ইবাদত হোসেনের বলে স্লগ করার চেষ্টায় ব্যাটে-বলে হলো না। বল ছোবল দিল স্টাম্পে। অবশেষে আউট হ্যারি টেক্টর! বাংলাদেশের সমর্থকে ভরা গ্যালারিতে উচ্ছ্বাসের রোল উঠল। মুহূর্ত পরে সেই দর্শকেরাই উঠে দাঁড়ালেন। আয়ারল্যান্ডের ড্রেসিং রুমের সামনে টেক্টরের সতীর্থরা, মাঠের গুটিকয় আইরিশ সমর্থকেরাও তখন দাঁড়িয়ে। কারও তালি যেমন থামছিল না। এরকম একটি ইনিংসের এমন অভিবাদনই তো প্রাপ্য!
১১৩ বলে ১৪০ রান। ৭ চারের সঙ্গে ছক্কা ১০টি। কতটা বিধ্বংসী ইনিংস, অনেকটা বোঝা যায় এই সংখ্যাগুলোতেও। তবু যেন ফুটে ওঠে না সবটা। সপ্তম ওভারে উইকেটে যাওয়ার পর থেকে যেভাবে খেলেছেন টেক্টর, সেটির নাম হতে পারে দাপট। বাংলাদেশের বোলিংকে পিষ্ট করা!
২৩ রানে একবার জীবন পেয়েছিলেন বটে। তবে ভুল শট এছাড়া খুব একটা খেলেননি তিনি। বরং তার দাপুটে ব্যাটিংয়ের সামনে ভুগেছে বাংলাদেশের বোলিং। একটা পর্যায়ে তো তার সামনে বল খেলার জায়গাই পাচ্ছিলেন না কোনো বোলার।
এই পরিক্রমায় নিজের নাম লিখিয়েছেন তিনি রেকর্ড বইয়েও। আয়ারল্যান্ডের প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে এক ওয়ানডেতে ছক্কা মেরেছেন ১০টি।
এই ম্যাচেই যার সঙ্গে শতরান ছুঁইছুঁই জুটি গড়েছেন টেক্টর, সেই অ্যান্ড্রু বালবার্নির ছিল আগের রেকর্ড। ২০১৯ সালে আফগানিস্তানের বিপক্ষে ১৪৫ রানের ইনিংসের পথে ৮টি ছক্কা মেরেছিলেন এখনকার আইরিশ অধিনায়ক।
টেক্টরের রেকর্ড শেষ নয় এখানেই। বাংলাদেশের বিপক্ষে আয়ারল্যান্ডের সর্বোচ্চ ওয়ানডে ইনিংসও এখন এটিই। অতীত হয়ে গেছে ২০১৯ সালে পল স্টার্লিংয়ের ১৩০ রান।
বয়স তার মোটে ২৩। এখনও ৩০ ওয়ানডে ইনিংসের অভিজ্ঞতাও নেই। অথচ এখনই তাকে এই সময়ে আয়ারল্যান্ডের সেরা ব্যাটসম্যান বললে দ্বিমত করার লোক খুব বেশি মিলবে না। আইরিশ ব্যাটিংয়ের ভবিষ্যৎ তাকে বলা হচ্ছিল বেশ আগে থেকেই। এখন তাকে ‘বর্তমান’ বললেও বাড়িয়ে বলা হয় না খুব একটা।
বাংলাদেশের বিপক্ষে এই ইনিংসটি তার ২৯ ওয়ানডের ক্যারিয়ারের চতুর্থ সেঞ্চুরি। এই চারটি সেঞ্চুরিই করলেন সবশেষ ৯ ম্যাচের মধ্যে!
গত এক বছরে তার চেয়ে বেশি ওয়ানডে সেঞ্চুরি করতে পারেননি বিশ্ব ক্রিকেটে আর কোনো ব্যাটসম্যান। তার সমান করেছেন অবশ্য আরও পাঁচ জন।
ক্যারিয়ারের প্রথম ১০ ওয়ানডে ইনিংসে তিনি ৩৫ ছুঁতেও পারেননি একবার। পরের ১৯ ইনিংসে ৪ সেঞ্চুরির সঙ্গে ফিফটি ৮টি। এই ধারাবাহিকতা অবিশ্বাস্য নয় তো কী!
এমন নয় যে আয়ারল্যান্ডের কাছাকাছি মানের দলগুলির সঙ্গেই কেবল রান করেছেন। নেদারল্যান্ড, জিম্বাবুয়ের সঙ্গে যেমন রানের দেখা পেয়েছেন, তেমনি দারুণ কয়েকটি ইনিংস খেলেছেন প্রথাগত বড় দলগুলির বিপক্ষেও। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ঐতিহাসিক জয়ের ম্যাচে খেলেন ৬৮ বলে ৭৯ রানের ইনিংস। ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে তিন ওয়ানডের প্রতিটিতেই করেন ফিফটি।
গত জুলাইয়ে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজের প্রথম ম্যাচে প্রথম ওয়ানডে সেঞ্চুরির স্বাদ পান ১৩ চার ও ৪ ছক্কায় ১১৩ রানের ইনিংস খেলে। ওই সিরিজের শেষ ম্যাচে দ্বিতীয় শতরানের দেখাও পেয়ে যান! এবার ৭ চার ও ৫ ছক্কায় ১০৬ রান। কিউইদের ৩৬০ রান তাড়ায় অবিশ্বাস্যভাবে জয়ের সম্ভাবনা জাগিয়ে পরে স্রেফ ১ রানে হারে আইরিশরা।
সেই ধারাবাহিকতা ধরে রেখে পরের সিরিজে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে করেন অপরাজিত সেঞ্চুরি। পরের ম্যাচে ৬১ বলে ৭৫।
ধারাবাহিকতায় ছেদ পড়ে সবশেষ বাংলাদেশ সফরে। গত মার্চে সিলেটে ওই সিরিজে দুই ম্যাচে ব্যাট করে তিনি ফেরেন স্রেফ ৩ ও শূন্য রানে। আয়ারল্যান্ডের জন্যও ছিল সেটি বড় ধাক্কা। এমনিতে আগের অমন অসাধারণ ধারাবাহিকতার পর কয়েকটি ইনিংসে রান না পাওয়াটা ক্রিকেটীয় নিয়মে স্বাভাবিক। কিন্তু তার ব্যাটে এখন দলের নির্ভরতা যে প্রবল!
এবার তা পুষিয়ে দেওয়ার পালা। প্রথম ম্যাচে দলের বিপর্যয়ে হাল ধরেন। তবে ইনিংসটিকে পরিণতি দিতে পারেননি বৃষ্টির কারণে। খেলা পরিত্যক্ত হওয়ার সময় অপরাজিত ছিলেন তিনি ২১ রানে। নিজের সেরা চেহারায় ফিরলেন তিনি শুক্রবারের ম্যাচে।
চেমসফোর্ডে এ দিন যখন উইকেটে যান টেক্টর, দুই ওপেনারকে হারিয়ে সপ্তম ওভারে দলের রান তখন মোটে ১৬। বালবার্নিকে নিয়ে সেই ধাক্কা সামাল দেন টেক্টর। প্রথম ছক্কাটি মারেন শরিফুল ইসলামের শর্ট বলে পুল করে।
বালবার্নি যদিও অস্বস্তিতে পড়ছিলেন বারবার। কিন্তু টেক্টর ছিলেন সাবলিল। শুরুতে একটু সময় নেন। এরপর ছুটতে থাকেন তিনি স্বচ্ছন্দে।
একটু পরই খানিকটা ছন্দপতন। ইবাদত হোসেনের শর্ট বলে পুল করে গিয়ে বল তুলে দেন আকাশে। তবে অনেকটা ছুটে গিয়ে শরিফুল তা জমাতে পারেননি হাতে। এতে নিজের করণীয় বুঝে নেন তিনি। পরের কয়েক ওভার একটু সাবধানী ব্যাটিংয়ে ইনিংস গড়ার চেষ্টা করেন।
জ্বলে ওঠেন স্পিন আক্রমণে আসার পর। তাইজুলের এক ওভারে তিন ছক্কায় ফিফটি পূরণ করেন ৫৩ বলে।
এরপর সময়ের সঙ্গে আরও অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠেন। পরের পঞ্চাশ করতে বল লাগে আর কেবল ৪০টি। তাইজুলের বলে সিঙ্গেল নিয়ে শতরানে পা রাখেন ৯৩ বলে।
এর মধ্যে বালবার্নির সঙ্গে তার জুটি থামে ৯৮ রানে। লর্কান টাকার ও কার্টিস ক্যাম্পারও পারেননি খুব বড় জুটি গড়তে। কিন্তু টেক্টর তখন অপ্রতিরোধ্য। জর্জ ডকরেল উইকেটে যাওয়ার পর তো ঝড় ওঠে দুই প্রান্তেই। স্রেফ ৬৮ বলে ১১৫ রানের জুটি গড়েন দুজন।
সেঞ্চুরি ছোঁয়ার পরপরই তাইজুলকে টানা দুটি ছক্কা মারেন টেক্টর। স্পর্শ করেন বালবার্নির ছক্কার রেকর্ড। পরে আরও দুটি ছক্কা মারেন সাকিব আল হাসান ও ইবাদত চৌধুরিকে।
বাংলাদেশের বিপক্ষে এক ওয়ানডে ইনিংসে ১০ ছক্কা মারতে পেরেছেন আর কেবল তিন জন- ইশান কিষান (১০), দিনেশ রামদিন (১১) ও শেন ওয়াটসন (১৫)।
শেষ পর্যন্ত ইবাদতের বলে স্লগ করার চেষ্টায় টেক্টর বোল্ড হন তিন ওভার বাকি থাকতে। ততক্ষণে বড় পুঁজির পথ পেয়ে গেছে আয়ারল্যান্ড।
বৃষ্টিতে ৪৫ ওভারে নেমে আসা ম্যাচে টেক্টরের ক্যারিয়ার সেরা ইনিংসের সঙ্গে ডকরেলের ক্যারিয়ার সেরা ৪৭ বলে ৭৪ রানের অপরাজিত ইনিংসে আইরিশরা তোলে ৬ উইকেটে ৩১৯ রান।
বাংলাদেশের বিপক্ষে এই প্রথম তিনশ ছুঁতে পারল আয়ারল্যান্ড।
এমন ইনিংস খেলেও আউট হয়ে ফেরার সময় হতাশায় বারবার মাথা নাড়ছিলেন টেক্টর। এই অতৃপ্তিই হয়তো তাকে এগিয়ে নেবে আরও প্রাপ্তির পথে!