ে। তার উত্তরটায় মিশে থাকল নানা রঙের খেলা।
“সাকিব ভাই নেই… সাকিব ভাই ছাড়া যে খেলিনি, তা তো না। উনি থাকা পর্যন্তও অনেক ম্যাচে আমরা অনেক ম্যাচ সাকিব ভাইকে ছাড়া খেলেছি। আমরা যখন নিউ জিল্যান্ডে টেস্ট জিতেছি, সাকিব ভাই ছিলেন না। নিউ জিল্যান্ডের সঙ্গে যখন এখানে টেস্ট জিতেছি, সাকিব ভাই ছিলেন না। এরকম অনেক উদাহরণ আছে।”
“আসলে আপনি তো একজন খেলোয়াড়কে ৫০ বছর খেলাতে পারবেন না। কখনও একজন আসবে, একজন যাবে। ১০ বছর, ১৫ বছর, খুব বেশি হলে ২০ বছর… এটা আমাদের মেনে নিতেই হবে। আসলে সন্দেহ নেই উনি অনেক ভালো ক্রিকেটার ছিলেন। তবে আমরা দোয়া করব, আপনারাও দোয়া করবেন, উনার মতো যেন আরেকজন যেন আসে। এখন যারা আছে তারাও যেন ভালো পারফর্ম করে।”
দেশের মাঠে টেস্ট ক্রিকেটে তাইজুল বরাবরই দলের সেরা পারফরমারদের একজন। তবু যে তিনি তারকাখ্যাতি খুব একটা পাননি বা আলোচনার ঝড় সেভাবে তুলতে পারেননি, সেই প্রসঙ্গে কিছুটা অভিমান যেমন তার কণ্ঠে ফুটে উঠল, তেমনি তুলে ধরলেন এই দেশের বাস্তবতাও।
“আসলে আমাদের দেশে সত্যি কথা বলতে কী… অনেক সময় অনেক কিছুই মুখে মুখে হয়। বিষয়টা হলো যে, অনেকে আছে যে, খারাপ করেও অনেক সময় ট্রল হতে হতেই তারকা হয়ে গেছে। আবার অনেকে ভালো খেলেও তারকা হতে পারেনি। আমি এটা মেনে নিয়েছি। মেনে নেওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই।”
ক্রিকেটীয় বাস্তবতার কথাও তিনি মনে করিয়ে দিলেন। শেন ওয়ার্নের মতো কিংবদন্তি থাকায় স্টুয়ার্ট ম্যাকগিল যেমন পর্যাপ্ত খেলার সুযোগ পাননি, একজন মুত্তাইয়া মুরালিদারান থাকায় রাঙ্গানা হেরাথকে অপেক্ষা করতে হয় বছরের পর বছর, এমন উদাহরণ তুলে ধরে নিজেকেই যেন সান্ত্বনা দিলেন কিছুটা।
“বঞ্চিত বলতে…বঞ্চিতের এখানে কিছু নেই। বিশ্বের অনেক বড় বড় খেলোয়াড় আছে, তারা যখন খেলেছে… অনেক উদাহরণ আছে। যখন মুরালিদারান ছিল, ওই সময় কিন্তু রাঙ্গানা হেরাথ খেলতে পারেনি। হেরাথ যখন এসেছে, তখন অনেক উইকেট পেয়েছে এবং লম্বা সময় খেলেছে। আমিও সামনে দেখি ভালো কিছু হয় নাকি…।”
“ক্যারিয়ার যে খুব খারাপ আছে, তা বলব না। ক্যারিয়ার খুব ভালো আছে। সব কন্ডিশনে সবসময় আপনি তিনটা স্পিনার খেলাতে পারবেন না। অনেক জায়গায় একটি স্পিনারই খেলাতে হবে। আমার মনে হয়, এরকম কখনও হয়নি যে, তিনটা স্পিনার খেলানো দরকার, সেখানে একজন বা দুইজন খেলিয়েছে। তবে কোনো সময় দলের ভেতরে, কোনো সময় বাইরে থাকতে হয়েছে। আমার যতদিন দিনের ক্যারিয়ার সে জায়গা থেকে আরও বেশি ম্যাচ খেলা উচিত ছিল। সে জায়গা থেকে হয়নি আর কী।”
সাকিবের থাকা বা না থাকা নিয়ে বারংবার প্রশ্নে কিছুটা আক্ষেপ যেমন করলেন, পরমুহূর্তে আবার তা উড়িয়েও দিলেন।
“সাকিব ভাই থাকলেও আমি সাকিব ভাইয়ের কারণে উইকেট পাই, সাকিব ভাই না থাকলেও সাকিব ভাইয়ের কারণে উইকেট পাই! বিষয়টা এরকম… আসলে খেলি তো আমি…।”
“যাই হোক, সত্যি বলতে কী, কোনো সময় আক্ষেপের কিছু নেই। বড় বড় খেলোয়াড়দের সঙ্গে খেলেছি এটাও একটা আনন্দের বিষয়। তাদের সঙ্গে অনেক কিছু শেয়ার করা… সেটা যেই হোক। তাদের যে অভিজ্ঞতা আছে… তামিম ভাই বলেন, সাকিব ভাই, মুশফিক ভাই , রিয়াদ ভাই ছিলেন… একজন অভিজ্ঞ খেলোয়াড়ের কাছ থেকে নেওয়ার মতো অনেক কিছুই আছে, যদি তার সঙ্গে আলোচনা করা যায়। আমি চেষ্টা করি সেসব করার।”
২০০ উইকেটের প্রশ্নে অবশ্য চিরায়ত সেই তাইজুলকেই পাওয়া গেল। টেস্ট ইতিহাসে এই মাইলফলক এখন আর বড় কিছু নয়। এই মিরপুর টেস্টের প্রথম দিনেই কাগিসো রাবাদাকে দিয়ে ৩০০ উইকেট শিকারি বোলার এখন ৩৯ জন। তবে বাংলাদেশের বাস্তবায় ২০০ উইকেট মানে অনেক বড়। তার আগে এই অর্জন ছিল কেবল সাকিবেরই।
সাকিবের চেয়ে ৬ টেস্ট কম খেলেই এই ঠিকানায় পৌঁছেছেন তাইজুল। কিন্তু সেই অর্জনের উচ্ছ্বাস ততটা নেই তার।
“অবশ্যই ভালো লাগার বিষয়। বিশ্বে অনেক বোলারই আছে, যাদের ২০০ উইকেট আছে বা ৩০০–৪০০ আছে। আমাদের বাংলাদেশে হয়তো… আমরা অত দিন টেস্ট খেলি না যে অনেক জনের হবে। তারপরও যে দুই–একজন আছে, তার মধ্যে আমি একজন। এটা গর্বের কোনো বিষয় নয়। আল্লাহ দিয়েছেন, হয়েছে।”