মহামারী অবসানের আশা জাগিয়ে ২০২১ সাল শুরু হয়েছিল করোনাভাইরাসের টিকার সুখবর নিয়ে। সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে সেই টিকার সুরক্ষা দুর্বল হয়ে আসায় ধনী কিছু দেশ বাড়তি আরেক ডোজ টিকা দিচ্ছে নাগরিকদের, যাকে বলা হচ্ছে বুস্টার ডোজ। কিন্তু বাংলাদেশ কী ভাবছে?
Published : 31 Oct 2021, 11:40 PM
কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে নার্স রুনু ভেরোনিকা কস্তাকে প্রথম ডোজ দিয়ে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে করোনাভাইরাসের টিকাদান শুরু হয়েছিল বাংলাদেশে। এরপর গত নয় মাসে কোভিড টিকার অন্তত একটি ডোজ পেয়েছেন দেশের এক চতুর্থাংশ মানুষ।
এই বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে দেশের ৮০ শতাংশ মানুষের পূর্ণ ডোজ নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত বুস্টার ডোজ দেওয়ার পক্ষে নন বিশেষজ্ঞরা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরও বলছে, টিকা দেওয়ার সরকারি লক্ষ্যমাত্রা পূরণের আগে বুস্টার বা তৃতীয় ডোজ দেওয়া হবে না। বিষয়টি আরও পর্যবেক্ষণ করতে চায় টিকা বিষয়ক জাতীয় পরামর্শক কমিটি- নাইট্যাগ।
বিশ্বব্যাপী টিকার সুসম সরবরাহ না হওয়ায় নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে টিকার পূর্ণ ডোজ প্রাপ্তি নিশ্চিত করার জন্য ধনী দেশগুলোকে বুস্টার ডোজ দেওয়া স্থগিত রাখার আহ্বান জানিয়ে আসছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও।
তবে তাতে কান না দিয়ে দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার এবং ঝুঁকিতে থাকা নাগরিকদের কোভিড টিকার তৃতীয় বা বুস্টার ডোজ দেওয়া শুরু করেছে ইসরায়েল, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য।
কোথায় কীভাবে দিচ্ছে?
বাংলাদেশে টিকাদান শুরু হয়েছিল অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার কোভিড টিকা দিয়ে। তারপর চীনের সিনোফার্ম, যুক্তরাষ্ট্রের ফাইজার আর মডার্নার টিকাও দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশে।
এর মধ্যে অ্যাস্ট্রাজেনেকা ও সিনোফার্মের টিকা বাংলাদেশ কিনেছে, ফাইজার আর মডার্নার টিকার পুরোটাই পেয়েছে টিকার আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্ম কোভ্যাক্সের আওতায়।
যুক্তরাজ্যের গবেষণায় দেখা গেছে, ফাইজার ও অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা নেওয়ার পর শরীরে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে যে প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়, ছয় মাসের মধ্যে তা দুর্বল হতে শুরু করে। আর সেজন্যই বুস্টার ডোজের পক্ষে সুপারিশ করছেন গবেষকরা।
গত অগাস্টে ব্রিটেনের জো কোভিড স্টাডিতে দেখা যায়, ফাইজারের টিকার দুটি ডোজ করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে ৮৮ শতাংশ ক্ষেত্রে সুরক্ষা দিলেও ৫ থেকে ৬ মাসের মধ্যে তা ৭৪ শতাংশে নেমে আসে।
আর অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার ক্ষেত্রে চার থেকে পাঁচ মাসের মধ্যে কার্যকারিতা ৭৭ শতাংশ থেকে নেমে আসে ৬৭ শতাংশে।
সাম্প্রতিক গবেষণাগুলোতে দেখা গেছে, টিকা নেওয়ার পর যাদের মধ্যে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়েছে, তাদের মধ্যে অনেক আগে টিকা পাওয়া ব্যক্তিদের সংখ্যা নতুন টিকা পাওয়া ব্যক্তিদের তুলনায় বেশি। একে টিকার প্রতিরোধ দুর্বল হয়ে আসার প্রমাণ বলে মনে করছেন গবেষকরা।
ব্রিটিশ এপিডেমিওলজিস্ট নেইল ফার্গুসন বলেন, “করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে শরীরে তৈরি হওয়া প্রতিরোধ ক্ষমতা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কমে আসে। … আর এ কারণেই বুস্টার ডোজ এত গুরুত্বপূর্ণ।
যুক্তরাষ্ট্রের সিডিসি বলেছে, ১৮ বছর বা তার বেশি বয়সী যাদের জনসন অ্যান্ড জনসনের কোভিড টিকা নেওয়ার পর দুই মাস পার হয়ে গেছে, তারাই বুস্টার ডোজ নিতে পারবেন।
আর ফাইজার বা মর্ডানার টিকার দ্বিতীয় ডোজ নেওয়ার পর ছয় মাস পেরিয়ে গিয়ে থাকলে, তাদের মধ্যে যাদের বয়স ৬৫ বছরের বেশি এবং প্রাপ্তবস্ক যাদের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদী অন্য কোনো স্বাস্থ্য জটিলতা বা দুরারোগ্য ব্যাধি রয়েছে, তারা নিতে পারবেন বুস্টার ডোজ।
যুক্তরাজ্যের নাগরিকদের মধ্যে যাদের বয়স ৫০ এর বেশি, যারা কেয়ার হোমে থাকেন, স্বাস্থ্যকর্মী, ঝুঁকিতে থাকা ব্যক্তিদের সেবায় যারা যুক্ত এবং নারীদের মধ্যে যারা অন্তঃসত্ত্বা তারা বুস্টার ডোজ নিতে পারবেন, যদি তাদের দ্বিতীয় ডোজ নেওয়ার পর ছয় মাস পার হয়ে গিয়ে থাকে।
ব্রিটিশ নাগরিকদের মধ্যে যারা বুস্টার ডোজ দেওয়ার সুযোগ পাবেন, তাদের অধিকাংশকে দেওয়া হবে ফাইজার বা মাডার্নার টিকা, আগে তাকে যে টিকাই দেওয়া হোক না কেন। ফাইজার বা মাডার্না দেওয়া না গেলে কাউকে কাউকে অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা দেওয়া হবে।
কয়েকটি ধনী দেশ নাগরিকদের বুস্টার ডোজ দেওয়া চালিয়ে গেলেও এই মুহূর্তে এটা সত্যিই জরুরি কি না- বিজ্ঞানীরা এখনও সে বিষয়ে একমত হতে পারেননি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, যারা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছে, আগে তাদের দুই ডোজ দেওয়া দরকার, তারপর তৃতীয় ডোজের ভাবনা।
আওয়ার ওয়ার্ল্ড ইন ডেটা বলছে, ২৭ অক্টোবর পর্যন্ত বিশ্বের মোট জনসংখ্যার শূন্য দশমিক ৯৩ শতাংশ একটি বুস্টার ডোজ পেয়েছেন।
বাংলাদেশ কী করবে
আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র- আইসিডিডিআর,বির জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী ড. ফেরদৌসী কাদরী মনে করেন, বাংলাদেশে এখনও বুস্টার ডোজ শুরু করার সময় আসেনি।
তবে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) সঙ্গে মিলে আইসিডিডিআর,বি এ বিষয়ে একটি গবেষণা চালাচ্ছে বলে তিনি জানিয়েছেন।
র্যামন ম্যাগসাইসাই পুরস্কার পাওয়া এই বিজ্ঞানী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দেশের সবাইকে দুই ডোজ করে টিকা নিশ্চিত না করে বুস্টার ডোজ দেওয়ার চিন্তা একটু প্রিম্যাচিউরড। বিষয়টি নিয়ে আমাদেরকে আরও চিন্তা করতে হবে।
“বুস্টার ডোজ হয়তো কিছুসংখ্যক মানুষকে দিতে হবে, যারা অনেক হাই রিস্কে আছে তাদের। এখন আমরা যদি বুস্টার ডোজ দিতে যাই, তাহলে কিছু মানুষ টিকা পাবে না।”
তৃতীয় ডোজ বা বুস্টার ডোজের সঙ্গে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বা অ্যান্টিবডির সম্পর্ক ব্যাখ্যা করে ড. ফেরদৌসী বলেন, “টিকা নেওয়ার একটা নির্দিষ্ট সময় পর শরীরে অ্যান্টিবডি কমে যায়। তবে মেমোরিসেল থেকে যায়।
“এ কারণে ভাইরাস আক্রান্ত হলে মেমোরিসেল ঠিকই সক্রিয় হয়ে ওঠে। অ্যান্টিবডি কমলেই যে ভ্যাকসিন কাজ করছে না বিষয়টি এমন নয়। টিকা দেওয়ার পর শরীরে অ্যান্টিবডি থাকে কয়েক মাস। এই মেয়াদ বিভিন্ন টিকার ক্ষেত্রে বিভিন্ন রকম হয়।”
“তারা বিষয়টি আরও পর্যবেক্ষণ করতে চান। আমাদের (নাইট্যাগ) বিষয়টি নিয়ে যতটুকু আলোচনা হয়েছে, তাতে আমরা বাংলাদেশে এখনও বুস্টার ডোজের পক্ষে নই।”
জনসংখ্যার বড় একটা অংশ এখনও দ্বিতীয় ডোজ না পাওয়ার বিষয়টি তুলে ধরে ডা. বে-নজীর বলেন, “আগে ৮০ শতাংশ মানুষ দুই ডোজ টিকা পাক, পরে আমরা চিন্তা করব বুস্টার ডোজ দেওয়া যায় কি না।”
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক এবং ন্যাশনাল ভ্যাকসিন ডেপ্লয়মেন্ট কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরও বিষয়টি নিয়ে আপাতত চিন্তা করছে না।
“টিকা নেওয়ার কতদিন পর বুস্টার ডোজ দিতে হবে এটা সুর্নিদিষ্ট করা হয়নি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও বুস্টার ডোজের সুপারিশ সেভাবে করে নাই। একটা আলোচনা আছে যে, যারা উচ্চ ঝুঁকিতে আছে তাদের বুস্টার ডোজ দেওয়ার। সাধারণত যেটা দেওয়া হয় ছয় মাস পরে। এটা আবার নির্ভর করে ওই দেশের বেশিরভাগ মানুষকে দুই ডোজ টিকা দেওয়ার ওপর।”
বেসরকারি পর্যায়ে টিকা আমদানি করে বুস্টার ডোজ দেওয়া যায় কি না- এমন প্রশ্নে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক বলেন, সে পরিকল্পনাও এখনও নেই।
“কারণ বেসরকারিভাবে দিলে এর জন্য একটা মূল্য পরিশোধ করতে হবে। কিন্তু আমরা তো ফ্রিতে টিকা দিচ্ছি। সরকারি পরিকল্পনার মধ্যেই ৮০ শতাংশ মানুষকে টিকা দেওয়া যাবে এমন টিকা ক্রয় নিশ্চিত করা হয়েছে। সে কারণে এই মুহূর্তে বেসরকারিভাবে দেওয়ার আলোচনা হচ্ছে না।”
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে, শনিবার পর্যন্ত সারাদেশে করোনাভাইরাসের টিকার অন্তত এক ডোজ পেয়েছেন ৪ কোটি ১৭ লাখ ৮২ হাজারের বেশি মানুষ। আর ২ কোটি ৮৬ লাখ ৮৯ হাজার ৯২ জন দুই ডোজ পেয়েছেন।
আরও পড়ুন