করোনাভাইরাসের স্বাভাবিক সংক্রমণে দেহে যে প্রতিরোধ ব্যবস্থা তৈরি হয়, আর টিকা নেওয়ার পর যে প্রতিরোধ ব্যবস্থা তৈরি হয়, তার মধ্যে বেশ কিছু পার্থক্য রয়েছে।
Published : 23 Aug 2021, 12:39 AM
এর মধ্যে কোনটি ভালো? বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে তার উত্তর খোঁজার চেষ্টা হয়েছে বিবিসির একটি প্রতিবেদনে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, এক বছর আগেও এই প্রশ্নকে দ্রোহ হিসেবেই গণ্য করা হত। কারণ মহামারীর শুরুর দিকে বিশেষ করে বয়স্ক এবং শারীরিকভাবে দুর্বল ব্যক্তিদের কোভিডে আক্রান্ত হওয়া ছিল ভয়ঙ্কর এক ব্যাপার।
এখন চিত্রটা সে রকম নয়। করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে শরীরে প্রতিরোধ গড়ে ওঠেনি, এখন তেমন মানুষ কম। বেশিরভাগই হয় টিকা নিয়েছেন, নয়ত করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন।
বয়স্কদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে টিকার বুস্টার ডোজ দেওয়া হবে, না কি ভাইরাসের সংক্রমণে তা স্বাভাবিকভাবেই বাড়বে? শিশুদের আদৌ টিকা দেওয়ার প্রয়োজন আছে কি না? দুটো বিষয়ই এখন বিতর্ক উস্কে দিচ্ছে।
ইউনিভার্সিটি অব এডিনবার্গের রোগতত্ত্ববিদ অধ্যাপক এলেয়ানর রাইলে বলেন, “যদি ভাবি প্রতিবছর একটি বুস্টার ডোজ দিয়ে কোভিডকে দূরে রাখা যাবে, তবে আমরা নিজেদের রক্ষায় দীর্ঘদিনের জন্য একটি গর্ত খুঁড়তে পারি।”
কোভিড টিকা বিষয়ক যুক্তরাজ্য সরকারের উপদেষ্টা অধ্যাপক অ্যাডাম ফিনের মতে, বিশ্বের অন্য প্রান্তে যখন টিকা পাচ্ছেই না, তখন কাউকে বাড়তি টিকা দেওয়া ‘কিছুটা পাগলামো’, এটা কেবল বৈষম্যমূলকই নয়, এটা ‘নির্বুদ্ধিতাও’।
রোগ প্রতিরোধের ব্যবচ্ছেদ
শরীরের সংক্রমণ দূর করতে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থায় যুগল ভূমিকা পালন করে ‘অ্যান্টিবডি’ ও ‘টি-সেল’। অ্যান্টিবডি ভাইরাসের আবরণের সঙ্গে লেগে থেকে তাকে ধ্বংস করার জন্য চিহ্নিত করে আর ভাইরাস আমাদের দেহের যেসব কোষ ছিনিয়ে নিয়েছে সেসব শনাক্ত করার মাধ্যমে ধ্বংস করে দেয় ‘টি-সেল’।
করোনাভাইরাস যেসব সমস্যা তৈরি করে, তা খুবই স্পষ্ট এবং সাধারণ। এর রয়েছে অতিপরিচিত ‘স্পাইক প্রোটিন’, যা আমাদের দেহে প্রবেশের জন্য চাবি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এছাড়া দেহকোষ ছিনতাই করে কয়েক হাজার প্রতিরূপ তৈরি করার জন্য রয়েছে আরও ২৮ ধরনের প্রোটিন। অন্যদিকে মানবদেহের পরিচালনায় রয়েছে ২০ হাজার প্রোটিন।
সুরক্ষা ছাড়া স্বাভাবিক সংক্রমণ এবং টিকা নেওয়ার পর সংক্রমিতের মধ্যে তুলনা করার চারটি প্রধান বিষয় রয়েছে।
ব্যাপ্তি
কী পরিমাণ ভাইরাসকে আক্রমণ করতে পারে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা?
প্রতিবেদনে বলা হয়, টিকার সুরক্ষা ছাড়া আক্রান্ত হওয়ার পর যে কোনো মানুষের দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা টিকা নেওয়ার চেয়ে বেশি মাত্রায় সাড়া দেয়।
মডার্না কিংবা ফাইজার অথবা অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা, যে টিকাই নেওয়া হোক না কেন, দেহ কেবল একটি বিষয় শনাক্ত করতে শেখে- তা হলে ‘স্পাইক প্রোটিন’।
ভাইরাসের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি করার বিষয়টি বেশ জটিল হলেও তার ফলাফল বেশ স্পষ্ট উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, এখনও বেশিরভাগ মানুষকেই হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়নি।
কিন্তু করোনাভাইরাসে বাকি ২৮টি প্রোটিনকে নিশানা করতে শরীরের ‘টি-সেলকে’ আরও বেশি কিছু করতে হয়।
অধ্যাপক এলেয়ানর রাইলে বলেন, “তার মানে আপনার যদি যথার্থই গুরুতর সংক্রমণ হয় তবে ভাইরাসের নতুন যে কোনো ধরনের বিরুদ্ধে আপনার হয়ত আরও ভালো প্রতিরোধ গড়ে উঠবে।”
প্রতিরোধশক্তি
এটা কতটা সংক্রমণ আটকাতে পারে বা কতটা গুরুতর রোগ প্রতিরোধ করতে পারে?
দেখা যাচ্ছে, অনেকে দ্বিতীয়বারের মতো করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছেন এবং টিকা দেওয়ার পরও হচ্ছেন।
ইউনিভার্সিটি অব ব্রিস্টলের অধ্যাপক ফিন বলেন, “সংক্রমণের বিরুদ্ধে কোনোটাই আপনাকে পূর্ণ সুরক্ষা দেবে না, কিন্তু যেটা থেকেই আপনি প্রতিরোধ অর্জন করেন না কেন, গুরুতর রোগ থেকে অনেকটাই রক্ষা করবে।”
গড়পড়তা হিসাবে সংক্রমণের এক মাস পর অ্যান্টিবডির মাত্রা তুলনামূলকভাবে উঁচুতে থাকে।
যদিও আক্রান্তদের মধ্যে যারা উপসর্গহীন (যারা খুব বেশি কাবু হননি) ছিলেন এবং যাদের খুব গুরুতর অবস্থা হয়েছিল, তাদের অ্যান্টিবডির মধ্যেও বড় ধরনের পার্থক্য পাওয়া গেছে।
প্রতিরোধ ব্যবস্থায় সবচেয়ে বেশি সাড়া পাওয়া গেছে যারা কোভিড আক্রান্ত হওয়ার পর টিকা নিয়েছেন।
এর বিপরীত ক্ষেত্রে কী ঘটছে সে বিষয়ে আরও তথ্য উপাত্তের জন্য অপেক্ষা করতে হবে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
স্থায়িত্বকাল
টিকার ডোজ কত দিন সুরক্ষা দেবে?
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অ্যান্টিবডির মাত্রা কমতে থাকে, যদিও গুরুতর রোগ থেকে সুরক্ষা দেওয়ার ক্ষেত্রে এটা গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয় নয়।
প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে উঠলে তা ভাইরাস এবং টিকা দুটোকেই চিনতে পারে, তাই সংক্রমণ হলে দ্রুততার সঙ্গে সাড়া দিতে পারে।
শরীরে ‘মেমোরি টি-সেল’ দীর্ঘদিন থাকে আর প্রয়োজন অনুযায়ী প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিবডি তৈরি করতে পারে ‘বি-সেল’। সংক্রমণের এক বছরের বেশি সময় পরও প্রতিরোধ ব্যবস্থা কার্যকর থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে এবং টিকা পরীক্ষা করে দীর্ঘস্থায়ী উপকারও মিলেছে।
ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডনের অধ্যাপক পিটার ওপেনশ বলেন, “স্থায়িত্বের বিষয়টি নিয়ে আমরা আরও দেখার জন্য অপেক্ষা করছি।”
অবস্থান
দেহের কোথায় প্রতিরোধ ক্ষমতা থাকে?
নাক এবং ফুসফুসে থাকা অ্যান্টিবডির (যা ইমিউনোগ্লোবুলিন নামে পরিচিত) সঙ্গে রক্তে যে অ্যান্টিবডির (ইমিউনোগ্লোবুলিন জিএস) পরিমাপ করা হয় তুলনা বিচারে এ দুটোর মধ্যে বিস্তর পার্থক্য রয়েছে।
প্রথমটি সংক্রমণে বাধা দেওয়ার ক্ষেত্রে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। টিকার সুরক্ষা ছাড়া স্বাভাবিক সংক্রমণে বাহুতে টিকা দেওয়ার চেয়ে নাক এবং ফুসফুসের অ্যান্টিবডি অনেকে বেশি কার্যকর। যে কারণে নাক দিয়ে নেওয়ার মতো টিকা তৈরিরও চেষ্টা চলছে।
‘ইউনিভার্সিটি অব অক্সফোর্ড’ এ ‘টি-সেল’ নিয়ে কাজ করা অধ্যাপক পল ক্লেনারম্যান বলেন, “একই ভাইরাস হলেও সংক্রমণের স্থান একটি ভিন্নতা তৈরি করে, তাই স্বাভাবিক সংক্রমণ এবং টিকা নেওয়ার পর সংক্রমণের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি পার্থক্য আশা করতে পারি।”
ভারসাম্য কোথায়?
এ বিষয়ে স্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে যে বয়স্ক যারা টিকার কোনো ডোজ নেননি, তারা টিকা নিলে আরও শক্তিশালী প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে উঠবে। এমনকি তারা যদি আগে কোভিড আক্রান্ত হয়ে থাকেন, সেক্ষেত্রেও এটা ঘটবে।
কিন্তু এখনও দুটি বড় প্রশ্ন রয়েছে:
বয়স্ক যাদের টিকা দেওয়া হয়েছে তাদের কি বুস্টার ডোজ দিতে হবে, না কি ভাইরাসের বিরুদ্ধে টিকার দুটি পূর্ণ ডোজই যথেষ্ট?
শিশুদের কি আদৌ টিকা দেওয়ার প্রয়োজন আছে, না কি আজীবন ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ফলেই ভালো প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে উঠবে?
প্রতিবেদনে বলা হয়, অন্যান্য সংক্রমণের ক্ষেত্রে আজীবন নিয়মিতভাবে রোগ প্রতিরোধ বাড়ানো যুক্তিসঙ্গত নয়। আরএসভি (রেসপাইরেটরি সিংকশিয়াল ভাইরাস) কিংবা করোনাভাইরাসের অন্য যে চারটি ধরন সাধারণ সর্দিজ্বর তৈরি করে, সেসবের ক্ষেত্রে এটা প্রযোজ্য নয়।
এসব ভাইরাসে যতবারই কেউ আক্রান্ত হচ্ছেন, রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ততবারই আরও একটু বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠেছে এবং সেটা বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত চলতে থাকে। অবশ্য বৃদ্ধ বয়সে প্রতিরোধ দুর্বল হতে থাকে এবং সংক্রমণ আবারও একটি সমস্যা হয়ে ওঠে।
টিকার প্রয়োজন আছে কি না, সেটা না দেখেই ‘বুস্টিংয়ের একটি চক্রে বন্দি হয়ে যাওয়ার’ বিষয়ে সতর্ক করেছেন যুক্তরাজ্য সরকারের টিকা বিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক ফিন।
“এটা প্রমাণিত নয়, কিন্তু সবসময় মানুষের শরীরে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য খরচা করার চেয়ে এমনটা হতে দেওয়া অনেক সস্তা ও সহজ।”
শিশুদের বিষয়ে তার যুক্তি ‘ইতোমধ্যে জয়ী’ হয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, “৪০ থেকে ৫০ শতাংশ শিশু এরই মধ্যে আক্রান্ত হয়েছে এবং বেশিরভাগই অসুস্থ হয়নি কিংবা আংশিক অসুস্থ হয়েছে।”
এর বিপরীত যুক্তিও রয়েছে। অধ্যাপক এলেয়ানর রাইলে শিশুদের ‘দীর্ঘ মেয়াদী কোভিড’ এবং অধ্যাপক পিটার ওপেনশ ‘দীর্ঘ মেয়াদী কোভিড’ নিয়ে শঙ্কা এবং দেহের বিভিন্ন প্রত্যঙ্গের ক্ষতি হওয়ার বিষয়টি তুলে ধরেন।
তবে অধ্যাপক রাইলে সংক্রমিত হওয়ার পর কোভিডকে ‘দুর্বল করার জন্য’ টিকার কার্যকারিতার বিষয়টি তুলে ধরে সেটা প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াবে বলে উল্লেখ করেন।
তিনি বলেন, “আমাদের অবশ্যই ভেবে দেখতে হবে, আমরা কি মানুষকে তাদের জীবনযাত্রায় আত্মবিশ্বাসী করে তুলছি, নাকি কেবল ভয় দেখাচ্ছি? আমরা এখন কেবল লোকজনকে দুঃশ্চিন্তায় ফেলছি।”
অধ্যাপক রাইলে জানান, সংক্রমণের মাত্রা যেহেতু বাড়ছে তাই এ ক্ষেত্রে বেছে নেওয়ার সুযোগ খুব একটা নেই।
“আমি অবাক হয়ে ভাবি, এটা কি এড়ানো যেত না”- মন্তব্য করে ইউনিভার্সিটি অব অক্সফোর্ডের অধ্যাপক পল ক্লেনারম্যান বলেন, “মনে হচ্ছে ভাইরাসের বিস্তার বাড়ার সঙ্গে চলমান এই বুস্টিং কার্যক্রমও চলতে থাকবে।”