দ্রুত ছড়াতে থাকা ওমিক্রন ধরনটির মধ্য দিয়েই প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস চলমান মহামারী পর্ব পার করে এনডেমিক বা সাধারণ রোগের স্তরে পৌঁছাতে পারে বলে আশা করছেন যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ ড. অ্যান্থনি ফাউচি।
Published : 19 Jan 2022, 08:45 AM
অবশ্য তিনি এটাও মানছেন, এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর সময় এখনও আসেনি।
এনডেমিক পর্যায়ে একটি ভাইরাসজনিত রোগ কোনো এলাকায় সাধারণ রোগে পরিণত হতে পারে। এর মানে হল, ওই এলাকায় রোগীটি থাকবে, মানুষ আক্রান্তও হবে, তবে এর প্রকোপ এবং ভয়াবহতা হবে মহামারী পর্যায়ের চেয়ে অনেক কম, এ রোগের ব্যবস্থাপনাও সহজ হবে।
সিএনএন লিখেছে, গত নভেম্বরের শেষে দিক থেকে পুরে বিশ্বে দ্রুত ছড়াতে থাকা করোনাভাইরাসের ওমিক্রন ধরনটি অনেক বেশি সংক্রামক হলেও আগের ধরনগুলোর মত ততটা গুরুতর অসুস্থতার কারণ হচ্ছে না। ফলে এর মধ্য দিয়েই পৃথিবীর মানুষ কোভিডের মহামারী পর্যায় অতিক্রম করতে পারে বলে আশা জাগছে।
“তবে সেটা তখনই ঘটবে, যদি আমাদের সামনে এমন একটি নতুন ভ্যারিয়েন্ট হাজির না হয়, যেটা আগের ভ্যারিয়েন্টের মাধ্যমে শরীরে তৈরি হওয়া প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে ফাঁকি দিতে পারে,” বলেছেন ফাউচি।
সোমবার বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের একটি ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানে দেওয়া বক্তৃতায় হোয়াইট হাউসের প্রধান চিকিৎসা উপদেষ্টা অ্যান্থনি ফাউচি বলেন, “ডেল্টা ভ্যারিয়েন্সের কিছু বৈশিষ্ট্য ওমিক্রনে দেখা যাচ্ছে না, এটা আমাদের জন্য সৌভাগ্যের। কিন্তু যে বিপুল সংখ্যক মানুষকে এটা আক্রান্ত করছে, তাতে সেই সুবিধাটা কাজে নাও লাগতে পারে।”
এখন ওমিক্রনে আক্রান্ত হলে যে অ্যান্টিবডি তৈরি হবে, সেটা টিকার মত স্থায়ীভাবে কাজ করবে কি না, সেই প্রশ্নের উত্তর এখনও মেলেনি, কারণ নতুন ভ্যারিয়েন্টগুলো নতুন নতুন ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্য নিয়ে হাজির হচ্ছে।
আর এমনটাও বলা যাচ্ছে না যে কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ শেষ হয়েছে, বিশেষ করে হাসপাতালে এখনও কোভিড রোগীর ভিড়ের কারণে অনেক সার্জারি পিছিয়ে দিতে হচ্ছে, স্কুলগুলো বাধ্য হচ্ছে অনলাইনে ক্লাস নিতে।
যুক্তরাষ্ট্রে স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থায় গুরুতর জনবল সংকট দেখা দিয়েছে ওমিক্রনের বিপুল বিস্তারের কারণে, আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে এখন বেশি কোভিড-১৯ রোগীর সেবা দিতে হচ্ছে, স্বাস্থ্যকর্মীরাও আক্রান্ত হচ্ছে।
ডিপার্টমেন্ট অব হেলথ অ্যান্ড হিউম্যান সার্ভিসেসের তথ্য অনুযায়ী সোমবার যুক্তরাষ্ট্রের হাসপাতালগুলোতে কমপক্ষে ১ লাখ ৫৬ হাজার ৬৭৬ জন কোভিড রোগী ভর্তি ছিলেন।
আর জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য বলছে, গত এক সপ্তাহে সেদেশে প্রতিদিন গড়ে ১ হাজার ৬৯৫ জনের মৃত্যু হয়েছে কোভিড-১৯ এর কারণে।
ওমিক্রন সংক্রমণ বাড়ায় শিক্ষক ও কর্মী সংকট দেখা দেওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সির প্যাটরসন থেকে অ্যালাবামার মোবাইল পর্যন্ত বহু স্কুল এ সপ্তাহে অনলাইন ক্লাসে ফিরে গেছে। এ অবস্থায় অনেক স্কুল অভিভাবক ও অন্যান্য কর্মীদের বদলি শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানিয়েছে।
টেক্সাসে, হিউস্টন ইনডিপেনডেন্ট স্কুল ডিস্ট্রিক্টে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় সেখানকার সব স্কুল ও দপ্তর মঙ্গলবার বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। বুধবার থেকে আবার পাঠদান শুরু করার আশা প্রকাশ করেছে তারা।
অবশ্য নিউ ইয়র্ক সিটির মেয়র এরিক অ্যাডামস জানিয়েছেন, দেশের সবচেয়ে বড় স্কুল ডিস্ট্রিক্টের বিদ্যালয়গুলো খোলা রাখছেন তারা। কোভিডের বিরুদ্ধে তার লড়াইয়ে শহরের পরিস্থিতির উন্নতিরও ইংগিত দিয়েছেন তিনি।
নিউ ইয়র্ক সিটির হেলথ কমিশনার ড. ডেভিড চোকশি জানান, কোভিডে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ১১ জানুয়ারির সাড়ে ছয় হাজার থেকে ১৬ জানুয়ারিতে ৫ হাজার ৮০০ জনে নেমে এসেছে। তবে এই সংখ্যাও অনেক বেশি বলে তিনি সতর্ক করেছেন এবং টিকা নেওয়ার ওপর জোর দিয়েছেন।
স্কুল ডিস্ট্রিক্টজুড়ে রিমোট লারনিং ‘সম্ভব নয়’ মন্তব্য করে নিউ ইয়র্ক সিটির মেয়র বলেছেন, শিক্ষক ইউনিয়নের সঙ্গে নগর কর্তৃপক্ষের আলোচনা চলছে, তারা দেখছে কোভিডে আক্রান্ত হয়ে বাসায় থাকা শিশুদের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা করা যায় কিনা।
এদিকে বিদ্যালয়ে মাস্ক পড়া বাধ্যতামূলক করার একটি সিদ্ধান্তে ব্যাপক শোরগোল দেখা গেছে ভার্জিনিয়ায়। ‘ব্যক্তি স্বাধীনতা’ ও হাই স্কুল পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের জন্য টিকার সহজলভ্যতার বিষয়টি উল্লেখ করে ওই রাজ্যের নবনির্বাচিত গভর্নর গ্লেন ইয়াংকিন একটি নির্বাহী আদেশে বলেছেন, শিক্ষার্থীরা মাস্ক পড়বে কিনা সে সিদ্ধান্ত তাদের মা-বাবা নেবেন। তার পূর্বসূরী আগস্টে বিদ্যালয়ে মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করেছিলেন।
নর্দার্ন ভার্জিনিয়া এবং রিচমন্ড এলাকার বেশ কয়েকটি স্কুল ডিস্ট্রিক্ট ঘোষণা দিয়েছে, তারা নতুন ওই আদেশ মানবে না, যা ২৪ জানুয়ারি থেকে বহাল হওয়ার কথা।
নতুন টিকা তৈরি কতদূর
সিএনএন লিখেছে, করোনাভাইরাসের নতুন ধরন মোকাবেলায় এগিয়ে থাকতে নতুন টিকার উদ্ভাবনের কাজও এগিয়ে চলেছে। ওষুধ প্রস্তুতকারক কোম্পানি মডার্নার প্রধান নির্বাহী স্টেফান ব্যানসেল সোমবার জানিয়েছেন, ওমিক্রন-ভিত্তিক কোভিড টিকার বিষয়ে তার কোম্পানি মার্চের মধ্যেই সুখবর দিতে পারে।
দাভোসে ডব্লিউইএফের একটি প্যানেল আলোচনায় তিনি বলেন, “আসন্ন সপ্তাহগুলোর মধ্যেই এই টিকা ক্লিনিক্যাল পরীক্ষার পর্যায়ে চলে আসবে। এবং আমরা আশা করছি মার্চের মধ্যে নিয়ন্ত্রক সংস্থার সামনে উপস্থাপনের জন্য দরকারি তথ্যউপাত্ত পেয়ে যাব এবং পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে তা নির্ধারণ করা যাবে তখন।”
ব্যানসেল জানান, ২০২৩ সালের শরৎ নাগাদ কিছু দেশে কোভিড ও ফ্লুর সমন্বয়ে তৈরি করা বুস্টার ডোজও পাওয়া যেতে পারে। তবে সব কিছু পরিকল্পনামাফিক হলেই সেটা সম্ভব।
চিকিৎসকেরা বলছেন, কোভিড-১৯ রোগের জটিলতা এড়াতে সবচেয়ে কার্যকর পথ হচ্ছে টিকা ও বুস্টার ডোজ দেওয়া। প্রাথমিকভাবে টিকা নেওয়ার পর বুস্টার ডোজ শরীরে অ্যান্টিবডির মাত্রা বাড়িয়ে তোলে, পাশাপাশি হাসপাতালে ভর্তির মত গুরুতর অসুস্থতা ঠেকিয়ে দিতে পারে।
ইসরায়েলে টিকার চতুর্থ ডোজ দেওয়ার তথ্যউপাত্ত থেকে জানা যাচ্ছে, ফাইজার-বায়োএনটেক বা মডার্নার টিকায় অ্যান্টিবডি তৈরির সক্ষমতা আরও বেড়ে যায় তৃতীয় ডোজের থেকে বেশি। তবে ওমিক্রনের সংক্রমণ ঠেকানোর মত সুরক্ষা দেওয়ার জন্য তা এখনও যথেষ্ট না।