বিপিএল ফাইনালে টিকেটের হাহাকার, রমরমা কালোবাজারি

রাত ৩টায় লাইনে দাঁড়িয়ে দুপুর ১২টা পর্যন্ত অপেক্ষা করেও টিকেট পাননি কেউ কেউ, অনলাইনে পেমেন্ট নিশ্চিত করেও কাউন্টার থেকে টিকেট না পাওয়ার অভিযোগ আছে অনেকের।

ক্রীড়া প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 March 2024, 12:24 PM
Updated : 1 March 2024, 12:24 PM

‘দেখলেন ভাই, কাউন্টারে সাইনবোর্ড ঝোলানো যে টিকেট নেই, কিন্তু বাইরে ঠিকই পাওয়া যাচ্ছে’- হতাশাভরা কণ্ঠে বললেন কলেজপড়ুয়া তাশরিফ হোসেন। তারা তিন বন্ধু এসেছিলেন বিপিএলের ফাইনাল দেখতে। কিন্তু টিকেট না থাকায় অনেকটাই অনিশ্চিত হয়ে পড়ে তাদের মাঠে প্রবেশ করা।

মিরপুর শের-ই বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামের এক নম্বর গেট সম্বলিত টিকেট কাউন্টারে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে, ‘বিপিএল ফাইনালের টিকেট ইনডোর স্টেডিয়ামে পাওয়া যাবে।’ কাউন্টারের আশপাশে হাঁটতে দেখে এক ব্যক্তি ৩০০ টাকা মূল্যের ইস্টার্ন গ্যালারির টিকেট বিক্রি করতে চাইলেন ১ হাজার ২শ টাকায়।

এত টাকা খরচ করার সাধ্য নেই তাই মুখ কালো করে এদিক-সেদিক হাঁটতে লাগলেন তাশরিফ ও তার বন্ধুরা। স্টেডিয়ামে প্রাঙ্গনে শুক্রবার সকাল থেকেই এই তিন বন্ধুর মতো হাজার হাজার মানুষের ভিড় দেখা যায়।

বিপিএল ফাইনালে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স ও ফরচুন বরিশালের লড়াই শুরুর আগে স্টেডিয়াম এলাকার সার্বিক চিত্র ছিল এমনই। কেউ অনেক প্রতীক্ষার পর পেয়েছেন টিকেট, কেউ টিকেটের জন্য ঘুরছেন হন্যে হয়ে। কালোবাজারির অভিযোগ প্রায় সবার মুখে মুখে। মাঠের চারপাশে ঘুরে সেসবের সত্যতাও মিলেছে বেশ কয়েক দফায়।

মিরপুরের পূরবী থেকে পরিবার নিয়ে খেলার দেখার আশায় স্টেডিয়ামে আসা সাইফুল ইসলাম ক্ষোভ ঝারলেন টিকেট নিয়ে বিড়ম্বনায়।

“সেই ছাত্রজীবন থেকে শুরু করে কমপক্ষে একশ ম্যাচ দেখেছি এই মাঠে বসে। টিকেট নিয়ে সমস্যা আগেও অনেকবার দেখেছি। কিন্তু প্রতিবারই ব্যবস্থা করতে পেরেছি। এবার কোথাও টিকেট পাচ্ছি না। মনে হচ্ছে বাসায় টিভিতেই খেলা দেখতে হবে।”

সাইফুলের মতো টিকেটপ্রত্যাশী মানুষের ভিড় দেখা যায় স্টেডিয়ামের বিভিন্ন গেটে। সকাল থেকেই দেখা যায় দর্শক সমাগম। তাদের অনেকের টিকেট থাকলেও, টিকেটপ্রত্যাশী দর্শকই যেন বেশি ছিল এলাকাজুড়ে।

গভীর রাত থেকে লাইনে দাঁড়িয়েও টিকেট না পাওয়ার ঘটনা ঘটেছে শহীদ সোহরাওয়ার্দী ইনডোর স্টেডিয়ামের বুথে। সে কথাই বলছিলেন মিরপুর ৬ এলাকার বাসিন্দা আলিম হোসেন।

“রাত ৩টায় এসে লাইনে দাঁড়িয়েছিলাম আমি। দুপুর ১২টা পর্যন্ত লাইনে ছিলাম। তবু টিকেট পেলাম না। কয়েকবার মারামারি লেগে গিয়েছিল লাইনে। ভয়ে ভয়েই ছিলাম। শেষ পর্যন্ত আর ধৈর্যে কুলায়নি। তাই বাসায় চলে গিয়েছিলাম। এখন দেখছি অন্য কোনো ব্যবস্থা হয় কিনা।”

আলিমের মতো টিকেটপ্রত্যাশীদের জন্য এই ‘অন্য ব্যবস্থা’ মূলত কালোবাজারিদের কাছ থেকে কেনা। ইনডোর কিংবা শের-ই বাংলার বিভিন্ন গেটের সামনে কালোবাজারিদের দৌরাত্ম্য দেখা গেছে প্রকাশ্যেই। ৩শ টাকার টিকেট ১২শ, ৮শ টাকার টিকেট ৩ হাজার টাকায়ও বেচা-কেনা হয়েছে দেদার।

কালোবাজারির মজার এক ঘটনাও দেখা যায় ইনডোর স্টেডিয়ামের সামনে। এক ব্যক্তি ক্লাব হাউজের ৮শ টাকা টিকেট বিক্রি করছিলেন ২ হাজার টাকায়। কেউ একজন তাকে বলেন, শের-ই বাংলায় তো ৮শ টাকার টিকেট ৩ হাজার টাকায়ও পাওয়া যাচ্ছে না। সঙ্গে সঙ্গে ইনডোর স্টেডিয়ামের সামনের ওই ব্যক্তিও বাড়িয়ে দেন তার কাছে থাকা টিকেটের মূল্য।

টিকেটের উৎস সম্পর্কে জানতে চাইলে আমতা-আমতা করতে থাকেন ওই ব্যক্তি। একবার বলেন, কাউন্টার থেকে দীর্ঘ সারিতে দাঁড়িয়ে পেয়েছেন টিকেট। পরে আবার বলেন, টিকেট কীভাবে পেয়েছেন সেই তথ্য দেওয়া যাবে না।

কালোবাজারিদের নিজেদের মধ্যে মারামারির ঘটনাও ঘটেছে স্টেডিয়ামের এক নম্বর গেটের কাছে। টিকেট ভাগাভাগি নিয়ে শুরুতে কথা কাটাকাটি, পরে হাতাহাতি শুরু করেন দুজন। পরে পুলিশ এসে তাদের উত্তম-মধ্যম দিয়ে স্টেডিয়াম এলাকা থেকে বিদায় করেন।

শুধু কালোবাজারি নয়, অনলাইনে পেমেন্ট করে টিকেট নিশ্চিত করার পরও কাউন্টার থেকে সেটি সংগ্রহ করতে না পারার অভিযোগও মিলেছে কয়েকজনের কাছ থেকে।

দুপুরের পর ইনডোর স্টেডিয়ামের বুথে অনলাইনে কাটা টিকেট দেওয়া হয়েছে কিছু। কিন্তু ভিড় ঠেলে নিজের টিকেট সংগ্রহ করতে না পেরে হতাশ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় সায়েম হোসেনকে। তার মতোই আরেকজন, আব্দুল্লাহ আল মুয়িদ শোনালেন তার হতাশার অভিজ্ঞতা।

“অনেক শখ করে গ্র্যান্ড স্ট্যান্ডের টিকেট করেছিলাম অনলাইনে। সার্ভিস চার্জ দিলাম। গতকালকে অফিস বাদ দিয়ে সকালে কাউন্টারে এসে দেখি মারামারি চলছে। অফিস শেষ করে আবার এসেছি ৬টায়, এবার দেখি কাউন্টারে কেউ নেই। পুরো টাকাটাই লস। অনলাইনে টিকেট কেটেও তো শান্তি নেই।”

অনলাইনে টিকেট কেটে সেটি সংগ্রহ করতে না পারার অভিযোগ ছিল প্রথম কোয়ালিফায়ার ম্যাচেও। ফাইনালেও যেন বদলায়নি সেই চিত্র। অনলাইনে টিকেট করেও যদি সেই টিকেট কাউন্টার থেকে সংগ্রহ করার ঝামেলা পোহাতেই হয়, তাহলে এই অনলাইনে করে লাভ কি, এই প্রশ্ন তুললেন অনেকেই।

টিকেটের অব্যবস্থাপনার অভিযোগের বিষয়ে বিপিএল গভর্নিং কাউন্সিলের চেয়ারম্যান শেখ সোহেল ও বিসিবি প্রধান নির্বাহী নিজামউদ্দিন চৌধুরিকে কয়েকবার ফোন করেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

অনেক অভিযোগ ও নেতিবাচক ঘটনার মাঝেও টিকেট পাওয়া দর্শকদের মাঝে উচ্ছ্বাস দেখা যায় স্পষ্ট। পছন্দের দলের নামে স্লোগান ও আনন্দ-উল্লাস করতে করতে মাঠে প্রবেশ করেন তারা।

ম্যাচ শুরুর দুই ঘণ্টা আগে দর্শক প্রবেশের নির্দেশনা থাকলেও, নির্ধারিত সময়ের ৪৫ মিনিট আগে খুলে দেওয়া হয় সব গেট। টসের আগেই প্রায় পুরোটা ভরে ওঠে শের-ই বাংলার গ্যালারি। তখনও স্টেডিয়ামের বাইরে দেখা যায় দর্শকের ঢল।