গুচ্ছ থেকে বিযুক্ত হতে চান জগন্নাথের শিক্ষকরা

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি বলে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীরা রয়েছেন দুর্ভাবনায়।

সাবিকুন্নাহার লিপিসাবিকুন্নাহার লিপিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 March 2023, 03:24 AM
Updated : 12 March 2023, 03:24 AM

কয়েক বছর আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিতে গুচ্ছ পদ্ধতি চালুর পর নেতৃত্বের ভূমিকায় ছিল যে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, সেই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা এখন এ থেকে বেরিয়ে আসতে চান।

সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন থেকে যখন অন্য সব বিশ্ববিদ্যালয়কেও আনতে চাইছে, তখনই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি বিপরীত দিকে হাঁটতে চাইছে।

শিক্ষকরা কারণ হিসেবে নিজস্বতা হারানো, কাঙ্ক্ষিত ছাত্র না পাওয়ার বিষয়গুলো তুলে ধরেছেন। তবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এখনও এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়নি।

কোভিড মহামারীর সময়ে ভর্তিচ্ছুদের দুর্ভোগ এড়াতে ২০২০-২১ ‍শিক্ষাবর্ষ থেকে গুচ্ছ পদ্ধতিতে পরীক্ষা নেওয়া শুরু হয়। শুরুতে ১৯টি সাধারণ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এ পদ্ধতিতে পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্তে আসে। পরে ২২টি বিশ্ববিদ্যালয় সাধারণ গুচ্ছে অংশ নেয়।

ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এই প্রক্রিয়ায় আসেনি।

গুচ্ছ পদ্ধতির শুরু থেকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়েই হত এই সংক্রান্ত বৈঠকগুলো; সমন্বিত সিদ্ধান্তগুলোও আসত এই বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমেই।

তবে তিন বছর পর তা নিয়ে দ্বিধা দেখা দেওয়ায় চলতি শিক্ষাবর্ষ থেকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় গুচ্ছ পদ্ধতির ভর্তি পরীক্ষায় থাকবে কি না, সে সিদ্ধান্ত নিতে ২২ ফেব্রুয়ারি বিশেষ একাডেমিক সভা বসার কথা ছিল। দুই দফা পিছিয়ে সভার তারিখ ১৫ মার্চ নির্ধারণ করা হয়েছে।

এইচএসসির ফল প্রকাশের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ভর্তি পরীক্ষার আবেদন নেওয়া ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। ভর্তি পরীক্ষা শুরুর তারিখও ঠিক হয়েছে ২৯ এপ্রিল। চট্টগ্রাম এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েও ২০ ও ১৫ মার্চ থেকে আবেদন নেওয়া শুরু করছে।

কিন্তু জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এখনও সিদ্ধান্ত নিতে না পারায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক আইনুল ইসলাম।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অন্যরা পরীক্ষার তারিখ দিয়ে দিচ্ছে, আমরা মিটিংয়েই বসতে পারছি না।”

ভর্তিচ্ছুরা ভাবনায়

গুচ্ছ পদ্ধতিতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থাকবে কি, থাকবে না এই সিদ্ধান্ত এখনও না আসায় প্রস্তুতি নিয়ে চিন্তিত ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীরা।

ঢাকা সিটি কলেজ থেকে এবার উচ্চ মাধ্যমিক পাস করা মরিয়ম আক্তার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “একবার শুনি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় গুচ্ছে থাকবে, আরেকবার শুনি থাকবে না।

“এটা যেহেতু ঢাকার মধ্যে একটা বিশ্ববিদ্যালয়, তাছাড়া ভালো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটাও- তাই আমার পরীক্ষা দেওয়ার ইচ্ছা আছে, কিন্তু সিদ্ধান্ত না আসায় প্রস্তুতি নিতে পারছি না। কারণ গুচ্ছে থাকলে এক রকম, আলাদা হলে আরেক রকম প্রস্তুতি।”

রংপুরের সরকারি বেগম রোকেয়া কলেজ থেকে এবার উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়া ফারিয়া জান্নাতের চাওয়া, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বতন্ত্র পরীক্ষা হোক।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ভর্তি পরীক্ষার সময় যত ঘনিয়ে আসছে, মাথার উপর চাপও বেড়ে যাচ্ছে সমানতালে। তবে সবচেয়ে বেশি চিন্তা গুচ্ছকে নিয়ে। কারণ কোনো কারণে সেদিনের পরীক্ষা খারাপ হলে, অনেকগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বপ্ন হাতছাড়া হয়ে যাবে।”

আরেক ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থী রুবেল হাসান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যাই সিদ্ধান্ত নিক, আমাদের দ্রুত জানিয়ে দেওয়া হোক। এটা আমাদের জন্য বড় একটা পেইন।”

গুচ্ছভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থী ভর্তির জন্য মানবিক, বাণিজ্য ও বিজ্ঞান- তিনটি গুচ্ছে ১০০ নম্বরের ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া হয় এমসিকিউ পদ্ধতিতে। সেই ফলাফলের ভিত্তিতে মেধাতালিকা প্রকাশ করার পর বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিজস্ব শর্ত অনুযায়ী শিক্ষার্থী ভর্তি করায়।

জগন্নাথ শিক্ষকদের আপত্তি যেখানে

বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘গুণগত মান’ ফেরাতে এই পদ্ধতি থেকে বেরিয়ে স্বতন্ত্রভাবে ভর্তি পরীক্ষা নিতে চায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি।

সমিতির সভাপতি অধ্যাপক আইনুল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দীর্ঘদিন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আলাদা একটা ঐতিহ্য ছিল, স্বকীয়তা ছিল; সেটা আমরা হারিয়েছি। আমরা মানসম্মত শিক্ষার্থী পাচ্ছি না।

“আমরা নিজেদের মতো করে ছাত্র ভর্তি করাতাম, মানসম্মত ছাত্র পেতাম, সেজনজট ছিল না- সবকিছু মিলিয়ে আমরা বেটার ছিলাম।”

গুচ্ছ পদ্ধতি ভর্তিতে দীর্ঘসূত্রতা থাকার কথাও বলেন তিনি।

ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন, নাট্যকলা, চারুকলা ও সংগীত বিভাগে শিক্ষার্থী ভর্তির জন্য জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় বরাবরই আলাদাভাবে লিখিত, ব্যবহারিক ও মৌখিক পরীক্ষা নিত। বাড়তি যোগ্যতা চাওয়া হত বলে আলাদাভাবে বিজ্ঞপ্তিও দেওয়া হত।

তবে গুচ্ছ পদ্ধতিতে আসার পর ‘যোগ্য’ শিক্ষার্থী পেতে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে বলে দাবি করছেন বিভাগগুলোর শিক্ষকরা।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক জুনায়েদ হালিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যদিও গুচ্ছ পরীক্ষার পর আমরা একটা পরীক্ষা নিয়েছি, তারপরও আমরা সরাসরি নিতে চাই।

“তাহলে রিয়েলি ইন্টারেস্টেড ছেলে-মেয়ে অ্যাপ্লিকেশন করবে, এখন সেরকম পাওয়া যাচ্ছে না। গুচ্ছ পদ্ধতিতে একটা পর্যায় পর্যন্ত চলে আসে নম্বর, রেজাল্ট মিলিয়ে কিন্তু তাদের মধ্যে কোয়ালিটি থাকে না। যারা এই বিষয়ে আসলেই পড়তে চায় আমরা সেরকম স্টুডেন্ট চাই।”

“শুধু আমাদের বিভাগগুলোর জন্যই না, সব বিভাগগুলোর জন্যই আমরা গুচ্ছের বাইরে থাকতে চাই- সেটা আমাদের নিজস্বতার বড় মাপকাঠি,” বলেন তিনি।

সিদ্ধান্তের অপেক্ষা

শিক্ষকরা একভাবে ভাবলেও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ভাবনাটি ভিন্নরকম।

বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ কামালউদ্দীন আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যেহেতু মহামান্য রাষ্ট্রপতি এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী উনারা চান (গুচ্ছ ভর্তি), আমাদের তো এটার বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই।”

সিদ্ধান্ত কী হচ্ছে- জানতে চাইলে তিনি বলেন, “একাডেমিক কাউন্সিলে কথা-বার্তা হোক, তারপর সব ফাইনাল হবে। আমরা অপেক্ষা করছি।”

গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষার আয়োজন দ্রুত করতে ইতোমধ্যে আহ্বান জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)।

এদিকে গুচ্ছভুক্ত সব বিশ্ববিদ্যালয় এবারও একই পদ্ধতিতে থাকতে চায় বলে উপাচার্যদের এক সভা শেষে গত ১৮ ফেব্রুয়ারি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানিয়েছিলেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমদ, যিনি এখন গুচ্ছভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সমন্বিত ভর্তি কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক।

সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার আবেদন কবে শুরু হবে- জানতে চাইলে অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন শুক্রবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা কাজ করছি এর উপরে; তাড়াতাড়িই তারিখ দিয়ে দেব।”

Also Read: গুচ্ছ ভর্তি: সমন্বিত সব বিশ্ববিদ্যালয়ের 'থাকার' সিদ্ধান্ত

Also Read: বিশ্ববিদ্যালয়ের গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা দ্রুত আয়োজনের আহ্বান ইউজিসির