এক টুকরা গরু বা খাসির মাংস দিয়ে ভাত আগে ৫০ টাকায় খাওয়া যেত হলের ক্যান্টিনগুলোতে, এখন লাগছে ৬০ টাকা।
Published : 27 Aug 2022, 10:24 AM
মাস দুয়েক আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের যে খাবার কিনতে ৩৫ থেকে ৪০ টাকা খরচ হত, এখন তাতে ৪০ থেকে ৫০ টাকা লাগছে।
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে আবাসিক হলের ক্যান্টিনগুলোতে খাবারের দাম বাড়াতে হয়েছে বলে দাবি ক্যান্টিনগুলোর ইজারাদাতাদের।
তবে শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, দাম বাড়লেও খাবার মান দিন দিন পড়ছে। আর এদিকে কোনো দৃষ্টি নেই কর্তৃপক্ষের।
ক্যান্টিনের চেয়ে হলের মেসগুলোতে খাবারের দাম কম হলেও দুটি হলে সেই মেসও বন্ধ।
শিক্ষার্থীরা প্রাত্যহিক এই খাবারে ভর্তুকি দেওয়ার দাবি তুলেছেন।
গত এক সপ্তাহে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোর অধিকাংশ ক্যান্টিন ঘুরে দেখা যায়, মাছ, মাংস, ডিম থেকে শুরু করে প্রায় প্রতিটি খাবারের দাম পাঁচ থেকে ১০ টাকা বেড়েছে। এক টুকরা গরু বা খাসির মাংস দিয়ে ভাত আগে ৫০ টাকায় খাওয়া যেত, এখন তা ৬০ টাকা লাগছে। সম্প্রতি ডিমের দাম বেড়ে যাওয়ায় আরও বিপাকে পড়েন শিক্ষার্থীরা।
এদিকে খাবারের দাম বাড়লেও মাছ, মাংসের টুকরা আরও ছোট হয়েছে; ভাতের দাম বাড়লেও পরিমাণে কম এবং মোটা চাল খাওয়ানো হচ্ছে।
ক্যান্টিনের রান্নাঘরগুলোতে গিয়ে দেখা যায়, অস্বাস্থ্যকর ও স্যাঁতসেঁতে পরিবেশে খাবার প্রস্তুত করা হচ্ছে। রান্নায় ব্যবহার করা হচ্ছে নিম্নমানের তেল, মসলা ও টেস্টিং সল্টসহ অস্বাস্থ্যকর বিভিন্ন উপকরণ।
আবাসিক এসব হলে শিক্ষার্থীদের খাবারের জন্য দুই ধরনের ব্যবস্থা আছে। একটি হলো ডাইনিং (মেস নামে পরিচিত), অন্যটি ক্যান্টিন। হল প্রশাসনের নির্ধারিত স্থানে শিক্ষার্থীদের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয় মেস। সেখানে শিক্ষার্থীরাই বাজার করেন ও হিসাব রাখেন। আর ইজারা বা ভাড়া নেওয়া ব্যবসায়ীদের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয় ক্যান্টিন।
মেস কিংবা ডাইনিং দুটিতেই গ্যাস-বিদ্যুৎ ও পানির বিল হল কর্তৃপক্ষ বহন করে। তবে মেসে হাড়ি-পাতিলসহ রান্না ও খাওয়ার যাবতীয় উপকরণ হল কর্তৃপক্ষ সরবরাহ করে।
এর বাইরে হলে ভেতরে বা সামনের দোকানে রান্না করা খাবার বিক্রি হয়। তবে তার দাম ক্যান্টিনের চেয়েও বেশি।
কী বলছে শিক্ষার্থীরা?
সলিমুল্লাহ মুসলিম (এসএম) হলের শিক্ষার্থী আরিফুল ইসলাম বলেন, ক্যান্টিনে খাবারের মান এত নিচে নেমেছে যে এক প্লেট ভাত কষ্ট করে খেতে হয়। খাওয়ার পর মনে হয় বমি আসবে। খাবার নিয়ে অশান্তি থাকলে মন-মেজাজ তো ভালো থাকে না।
“টিউশন করে চলতে হয়, চাইলে তো প্রতিবেলা হলের দোকানে বেশি টাকা দিয়ে খেতে পারি না। অন্যান্য হলের শিক্ষার্থীরা মেসে কম টাকায় ভালো খাবার খেতে পারছে, কিন্তু আমাদের হলের মেস বন্ধ।”
এই হলের আরেক শিক্ষার্থী মিজানুর রহমান বলেন, “ওজনে বেশি পাওয়া যায়, যেমন ঢেঁড়শ, বেগুন দিয়ে ক্যান্টিনে তরকারি রান্না করা হয়। সবজি থাকলে সেটা পুঁইশাক। দামে কম। মাঝে মধ্যে এগুলো সেদ্ধ করে সবজি হিসেবে রাখা হয়। হিমায়িত মাংস এনে এক টুকরো ৫৫-৬০ টাকা নেওয়া হয়। ডাল তো মুখেই নেওয়া যায় না।”
আরেক শিক্ষার্থী নাসিমুল হুদা বলেন, “ক্যান্টিনে অনেক সময় মাছে আঁশ থেকে যায়, গন্ধ আসে। ভালোভাবে পরিষ্কার করা হয় না।”
মাস্টারদা সূর্যসেন হলের শিক্ষার্থী তুহিন এমরান বলেন, হল প্রশাসনের নিয়মিত নজরদারি না থাকায় আজকে এই অবস্থা।
“মাঝে মধ্যে হল প্রশাসন শিক্ষার্থীদের অভিযোগের ভিত্তিতে ক্যান্টিন মালিক পরিবর্তন করেন, কিন্তু কর্মচারী ও রান্নার পরিবেশ আগের মতোই থেকে যায়। ফলে খাবারের মান বা স্বাদ বাড়ছে না।”
মেসে খেতে হলে সদস্য হয়ে নিয়মিত খেতে হয়। তাই অনেকে মেসে না খেয়ে ক্যান্টিনেই খান।
ছাত্রদের হলে মেস থাকলেও ছাত্রীদের হলে মেস ব্যবস্থা নাই, রয়েছে একাধিক ক্যান্টিন। ছাত্রীদের অনেকেই রান্না করেও খেতে পারেন। তবে ছেলেদের হলে গ্যাসের ব্যবস্থা না থাকায় অনেকেই বৈদ্যুতিক চুলায় রান্না করে খান।
বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলের শিক্ষার্থী সিফাত তাসনিম বলেন, ক্যান্টিনে খাবারের খুবই বাজে অবস্থা। আমরা খেতে পারি না। খাবারে মাঝে মাঝে চুল, পোকা-মাকড় পাওয়া যায়। খাবারের স্বাদ, মান কোনো কিছুই ঠিক নাই।
“এমনকি আমাদের হলের দুইটা পানির ফিল্টার প্রায় ছয় সাত মাস ধরে নষ্ট। লাইনের পানি খেতে হচ্ছে। হল কর্তৃপক্ষকে বলা হলেও গুরুত্ব দেন না।”
আরেক শিক্ষার্থী নীতি চাকমা বলেন, খাবারের অবস্থা খুবই বাজে। দাম বাড়িয়েছে, পরিমাণেও কম দিচ্ছে। খাবারের আইটেমও কমেছে।
“আগে একবেলা গড়ে ৩০ থেকে ৪০ টাকায় খাওয়া যেত। এখন ৪০ থেকে ৫০ টাকা লাগছে। মেয়েদের হলে মেস নাই। সিনিয়ররা অনেকেই নিজে রান্না করে খায়। তবে জুনিয়র শিক্ষার্থীদের বাধ্য হয়েই ক্যান্টিনে খেতে হয়।”
ঢাবিতে পচা খাবার: শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে ক্যান্টিন বন্ধ
রোকেয়া হলের শিক্ষার্থী মারুফা আক্তার বলেন, প্রতিটি খাবারে ৫ থেকে ১০ টাকা বেড়েছে। তবে ক্যান্টিনের খাবারে স্বাদ পাওয়া যায় না। মোটা চাল ও পাতলা ডাল খেয়েই বাঁচতে হচ্ছে।
'পচা' খাবার পরিবেশনের অভিযোগে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের পর শুক্রবার কবি জসীম উদ্দীন হলের ক্যান্টিন বন্ধ করে দিয়েছে হল কর্তৃপক্ষ।
এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯টি হলের মধ্যে তুলনামূলকভাবে কম টাকায় ভালো খাবারের সুনাম রয়েছে জগন্নাথ হলের। এ হলের প্রাধ্যক্ষকেও নিয়মিত ক্যান্টিনগুলোতে নজরদারি করতে দেখা যায়। কিন্তু সম্প্রতি দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাওয়া সেখানেও মান কমেছে বলে শিক্ষার্থীদের অভিযোগ।
হলটির শিক্ষার্থী সুজন সেন গুপ্ত বলেন, জগন্নাথ হলে খাবার খেতে আগে অন্যান্য হলের শিক্ষার্থীরা ভিড় করত। এখন খাবারের দাম বাড়লেও, মান আর স্বাদ দুটোই কমেছে। অপরিচ্ছন্ন খাবার খেতে খেতে বিতৃষ্ণা এসে গেছে।
“ক্যান্টিন বয়গুলোও যাচ্ছেতাইভাবে কাজ করে। আর একটু দেরি হলেই খাবার পাওয়া যায় না। মাঝেমধ্যে পোকা-মাকড় পেলে ফেলে দিয়ে খেতে হয়। হলগুলোর কর্মচারী, ক্যান্টিন মালিকদের স্টুডেন্টদের নিয়ে কোনো আন্তরিকতা নেই।”
ক্যান্টিন ইজারাদাররা ‘অসহায়’
জিনিসপত্রের দাম বাড়ার কারণে ক্যান্টিনের খাবারের দাম ‘কিছুটা’ বাড়াতে হয়েছে বলে ক্যান্টিন ইজারাদারদের ভাষ্য। তবে ‘কম টাকায় শিক্ষার্থীদের ভালো খাবার খাওয়াতে’ তাদের আন্তরিকতার ঘাটতি নেই বলে তাদের দাবি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকটি হলের ক্যান্টিন ইজারাদার বলেন, ছাত্রলীগের পদধারী নেতারা অনেকে ‘ফাও’ খান, খেয়ে নিয়মিত টাকা দেন না। অনেকে নেতাকে রুমে খাবার দিয়ে আসতে হয়।
ক্যান্টিনে নগদ টাকা দিয়ে খাওয়ার নিয়ম থাকলেও নেতারা মাসের পর মাস খেয়ে টাকা দিচ্ছেন না বলে অভিযোগ তাদের।
তাদের ভাষায়, টাকা চাইলে খাবার ভালো না বলে ক্যান্টিন ছেড়ে দেওয়ার হুমকি দেন। মাঝে মাঝে নেতাদের কেউ কেউ কিছু টাকা দিলেও প্রাপ্য টাকা পাচ্ছেন না। ফলে সেই লোকসান সাধারণ শিক্ষার্থীদের উপর গিয়ে বর্তায়।
এসএম হলের ক্যান্টিনের ইজারাদার জুয়েল মিয়া বলেন, “আমরা তো ভালো খাওয়ানোর চেষ্টা করি। জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে, সবকিছুই তো বিবেচনা করতে হয়।
“হল প্রশাসন যে রেইট নির্ধারণ করে দেয়, এই দামে আমরা পোষাতে পারছি না। হলের দোকানে শিক্ষার্থীরা ৬০-৭০ টাকায় খাবার খায়। আমরা যদি ওই দাম রাখতাম, তাহলে খাবার মানসম্মত করা যেত। কিন্তু ক্যান্টিনে তো এটা করা যাচ্ছে না।”
মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলের ক্যান্টিন ইজারাদার শাহাবুদ্দিন বলেন, “দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির তুলনায় খাবারের দাম তেমন বাড়ানো হয়নি। আমরা তো লস দিয়ে ক্যান্টিন চালাতে পারি না। কর্মচারীদের তো বেতন দিতে হয়।”
হাজী মুহাম্মদ মুহসিন হলের ক্যান্টিন পরিচালক আলমগীর হোসেন বলেন, “চাল, ডাল, তরি-তরকারি সবকিছুর দাম বেড়েছে। আমাদের তো কিছু করার নেই।
“মেসে কর্মচারী বা থালা-বাসনের খরচ নাই। শিক্ষার্থীরা নিজেরা পরিচালনা করে। কিন্তু ক্যান্টিনে তো কর্মচারীদের বেতন দিতে হয়, থালা-বাসন সবকিছু কিনতে হয়।”
‘আন্দোলন হলেও ফলাফল নেই’
বিশ্ববিদ্যালয়ের খাবারের মান ও দাম নিয়ে কয়েকটি ছাত্র সংগঠন সরব থেকে দীর্ঘদিন আন্দোলনে করে এলেও তাতে কোনো পরিবর্তন আসেনি। ছাত্রলীগও বিভিন্ন সময় খাবারের মান বৃদ্ধিসহ শিক্ষার্থীবান্ধব দাবির কথা বললেও তা নিয়ে বড় কোনো আন্দোলনে যায়নি।
সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি রাজিব কান্তি রায় বলেন, “প্রত্যেকটা হলেই খাবরের দাম বেড়েছে, কিন্তু মান বাড়েনি। এক শিক্ষার্থীকে এখন এক বেলা খেতে হলেও ৫০ থেকে ৬০ টাকা খরচ করতে হয়। তাও খুব ভালো কিন্তু খেতে পারছে না।
“আমরা শুরু থেকে বলে আসছি, ক্যান্টিনগুলোতে হল প্রশাসনের একটা ভর্তুকি দিতে হবে। হল কর্মচারীদের দিয়ে পরিচালনা করতে হবে। ক্যান্টিনগুলো কিন্তু ইজারা দেওয়া হয়। ক্যান্টিন মালিকরা তো চাইবেই কীভাবে মুনাফা করা যায়। তারা তো এখানে ব্যবসা করছে।”
ক্যান্টিনে ‘ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের’ পদধারীরা ‘ফ্রি’ খাওয়া-দাওয়া করেন এবং বিভিন্ন সময় চাঁদাবাজিও করেন বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
তিনি বলেন, “ইজারা দেওয়ার সময় হল প্রশাসনও একটা অংশ নেন। ছাত্রলীগের নেতারা তো ফাও খাচ্ছেই, চাঁদাবাজিও করছে। এই সঙ্কট নিরসনে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও নীরব। কোনো ভর্তুকিও দিচ্ছে না। স্টুডেন্টদের ভোগান্তি বাড়ছে। যদি চাঁদাবাজি বন্ধ করা যেত এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নিয়মিত নজরদারি করত, তাহলে খাবারের মান এত নিচে নামত না।”
খাবারের মান ও ফাও খাওয়া নিয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন বলেন, সাংগঠনিক পরিচয় ব্যবহার করে কোনো ধরনের নেতিবাচক ফায়দা হাসিল করার সুযোগ নেই। এ ধরনের ঘটনা ঘটার সুযোগ নেই; যদি ঘটে থাকে সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট হল প্রশাসন ব্যবস্থা নিতে পারে।
“আমাদের কাছে কারও বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট অভিযোগ এলে আমরা ব্যবস্থা নেব।”
ডাকসুর সাবেক এই এজিএস বলেন, “দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির প্রভাব যাতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে না পড়ে, সেটির জন্য উদ্যোগ নিতে আমরা প্রশাসনের কাছে আহ্বান জানিয়েছি।
“প্রয়োজনে কৃষি মন্ত্রণালয় বা খাদ্য মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে আমাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি, চাল, ডাল, আটা সংগ্রহ করা যায় কি না, সেই পদক্ষেপ নিতে হবে। আর অবশ্যই হলগুলোর অভ্যন্তরে যৌক্তিক দামে মানসম্মত, পুষ্টিকর খাবার দিতে হবে।”
কী বলছে প্রশাসন?
বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক নিলুফার পারভীন বলেন, “আমি নিজেও প্রায় দিন হল ক্যান্টিনে খাই। সেখানে খাতা দেওয়া আছে। শিক্ষার্থীদের কোনো অভিযোগ থাকলে লিখিতভাবে আমাদের জানাতে পারে। পানির ফিল্টারের অভিযোগ পাওয়ার পর সেটা ঠিক করা হয়েছে।
“এখন যেহেতু অভিযোগ এসেছে, আমরা দ্রুতই হাউজ টিউটরদের নিয়ে বসব। কীভাবে খাবারের মান ভালো করা যায় সেটা নিয়ে আলোচনা করব। মনিটরিং বাড়ানো হবে।”
এদিকে মেসে কম টাকায় ভালো খাওয়া গেলে সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ও মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলের মেস দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ রয়েছে।
হল প্রশাসনের দাবি, শিক্ষার্থীরা দায়িত্ব নিয়ে পরিচালনা করতে আগ্রহী না হওয়ায় এটি বন্ধ রয়েছে। সম্প্রতি মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলের মেসকে ক্যান্টিনে রূপান্তর করতে মেস পরিচালকের জন্য বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে।
তবে শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, ছাত্রলীগ নেতারা মেসে গিয়েও হস্তক্ষেপ করায় তারা দায়িত্ব নিতে আগ্রহী হচ্ছেন না।
এ বিষয়ে মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক মোহাম্মদ বিল্লাল হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ছাত্ররা মেস চালাতে আগ্রহী হচ্ছে না, তাই এটা ক্যান্টিন হিসেবে চালু করা হচ্ছে। কোনো শিক্ষার্থী মেসের ম্যানেজার হওয়ার দায়িত্ব নিচ্ছে না, কিন্তু ইচ্ছা করছে কম দামে খেতে। রমজান মাসে এটা চালু ছিল, তারপর আর কেউ দায়িত্ব নিচ্ছে না।
“ছাত্রদের একটা জায়গায় খেতে সমস্যা হয়, সেজন্য বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে। ছাত্ররা যেহেতু চালাচ্ছে না। সুতরাং এটা তো এ অবস্থায় পড়ে থাকতে পারে না।”
শিক্ষার্থীদের অনেকে হলের কর্মচারীদের দিয়ে মেস পরিচালনার প্রস্তাব দিয়েছেন, যেমনটা ডাকসু ক্যাফেটারিয়া বা টিএসসি ক্যাফেটারিয়া পরিচালনা করা হয়।
এ বিষয়ে এই হল প্রাধ্যক্ষ বলেন, কর্মচারীরা কোনো জায়গায় মেসের ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করে না। সাধারণ শিক্ষার্থীরাই পরিচালনা করে থাকে। হল প্রশাসন এটা তত্ত্বাবধান করে এবং লজিস্টিক সাপোর্ট দেয়।
সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক মজিবুর রহমান বলেন, ক্যান্টিনে নানা ধরনের সমস্যা আছে। একটা কমিটি করা হয়েছে যাতে এটা মনিটরিং করেন।
“মেসের বিষয়ে আমরা স্টুডেন্টদের সঙ্গে বসেছি। কিন্তু কেউই এগিয়ে আসছে না। আমরা সব ধরনের সহযোগিতা করতে রাজি।”
ক্যান্টিনগুলোর খাবারে পুষ্টির মান নিয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের শিক্ষক অধ্যাপক নিজামুল হক ভূইয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, আসলে কার্বোহাইড্রেট তো আমরা ভাত থেকে পাচ্ছি। কিন্তু যে পরিমাণ প্রোটিন জাতীয় খাবার খাওয়া উচিত, সবকিছুর দাম বেড়ে যাওয়াতে দেখা গেছে মাছ-মুরগির টুকরা আরও ছোট হয়েছে। অর্থাৎ প্রোটিনটা শিক্ষার্থীরা কম পাচ্ছে।
“তরি-তরকারির দাম বেড়ে গেছে। ভেজিটেবল আগে যে পরিমাণ দিত, সেটাও কমে গেছে। সেক্ষেত্রে আমরা আশা করব, সরকার যাতে এই ক্রাইসিস মোমেন্টে শিক্ষার্থীদের দিকে দৃষ্টি দেয়। সংকট কিন্তু সব সময় থাকবে না। কিন্তু আমাদের শিক্ষার্থীদের যে পরিমাণ পুষ্টিকর খাবার খাওয়া প্রয়োজন, তা তারা পাচ্ছে না।”
খাবারের মান উন্নয়নের বিষয়টা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের নজরে আনবেন জানিয়ে শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক নিজামুল বলেন, “মাননীয় উপাচার্যের সঙ্গে আমি কথা বলব, কীভাবে শিক্ষার্থীদের আরও ভালো খাবারের ব্যবস্থা করতে পারি।
“সরকারেরও উচিত হলের শিক্ষার্থীদের খাবারে সাবসিডি দেওয়া। এই আপৎকালীন সময়ে সরকার আমাদের কিছু সাবসিডি দিলে আমরা ক্রাইসিসটা দূর করতে পারব। আমাদের শিক্ষার্থীদের ন্যূনতম চাহিদা মেটাতে পারলেও হয়।”
ক্যান্টিনগুলোতে নিয়মিত নজরদারি না থাকার অভিযোগের বিষয়ে প্রভোস্ট স্ট্যান্ডিং কমিটির সভাপতি ও বিজয় একাত্তর হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক আবদুল বাছির বলেন, প্রত্যেক হলেই মনিটরিংয়ের জন্য কয়েকজন হাউজ টিউটরদের নিয়ে একটি কমিটি আছে, যারা প্রতিদিন অন্তত একবার সেগুলো দেখে আসে।
“সেটা কিন্তু আমাদের হলে আছে। আমি কিন্তু প্রতিদিন যাই। এ ধরনের অভিযোগ শিক্ষার্থীদের কাছে পাই না।”
ভর্তুকির বিষয়ে তিনি বলেন, “এটা তো বিশ্ববিদ্যালয় করবে। নেক্সট সভায় আমরা মাননীয় উপাচার্যকে অনুরোধ করব, যদি বিশ্ববিদ্যালয় বা সরকারের দিক থেকে কিছু একটা করা যায়। সাবসিডি দিয়ে তাদের পাশে যদি থাকা যায়, সেটা আমরা অনুরোধ করব।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ও প্রভোস্ট স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্য সচিব অধ্যাপক একেএম গোলাম রব্বানী সবগুলো বিষয়ে দৃষ্টি দিয়ে বলেন, কোন হলে খাবারের মান খারাপ, কারা ফাও খায়, এসব নিয়ে সুনির্দিষ্টভাবে অভিযোগ নেই।
“আমরা ইতোপূর্বে এই বিষয়গুলো নিয়ে প্রভোস্ট কমিটিতে আলোচনা করেছি। যেহেতু খাবারের দাম এখন বৃদ্ধি পেয়েছে, সবকিছু বিবেচনা করে পরবর্তী প্রভোস্ট কমিটিতে এটা আলোচনা করা হবে।”
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান বলেন, “বিষয়টা নিয়ে আমরা শিগগিরই প্রভোস্টদের সঙ্গে বসব। যে দুটি হলের মেস বা ডাইনিং বন্ধ রয়েছে তা চালু করার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হবে।”