স্বপ্ন ছিল ১০০ টেস্ট খেলার, কিন্তু এখন তার চাওয়া সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবন কাটানো, ক্রিকেটকেই তাই বিদায় বলে দিলেন প্রতিভাবান ব্যাটসম্যান।
Published : 08 Apr 2025, 11:44 AM
সবশেষ ম্যাচটি খেলার ১৩ মাস পেরিয়ে গেছে। উইল পুকোভস্কি বললেন, সেটিই আসলে শেষ। ক্রিকেটার হিসেবে মাঠে নামার দিন আর কখনও ফিরে আসবে না তার জীবনে। কোনো পর্যায়ের ক্রিকেটেই আর খেলবেন না। বারবার কনকাশনে আক্রান্ত হয়ে নানা সময়ে আলোচনার জন্ম দেওয়া অস্ট্রেলিয়ান ব্যাটসম্যান অবশেষে হার মানলেন অসুস্থতার সঙ্গে।
স্বপ্ন ছিল তার ১০০ টেস্ট খেলার। তার মধ্যে সেই সম্ভাবনাও দেখছিলেন অনেকে। একসময় তাকে মনে করা হয়েছে অস্ট্রেলিয়ান ব্যাটিংয়ের ভবিষ্যৎ। কিন্তু সেই স্বপ্নের পথচলা শেষ হয়ে গেল স্রেফ একটি টেস্ট খেলেই।
চিকিৎসকদের পরামর্শেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে জানালেন ২৭ বছর বয়সী ব্যাটসম্যান। সেই পরামর্শ অবশ্য এসেছে বছর খানেক আগেই। তবু স্বপ্নটাকে জিইয়ে রাখতে সময় নিয়েছেন তিনি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিয়তি মেনে নিতেই হয়েছে তাকে।
মেলবোর্নে মঙ্গলবার এসইএন রেডিওতে নিজের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দেন পুকোভস্কি।
“ভালো লাগত, যদি আরও ভালো পরিস্থিতির মধ্যে আসতে পারতাম। কিন্তু বাস্তবতা হলো, আমি আর কখনও ক্রিকেট খেলব না। যতটা সম্ভব সাধারণ করে বললে, এই এক বছর ছিল খুবই কঠিন।”
“এই পথচলার পুরোটা তুলে ধরতে আসলে কয়েক ঘণ্টা লেগে যাবে… তবে ছোট্ট ও সাধারণ বার্তাটি হলো যে, কোনো পর্যায়ের ক্রিকেটেই আমি আর খেলব না।”
বয়সভিত্তিক ক্রিকেট থেকেই পুকোভস্কিকে মনে করা হয়েছে দারুণ সম্ভাবনাময় একজন। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে পারফর্মও করেছেন। সেই পথ ধরে ২০২১ সালে ভারতের বিপক্ষে সিডনিতে তার টেস্ট অভিষেক। প্রথম ইনিংসেই তার ব্যাট থেকে আসে ৬২।
কিন্তু ওই টেস্টেই ফিল্ডিংয়ের সময় কাঁধে চোট পেয়ে মাঠ ছাড়তে হয় তাকে। এরপর আর কোনো টেস্ট খেলতে পারেননি। কনকাশন নামক শত্রু যে পিছু ছাড়েনি কখনোই!
বয়সভিত্তিক ক্রিকেট থেকেই নানা পর্যায়ের ক্রিকেটে কনকাশনের শিকার হতে হয়েছে তাকে। পুকোভস্কির হেলমেটে কত বার বল লেগেছে, এই হিসাব রাখাও একসময় কঠিন হয়ে পড়ে। সবশেষটি ছিল গত বছরের মার্চে। ভিক্টোরিয়ার হয়ে হোবার্টে শেফিল্ড শিল্ডের ম্যাচে তাসমানিয়ার রাইলি মেরেডিথের বাউন্সার ছোবল দেয় তার হেলমেটে। সেই যে মাঠ ছাড়লেন, সেটিই হয়ে রইল তার শেষ।
অথচ ওই মৌসুমটি তার জন্য ছিল আশা জাগানিয়া। প্রথম শ্রেণির ক্যারিয়ারে সবচেয়ে বেশি ম্যাচ খেলেছিলেন সেবারই। ওই ম্যাচের ঠিক আগের ম্যাচেই সিডনিতে নিউ সাউথ ওয়েলসের বিপক্ষে খেলেছিলেন ১৩১ রানের ইনিংস।
পুকোভস্কি নিজেও নতুন আশার পথে ছুটেছিলেন তখন। কিন্তু সময় তাকে বুঝিয়ে দিয়েছে পরিণতি।
“সিডনিতে ওই সেঞ্চুরির পর, ব্যক্তিগত দিক থেকে মনে হয়েছিল, সবকিছু আমার জন্য ভালো হয়ে উঠছে। মাঠের ভেতরে সবকিছু ঠিকঠাক করতে মাঠের বাইরে আমাকে প্রবল প্রচেষ্টা করতে হয়েছিল।”
“অস্ট্রেলিয়ার হয়ে খেলা ছিল আমার সবসময়ের স্বপ্ন। ২০২১ সালে নিজেকে সেই জায়গায় দেখতে পেয়েছিলাম। আমার স্বপ্ন সেখানেই থেমে যায়নি। ব্যাটিং ইউনিটের নেতা হতে চেয়েছিলাম আমি, চেয়েছিলাম ১০০ টেস্ট খেলতে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এক টেস্টেই সব শেষ হয়ে গেল।”
মেরেডিথের বলে ওই আঘাতের পর লম্বা সময় স্বাভাবিক জীবনযাপনই করতে পারেননি তিনি।
“ওই ঘটনার পর (সবশেষ কনকাশন) মাস দুয়েক সবকিছু করতেই ধুঁকতে হয়েছে আমাকে। বাড়ির আশেপাশে হাঁটাও ছিল কষ্টের ব্যাপার। আমার বাগদত্তা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিল, কারণ দৈনন্দিন কাজ সেভাবে করতে পারছিলাম না, প্রচুর ঘুমাচ্ছিলাম।”
“সেখান থেকে পরের এক বছর ছিল খুবই কঠিন। অনেক লক্ষণই রয়ে গেছে, সেসব কারণেই এই সিদ্ধান্ত (অবসর) আমাকে নিতে হয়েছে। প্রথম কয়েক মাস (আঘাতের পর) ছিল ভয়াবহ। এরপর একটু উন্নতি হলেও সবকিছু ঠিক হয়নি।”
পুকোভস্কি জানালেন, চিকিৎসা বিজ্ঞানও তার সমস্যা পুরোপুরি বুঝতে বা সমাধান করতে পারেনি। চিকিৎসকরা তাকে গত বছরই পরামর্শ দিয়েছিলেন খেলা ছেড়ে দেওয়ার। কিন্তু নিজেকে বোঝাতে সময় লেগেছে তার।
“বয়স মাত্র ২৭ পূর্ণ হলো আমার, কনকাশনের জায়গাটি খুব তাজা। অনেক বিশেষজ্ঞের সঙ্গে আলাপ করে বুঝেছি, এই জায়গাটা সামলানো খুব কঠিন। আসল ব্যাপারটি কী, প্রযুক্তির মাধ্যমেও সেটি বোঝা যাচ্ছে না। এক বছরের বেশি সময় ধরে যদি লক্ষণ চলতেই থাকে… আগেও অনেক বছরে অনেক লক্ষণ তো ছিলই… এরপর আসলে পেশাদার খেলা চালিয়ে যাওয়ার উপায় নেই, যেখানে আমি নিজের মতো করে প্রাত্যহিক জীবন কাটাতেই ভুগছি।”
“আমার ভাবনা ছিল, সব লক্ষণ থেকে মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দিতে চাই না। ভোগান্তির সময়টায় এত বড় সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন। মেডিকেল প্যানেল সুপারিশ করেছিল অবসর নিতে এবং সেই বাস্তবতার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া আমার জন্য ছিল কঠিন। মনে হচ্ছিল, কিছু ব্যাপারের সঙ্গে মানিয়ে নিতেই পারব না।”
নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া করতে করতে একটা সময় তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছেন, সুস্থ স্বাভাবিক জীবনের জন্য হলেও খেলা চালিয়ে যাওয়ার স্বপ্নকে বলি দিতেই হবে।
“টেকনিক্যালি, কাউকে কোনো কিছু থেকে অবসর নেওয়ানো যায় না… আমাকে খুব শক্তভাবে সুপারিশ করা হয়েছিল বটে, তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত তো আমার ওপরই ছিল। এরপর থেকে আমি অবিশ্বাস্যরকমের সময় ধরে চেষ্টা করেছি উত্তর খুঁজতে, আমার মস্তিষ্কের এই চোট সংক্রান্ত ব্যাপারগুলো বোঝার চেষ্টা করেছি, কেন আমার এত সমস্যা হচ্ছে। তখনও একবারও মনে হয়নি, আজকেই সেই দিন (অবসর নেওয়ার)।”
“তবে পরিস্থিতি বদলায়নি। চেয়েছিলাম স্বপ্নটা (খেলা চালিয়ে যাওয়ার) যতদিন সম্ভব ধরে রাখতে। কিন্তু উল্টো দিকও ভাবতে হয়েছে যে, সবাই ভালো অনুভব করতে চায় এবং স্বাভাবিক জীবন কাটাতে চায়। মস্তিষ্কের যে ক্ষতিটা এর মধ্যেই করে ফেলেছি, এর বেশি আর করতে চাই না।”
খেলা ছেড়ে দিলেও কনকাশনের প্রভাব তাকে সহসাই ছেড়ে যাবে না। তবে একটা সময় মুক্তি পাবেন, সেই আশাতেই ক্রিকেটকে বিদায় বলেছেন বুকে পাথর চাপা দিয়ে।
“ব্যাপারটি বেশ জটিল। মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাপারটি তো আছেই, পাশাপাশি অবসাদের ব্যাপারও আছে, যা বেশ বাজে। নিয়মিত মাথা ব্যথাও হয় আমার। বাঁ পাশের যে কোনো কিছু করতেই আমাকে ভুগতে হয়। আমার বাঁ দিকে যদি কিছু হতে থাকে, তখন আমার অসুস্থ লাগে, মাথা ঝিমঝিম করে। ‘মোশন সিকনেসে’ ভুগতে থাকি।”
“আমার বয়স কেবল ২৭। এত সময় আমার সামনে পড়ে আছে এবং জীবনে এত কিছু অর্জন করতে চাই… চেয়েছিলাম, আরও ১৫ বছর খেলতে, সেটা জীবন থেকে কেড়ে নেওয়া হলো, যা বেশ বাজে। তবে অন্তত এটুকু জানি যে, মাথায় আর আঘাত পাব না। তবে লক্ষণগুলো যখন ফিরে আসে, খুবই ভীতিকর ব্যাপার সেটি। এই কনকাশনগুলোর আগে কেমন ছিলাম আর এখন কেমন আছি, সেটা তো জানিই। আমার পরিবার ও বন্ধুরাও সেই পার্থক্য দেখতে পেয়েছে। আমার জন্য ও তাদের জন্য ব্যাপারটি ভয়ের।”
সাত বছরের প্রথম শ্রেণির ক্যারিয়ারে কনকাশনের কারণেই খুব বেশি ম্যাচ তার খেলা হয়নি। তবে যতটুকু খেলেছেন, সম্ভাবনার ছাপ রেখেছেন অনেকবার। ৩৬ ম্যাচে সেঞ্চুরি করেছেন সাতটি। ২ হাজার ৩৫০ রান করেছেন ৪৫.১৯ গড়ে। সর্বোচ্চ ইনিংসটি ২৫৫ রানের।
লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেটে ১২ ইনিংস খেলে সেঞ্চুরি একটি, ফিফটি দুটি।
খেলা ছেড়ে দিলেও অবশ্য প্রিয় ক্রিকেটকে তিনি ছাড়ছেন না। আগামী মৌসুমে ভিক্টোরিয়া প্রিমিয়ার ক্লাব মেলবোর্নের প্রধান কোচের দায়িত্ব নিশ্চিত করেছেন এর মধ্যেই। খেলোয়াড়ি জীবনের ফাঁকেই নানা সময়ে টিভিতে ধারাভাষ্য দিয়েছেন। সেখানেও ফিরতে পারেন কোনো একটা পর্যায়ে।