আনু মুহাম্মদ বললেন, "আমাদেরকে ক্রমাগত বলে যেতে হবে, দাবি জানাতে হবে। নিজের কাছে বলতে হবে, সমাজের কাছে বলতে হবে। এই বলার মধ্য দিয়েই সংস্কারের পথ সুগম হবে।"
Published : 19 Aug 2024, 10:05 PM
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নানা সংকট এবং সেসব থেকে উত্তরণে শতাধিক প্রস্তাব উঠে এসেছে এক মতবিনিময় সভায়। তবে সেসব প্রস্তাব রাষ্ট্রের নীতি-নির্ধারকদের কানে পৌঁছাবে কিনা, তা নিয়ে ওই সভারই একাধিক বক্তা সংশয় প্রকাশ করলেন।
তারপরও এই আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বললেন, "আমাদেরকে ক্রমাগত বলে যেতে হবে, দাবি জানাতে হবে। নিজের কাছে বলতে হবে, সমাজের কাছে বলতে হবে। এই বলার মধ্য দিয়েই সংস্কারের পথ সুগম হবে।"
সোমবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের মোজাফফর আহমেদ চৌধুরী মিলনায়তনে বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কার ভাবনা নিয়ে 'কেমন বিশ্ববিদ্যালয় চাই?' শীর্ষক এ আলোচনা অনুষ্ঠান হয়।
আনু মুহাম্মদ এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা অসংগতি নিয়েও কথা বলেন। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নানা প্রশ্ন আর প্রস্তাবে আয়োজনটি অন্য মাত্রা পায়।
মিলনায়তনে তখন বসার জায়গাও নেই। কেউ কেউ ফ্লোরে বসেই যুক্ত হন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে।
শুরুতেই আয়োজকদের পক্ষ থেকে 'কেমন বিশ্ববিদ্যালয় চাই' শীর্ষক একটি ধারণাপত্র বা রূপরেখা পড়ে শোনানো হয়। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ওই ধারণাপত্রের বিভিন্ন অংশ পড়েন।
তাদের মধ্যে ছিলেন- ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারহা তানজীম তিতিল, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সৌম্য সরকার, ইউল্যাবের অলিউর সান ও লাবণী আশরাফি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামিনা লুৎফা ও রুশাদ ফরিদী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পারভিন জলি।
পরে মিলনায়তনে দর্শক সারিতে থাকা শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কাছে জানতে চাওয়া হয়, তারা কেমন বিশ্ববিদ্যালয় চান?
একে একে আসতে থাকে প্রশ্ন ও নানা প্রস্তাব। অনেকেই হাত তুলে তাদের প্রস্তাব জানাতে চাইলেও সময় স্বল্পতার জন্য পরে সবার প্রশ্ন নেওয়া সম্ভব হয়নি।
আয়োজকদের পক্ষ থেকে তখন একটি ই-মেইল ঠিকানা দিয়ে সেখানে প্রশ্নগুলো জানাতে বলা হয়।
একজন শিক্ষক বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় কেবলই সার্টিফিকেট বিক্রির দোকান হয়ে উঠেছে।
অন্যদিকে আতাউর রহমান নামের আরেক শিক্ষক বললেন, "শিক্ষার্থীদের অনেকেই গবেষণায় আগ্রহী, কিন্তু গবেষণার জন্য একটি সিজিপিএ নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। সিজিপিএ কম থাকার কারণে অনেকে গবেষণার সুযোগ পান না। এ থেকে উত্তরণের উপায় কি?
তাঁর আরেকটি প্রশ্ন ছিল, "যোগ্যতা না থাকার পরও যারা কেবল রাজনৈতিক পরিচয়ে শিক্ষক হয়েছেন, তাদের হাত ধরে কতটা এগিয়ে যাবে বিশ্ববিদ্যালয়?"
কেউ কেউ বললেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামোতে আমূল পরিবর্তন ছাড়া কোনোভাবেই মানসম্পন্ন বিশ্ববিদ্যালয় কল্পনা করা যাবে না।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দলীয় পরিচয়ে উপাচার্য নিয়োগসহ রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি বন্ধের পাশাপাশি গবেষণা বাড়ানোরও প্রস্তাব আসে আলোচনায়।
ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্কের উন্নয়নে 'মেসেজ বক্স' চালু এবং শিক্ষার্থীদের মনস্তত্ত্ব বোঝার মত যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার প্রস্তাব করেন কেউ কেউ।
পুরো মিলনায়তন যখন প্রশ্ন আর প্রস্তাবে মুখর, তখন একজন ছাত্র বললেন, "আমরা প্রশ্ন কার কাছে করছি? এর সমাধান কে করবে?"
সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, "আমরা তো এগুলো বলছি৷ অনেকেই প্রশ্নও করছেন- কে শুনবে? এর আগেও সরকার ছিল। নতুন সরকার এসেছে। আমরা কথা বলে যাব। এই কথা বলা চালিয়ে যেতে হবে। আমরা নিজেদের কাছেই বলব, সমাজের কাছে বলব।"
সরকারের নীতি প্রণয়নের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পৃক্ততা নেই কেন, সেই প্রশ্ন তুলে আনু মুহাম্মদ বলেন, "পানি, জ্বালানী নিয়ে সরকার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, এসব নীতি প্রণয়ন বা সিদ্ধান্ত কারা নেয়, কীভাবে নেয়, আমরা জানতেও পারি না। আমাদের প্রণীত নীতিগুলোর সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কোনো সংযোগ নাই। নীতি প্রণয়ন করে দেয় এডিবি, বিশ্ব ব্যাংকের মত প্রতিষ্ঠান, সরকার নিজেও জানে না ঠিকমত। সংশ্লিষ্ট জনগণ যুক্ত থাকে না।"
সরকারি ছাত্র সংগঠন বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড’ করছে মন্তব্য করে অর্থনীতির এই সাবেক শিক্ষক বলেন, "ছাত্রলীগ তখনই সন্ত্রাসী আচরণ করে, যখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকে। তার মানে কি ছাত্রলীগ সন্ত্রাসী সংগঠন? না, বরং সরকারি দলের ছাত্র সংগঠনই সন্ত্রাসী আচরণ করে। বিশ্ববিদ্যালয়ে দলীয়করণ করতে গিয়ে উপাচার্য এবং ছাত্ররা দলীয় লেজুড়বৃত্তি করে।"
বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘মেরুদণ্ড ও নীতি নৈতিকতার’ ওপর দাঁড়াতে হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
আনু মুহাম্মদ বলেন, "উপাচার্য নিয়োগে এমন পদ্ধতি দরকার যে শিক্ষা, জ্ঞান এগুলো গুরুত্ব পেতে হবে। শিক্ষক নিয়োগের পদ্ধতিও পরিবর্তন দরকার।"
পাবলিক কলেজগুলোতে বহু পদ যে খালি, সে কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, "কঠিন সিলেবাস কিন্তু পড়ানোর মানুষ নাই। জিডিপির ৬ শতাংশ ব্যয় হলে শিক্ষাক্ষেত্রেই অসংখ্য কর্মসংস্থান তৈরি হবে। রাষ্ট্রের অর্থনীতিকে জনপন্থি করে গড়ে তুলতে হবে। এর জন্য অ্যাকাডেমিক স্বাধীনতা অনিবার্য। অর্থায়ন যেখান থেকেই আসুক, যাচাই-বাছাই করতে হবে যাতে এই স্বাধীনতা অক্ষুণ্ন থাকে।"
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুন বলেন, "এমন ব্যবস্থা করতে হবে যাতে কোনো শিক্ষক-শিক্ষার্থীকে ভিসির দরজায় যেতে না হয়। ভিসিকে চিনতে হবে কেন? অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের কথা ছাড়া কিছুই হয় না। তিন দিনের ছুটি নিলেও উপাচার্যের কাছে যেতে হয়। এটা কেন হবে?"
শিক্ষক নিয়োগপদ্ধতি ঠিক করার কথাও বলেন মামুন। শিক্ষার্থীদের আবাসন সংকটের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, "বিশ্ববিদ্যালয়ে বাজেট বরাদ্দ কমে, আর সরকারি ছাত্র সংগঠন আনন্দ মিছিল করে। এদিকে ছাত্ররা পড়ার টেবিল পায় না, ঘুমানোর জায়গা নাই। সেই শিক্ষার্থীদের কাছে আমরা কী করে অনেক কিছু আশা করি?"
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম বলেন, "ভারত-পাকিস্তানে যদি ভালো বিশ্ববিদ্যালয় থাকতে পারে, আমাদের নেই কেন? খুব খারাপ অবস্থায়ও ভালো বিশ্ববিদ্যালয় হতে পারে। এখানে কাঠামোর সংকট রয়েছে। কাঠামোতে যেন স্বৈরাচারের বিস্তার ঘটাতে না পারে। কাঠামো ঠিক থাকলে খারাপ পরিবেশেও ভালো বিশ্ববিদ্যালয় হতে পারে। কাঠামো ঠিক করতে হবে।"
বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া যে এখন আর ‘ইজ্জতের ব্যাপার’ নয়, এটা রাষ্ট্রের জন্য ‘বিরাট ক্ষতি’ বলেন মন্তব্য করেন অধ্যাপক আজম।
তিনি বলেন, "গবেষণার কোনো কাঠামো তৈরি করা হয় নাই। শিক্ষায় টাকা নাই। পাঁচ বছরের মধ্যে রূপরেখা দিন, যাতে জিডিপির ৪ শতাংশ ব্যয় শিক্ষায় করা যায়। সত্যিকারের, পূর্ণকালীন পিএইচডি প্রোগ্রাম চাই।"
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সৈয়দ নিজার বলেন, "আমাদের আরও বর্ধিত সুপারিশমালা দরকার দীর্ঘমেয়াদের ক্ষেত্রে। আমাদের উচিত বিশ্ববিদ্যালয়ের মডেল পরিবর্তন করা। স্বায়ত্বশাসন নিয়ে পুনর্বিবেচনা দরকার, এই স্বায়িত্বশাসন উপাচার্যকে একনায়ক করে তোলে।"