অনেক রোগের টিকা সুরক্ষা দেয় জীবনভর, কোভিডে কেন তা হচ্ছে না

হামের টিকা একবার নিলে মোটামুটি সারা জীবনই ভালো কাজে দেয়।  জল বসন্তের টিকা ১০ থেকে ২০ বছরের জন্য সুরক্ষা দেয়। আর ধনুষ্টঙ্কারের টিকার কার্যকারিতা থাকে এক দশক কিংবা তারও বেশি সময়। অথচ কোভিড-১৯ টিকা দেওয়ার পর ছয় মাস না যেতেই অনেক দেশের স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের বাড়তি একটা ‘বুস্টার ডোজ’ দেওয়ার কথা ভাবতে হচ্ছে।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 Sept 2021, 06:36 PM
Updated : 29 Sept 2021, 06:36 PM

টিকা দেওয়ার মূল উদ্দেশ্য হল কৃত্রিম উপায়ে নিয়ন্ত্রিত সংক্রমণ ঘটিয়ে শরীরের নিজস্ব সুরক্ষা ব্যবস্থাকে জাগিয়ে তোলা, যাতে পরে ভাইরাসের সংস্পর্শে এলেও আর রোগে আক্রান্ত হতে না হয়। তবে কাজটা এমনভাবে করতে হয়, যাতে টিকার কারণে গুরুতর অসুস্থতা বা মৃত্যুর ঝুঁকি তৈরি না হয়।

কোনো কোনো রোগের ক্ষেত্রে টিকা দীর্ঘমেয়াদে সেই সুরক্ষা দিতে পারলেও করোনাভাইরাসের টিকার ক্ষেত্রে তা কেন খাটছে না, বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে তার উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের এক প্রতিবেদনে।

ইমোরি ইউনিভার্সিটির জীববিজ্ঞানের অধ্যাপক রুস্তম আন্তিয়া বলছেন, “সত্যিকারের ভালো টিকা দেহে এমন প্রতিরোধ গড়ে তোলে যাতে কেউ পরে ভাইরাসের সংস্পর্শে এলও সংক্রমিত না হন। কিন্তু সব টিকা এমন আদর্শ মানে পৌঁছায় না।”

শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিয়ে গবেষণা করা এই অধ্যাপক জানান, টিকা তিন ধরনের সুরক্ষা দিতে পারে। কোনো টিকা হয়ত সংক্রমণ ও রোগের বিস্তারের পথ বন্ধ করে পূর্ণ সুরক্ষা দেয়। কোনো টিকা গুরুতর অসুস্থতা এবং রোগ ছড়ানো ঠেকাতে পারে। আবার কোনো টিকা কেবলমাত্র গুরুতর অসুস্থতা এড়াতে সহায়তা করতে পারে।

কোনো টিকা কেমন কার্যকারিতা দেখাবে তা আবার নির্ভর করে অনেকগুলো বিষয়ের ওপর। টিকা দেওয়ার পর কত দ্রুত এবং কী পরিমাণ অ্যান্টিবডি শরীরে তৈরি হচ্ছে, সেই অ্যান্টিবডি কতদিন শরীরে টিকে থাকছে, যে ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া ঠেকাতে এই টিকা তৈরি হয়েছে, সেটি ক্রমাগত রূপ বদলাচ্ছে কি না এবং দেহের কোন জায়গায় সেটি সংক্রমণ ঘটাচ্ছে- এই সবগুলো বিষয়ই টিকার কার্যকারিতার মাত্রা ঠিক করে দেয়।

শরীরে কোন মাত্রায় অ্যান্টিবডি তৈরি হলে কার্যকর সুরক্ষা পাওয়া যাবে তা আবার একেক রোগের ক্ষেত্রে একেক রকম।

ওরেগন হেলথ অ্যান্ড সায়েন্স ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক মার্ক স্লিফকা বলেন, প্রতিটি রোগের জন্য ওই মাত্রা তারা নির্ণয় করেন প্রতি মিলিলিটার রক্তে অ্যান্টিবডির পরিমাণের ভিত্তিতে। 

দেশে টিকাদান শুরুর দ্বিতীয় দিনে বৃহস্পতিবার ঢাকার বিএসএমএমইউতে কোভিড-১৯ টিকা দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন একজন নার্স। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

১৯৪২ সালে ধনুষ্টঙ্কারের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় সুরক্ষার জন্য প্রতি মিলিলিটার রক্তে অ্যান্টিবডির মাত্রা নির্ধারণ করা হয় ০ দশমিক ০১ ইন্টারন্যাশনাল ইউনিট। অর্থাৎ, কোনো টিকা যদি প্রতি মিলিলিটার রক্তে ওই পরিমাণ অ্যান্টিবডি তৈরি করতে পারে, তাহলে সেই টিকা ধনুষ্টঙ্কারের জীবাণুর বিরুদ্ধে কার্যকর সুরক্ষা দিতে পারবে।

এই মাত্রা নির্ণয়ের জন্য দুজন জার্মান গবেষক প্রথমে পশুর শরীরে টিকার পরীক্ষা চালানোর পর সেই ফল যাচাই করতে স্বেচ্ছায় নিজেদের শরীরে ধনুষ্টঙ্কারের জীবাণু প্রবেশ করান।

অধ্যাপক মার্ক স্লিফকা বলেন, “তাদের একজন নিজের উরুতে ধনুষ্টংকারের দুটি ডোজ নিয়ে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন অ্যান্টিবডি কেমন কাজ করে। তার সহকর্মী নিয়েছিলেন তিন ডোজ। এ পরীক্ষায় দুজনের কেউই অসুস্থ হননি।”

হামের ক্ষেত্রে সুরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় অ্যান্টিবডির মাত্রা নির্ধারণ করা হয় ১৯৮৫ সালে। সেসময় একটি কলেজের ছাত্রাবাসে রক্তদান কর্মসূচির পর হামের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। গবেষকরা পরে শিক্ষার্থীদের দেওয়া রক্তের নমুনা পরীক্ষা করে সেই মাত্রা বুঝতে পারেন। সেখা যায়, কারও প্রতি মিলিলিটার রক্তে ০ দশমিক ০২ আন্তর্জাতিক ইউনিট অ্যান্টিবডি তৈরি হলে তার আর হাম হওয়ার ভয় থাকবে না। 

 

এই দুটি রোগের ক্ষেত্রে টিকার কার্যকারিতার পাশাপাশি অ্যান্টিবডির স্থায়িত্ব সম্মিলিতভাবে একটি টেকসই প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারে। হামের অ্যান্টিবডি সক্ষমতা হারায় বেশ ধীরে। ধনুষ্টঙ্কারের অ্যান্টিবডি সেই তুলনায় একটু দ্রুত সক্ষমতা হারায়। কিন্তু এ দুই রোগের ক্ষেত্রে টিকা দেওয়ার পর দেহে প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি অ্যান্টবডি তৈরি হয়। ফলে সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে অ্যান্টিবডির সক্ষমতা কমে এলেও তার মাত্রা থাকে কার্যকারিতা সুরক্ষা দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।

ড. স্লিফকা বলেন, “ধনুষ্টঙ্কার, ডিপথেরিয়া, হাম আর বসন্তের মত রোগ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে আমরা ভাগ্যবান। এসব রোগ থেকে কার্যকর সুরক্ষা পেতে কতটা অ্যান্টিবডি দরকার, সেই মাত্রা আমরা নির্ধারণ করতে পেরেছি।

“আমরা জানি যে এসব রোগ থেকে সুরক্ষার জন্য শরীরে কতটা অ্যান্টিবডি দরকার হয়। এই মাত্রা জানা থাকলে আপনি হিসাব করে বের করতে পারবেন টিকার স্থায়িত্ব কতদিন হবে। কোভিডের ক্ষেত্রে সেটা আমরা জানি না।” 

এযাবৎকালের ইতিহাসে দেখা গেছে, ‘প্রতিরূপ’ তৈরিতে সক্ষম- এমন ভাইরাস ব্যবহার করে যেসব টিকা তৈরি করা হয়েছে, সেগুলোই সবচেয়ে টেকসই সুরক্ষা দিয়েছে; মোটামুটি আজীবনের জন্য একটি প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পেরেছে।

হাম ও জলবসন্তের টিকা তৈরির ক্ষেত্রে প্রতিরূপ তৈরিতে সক্ষম ভাইরাস ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু প্রতিরূপ তৈরি করে না- এমন ভাইরাস কিংবা প্রোটিন ভিত্তিক টিকা (যেমন ধনুষ্টংকারে টিকা) ততটা দীর্ঘস্থায়ী হয় না। অবশ্য অ্যাডজুভান্ট ব্যবহার করে এসব টিকার কার্যকারিতা বাড়ানো যায়। অ্যাডজুভান্ট হল সহায়ক উপকরণ, যা টিকা দেওয়ার পর শরীরের প্রতিক্রিয়া বাড়াতে সহায়তা করে। ধনুষ্টঙ্কার ও হেপাটাইটিস এ টিকার ক্ষেত্রে এ ধরনের সহায়ক উপকরণ ব্যবহার করা হয়।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের কনভেনশন সেন্টারে সোমবার ফাইজার-বায়োএনটেকের টিকা দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন এক স্বাস্থ্য কর্মী। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

জনসন অ্যান্ড জনসন এবং অ্যাস্ট্রাজেনেকার কোভিড- ১৯ টিকা তৈরিতে প্রতিরূপ তৈরি করে না এমন অ্যাডেনোভাইরাস ব্যবহার করা হয় এবং কোনো অ্যাডজুভান্ট থাকে না। 

ফাইজার ও মডার্নার টিকা তৈরি হয়েছে সার্স-কোভ-২ ভাইরাসের আরএনএ ব্যবহার করে। এ দুটি টিকা কাজ করে ভিন্নভাবে, সেই অর্থে কোনো ভাইরাস এ টিকায় থাকে না।

বিষয়টিকে আরও জটিল করে তুলেছে ভাইরাসের ক্রমাগত রূপ বদল বা মিউটেশন। ফলে টিকার মাধ্যমে শরীরে তৈরি অ্যান্টিবডি ওই ভাইরাসের অন্য একটি মিউট্যান্ট বা পরিবর্তিত রূপের ক্ষেত্রে কার্যকর নাও হতে পারে।

হাম, মামস, রুবেলা ও জল বসন্তের ভাইরাস রূপ বদলায় কদাচিত। অথচ কোভিড-১৯ এর জন্য দায়ী সার্স-কোভ-২ ভাইরাসের বেশ কিছু ভ্যারিয়েন্ট এরইমধ্যে বিজ্ঞানীয়রা শনাক্ত করেছেন।

ওরেগন হেলথ অ্যান্ড সায়েন্স ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক মার্ক স্লিফকা বলেন, “এটা কার্যকর টিকা তৈরির বিষয়টিকে আরও বেশি জটিল করে তুলেছে। সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে আপনাকে নতুন ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে লড়তে হবে।”

তিনি জানান, ফ্লুর ভাইরাসও দ্রুত রূপ বদলায়। সে কারণে ফ্লুর ক্ষেত্রে প্রতি বছর টিকার নতুন সংস্করণ তৈরি করতে হচ্ছে, যাতে নতুন ভ্যারিয়েন্টগুলোর বিরুদ্ধেও সেই টিকা কাজ করে। ফ্লুর টিকা কমপক্ষে ৬ মাস সুরক্ষা দিতে পারে।

ক্রমাগত রূপ পাল্টাতে থাকা একটি ভাইরাসের বিরুদ্ধে কার্যকর টিকা তৈরি করা যখন এতটাই জটিল, তখন অনেকে হার্ড ইমিউনিটির মাধ্যমে কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে জয়ী হওয়ার আশা করছিলেন।

মোট জনসংখ্যার বেশিরভাগের শরীরে একটি নির্দিষ্ট রোগের বিরুদ্ধে যদি কার্যকর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়, তাহলে সেই রোগের বিরুদ্ধে হার্ড ইমিউনিটি তৈরি হয়েছে বলে ধরা হয়। অর্থাৎ ভাইরাসের সংস্পর্শে এলেও ওই জনগোষ্ঠীতে আর রোগ ছড়াবে না।

ইমোরি ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক রুস্তম আন্তিয়া বলছেন, করোনাভাইরাস যেভাবে মানবদেহে সংক্রমণ ঘটায়, তাতে হার্ড ইমিউনিটি অর্জনের সম্ভাবনা কম।

তিনি বলছেন, যেসব জীবাণু ফুসফুস বা শ্বাসতন্ত্রে সংক্রমণ ঘটায়, সেসব রোগের ক্ষেত্রে টিকা দিয়ে হার্ড ইমিউনিটি তৈরির চেষ্টা দীর্ঘমেয়াদী হয় না।

“এটা নির্ভর করে কত দ্রুত ভাইরাসটি রূপান্তরিত হচ্ছে তার ওপর। সেই সঙ্গে কত দ্রুত রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়ছে সেটাও গুরুত্বপূর্ণ।”

আরেকটি সমস্যা হচ্ছে, করোনাভাইরাস শ্বাসতন্ত্রের উপরের এবং নিচের- দুটি অংশেই নিজেদের প্রতিরূপ তৈরি করে। মানুষের ফুসফুস এবং শরীরের ভেতরে সঞ্চলন প্রক্রিয়া বেশ ভালো। ফলে সেসব এলাকায় অ্যান্টিবডি ভাইরাসের বিরুদ্ধে ভালো প্রতিরোধ গড়তে পারে। কিন্তু নাক বা নাসারন্ধ্রের ক্ষেত্রে সেটা খাটে না। ফলে শ্বাসতন্ত্রের উপরের অংশে দুর্বল মাত্রায় সংক্রমণের ঝুঁকি থেকেই যায়।

ফাইল ছবি

ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল লিখেছে, কোভিডের বিরুদ্ধে লড়তে গেলে মানুষকে এখন নিয়মিতভাবে টিকা নবায়ন করতে হবে। অর্থাৎ ফ্লুর টিকার মতই নিয়মিত নতুন সংস্করণ তৈরি করতে হবে, যাতে তা নতুন নতুন ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধেও কার্যকর হতে পারে।

লন্ডন ইম্পেরিয়াল কলেজের গবেষকরা বলছেন, পরবর্তী প্রজন্মের টিকার ক্ষেত্রে নাক এবং ফুসফুসের ভেজা অংশের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর বিষয়েও মনোযোগ দিতে হবে।

আর তার আগ পর্যন্ত এ ভাইরাসকে এড়াতে হলে হয়ত টিকার আরেকটি ডোজ নিতে হবে।