নতুন আইনের খসড়ায় ‘ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণগ্রহীতা’র সংজ্ঞা নির্ধারণসহ তাদের বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার সুযোগ রাখা হচ্ছে।
Published : 28 Mar 2023, 07:56 PM
ব্যাংকে এক পরিবারের তিনজনের বেশি পরিচালক হতে পারবেন না, এমন বিধানের পাশাপাশি ‘ইচ্ছাকৃত’ ঋণ খেলাপিদের বিষয়ে কঠোর হওয়ার বিধান রেখে আবারও ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন হচ্ছে।
মঙ্গলবার এ আইন সংশোধনের খসড়ায় চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে সরকার।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে তার কার্যালয়ে মন্ত্রিসভার বৈঠকে তা অনুমোদন দেওয়ার কথা জানিয়েছেন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব (সমন্বয় ও সংস্কার) মো. মাহমুদুল হোসাইন খান।
বৈঠকের পর সচিবালয়ে এক ব্রিফিংয়ে তিনি বলেন, “ব্যাংক-কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদে একক পরিবারের সদস্য সংখ্যা নির্ধারণ। এটা আগে ছিল চার, এটাকে তিন করা হয়েছে। কোনো একটা পরিবারের সর্বোচ্চ তিনজন একটা ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে সদস্য হিসাবে থাকতে পারবেন।”
নতুন আইনে ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণগ্রহীতাদের বিষয়ে একগুচ্ছ পদক্ষেপ নেওয়ার পাশাপাশি এর সংজ্ঞা নির্ধারণের কথাও সাংবাদিকদের প্রশ্নে তুলে ধরেন মাহমুদুল হোসাইন।
পাঁচ বছর আগে সংসদের ভেতরে ও বাইরে সমালোচনার মধ্যেই ২০১৮ সালের ১৬ জানুয়ারি ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করে কোনো ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে একসঙ্গে এক পরিবারের চার সদস্য থাকার সুযোগ দেওয়া হয়; এর আগে যা ছিল দুই জন।
এরপর ব্যাংক খাতের অনিয়ম দুর্নীতি নিয়ে ধারাবাহিক সমালোচনা এবং সুশাসন ফেরাতে বিভিন্ন মহলের দাবির প্রেক্ষাপটে আইনটি আবার সংশোধনের উদ্যোগ নেয় সরকার। ২০২১ সালের ১৭ মে এজন্য সংশোধনের খসড়ায় নীতিগত অনুমোদন দেয় মন্ত্রিসভা।
এবার পরিচালক সংখ্যা কমিয়ে আনা এবং ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থার বিধান যোগ করার প্রস্তাব করা হয়েছে খসড়ায়।
ব্যাংক কোম্পানি আইন সংস্কারে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পরামর্শও ছিল। ইউক্রেইন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে অর্থনৈতিক অস্থিরতা ও বিদেশি মুদ্রা সংকটের চাপ সামাল দিতে সংস্থাটির কাছ থেকে ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ নেওয়ার সময় সমঝোতায় আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যে এ আইন সংস্কারে সম্মতি দেয় বাংলাদেশ।
মঙ্গলবার এ আইন সংশোধনের খসড়া মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের পর তা এখন অনুমোদনের জন্য সংসদে পাঠানো হবে।
ব্যাংক কোম্পানি আইন ১৯৯১ এর ভিত্তিতে বর্তমানে বাংলাদেশে ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে জানিয়ে সচিব মাহমুদুল বলেন, এটাকে আধুনিক ও যুগোপযোগী করার জন্য সংশোধনী প্রস্তাব আনা হয়েছে। প্রস্তাবিত আইনে মোট ৩৪টি ধারা রয়েছে।
তিনি ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধনের খসড়ার বিষয়বস্তু তুলে ধরে ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণ গ্রহীতার সংজ্ঞা নির্ধারণ করা হয়েছে বলে জানান।
এমন খেলাপিদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ব্যাংক বিদেশ গমনে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারবে। এছাড়া ট্রেড লাইসেন্স ইস্যুতে নিষেধাজ্ঞা এবং বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি), যৌথ মূলধনী কোম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদপ্তরের (আরজেএসসি) কাছে কোম্পানি নিবন্ধনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারবে, বলে খসড়ায় নতুন বিধান রাখার কথা জানান তিনি।
ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপিদের তালিকা সংশ্লিষ্ট ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে সরবরাহ করবে, এমন বিধান রাখার কথা জানিয়ে সচিব বলেন, “ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণ গ্রহীতা হিসেবে তালিকাভুক্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান উক্ত তালিকা অব্যাহতি প্রাপ্তির পর বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক নির্ধারিত সময়, যা পাঁচ বছরের বেশি হবে না, অতিবাহিত না হওয়া পর্যন্ত কোনো ব্যাংক কোম্পানি বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক হতে পারবেন না।
“কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণগ্রহীতার তালিকায় আসলে বাংলাদেশ ব্যাংক তার পরিচালক পদ শূন্য ঘোষণা করতে পারবে।”
খসড়ায় প্রস্তাবিত সংজ্ঞার বিষয়ে তিনি বলেন, “ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণগ্রহীতা অর্থ- এই খেলাপি ঋণগ্রহীতা ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানি, যিনি যা বা যাহা, নিজের, তার পরিবারের সদস্যের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানির অনুকূলে কোনো ব্যাংক কোম্পানি বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান হইতে গৃহীত ঋণ অগ্রিম, বিনিয়োগ বা অন্য কোনো আর্থিক সুবিধা বা উহার অংশ বা উহার উপর আরোপিত সুদ বা মুনাফা তার সামর্থ থাকা স্বত্বেও পরিশোধ না করে।”
মিথ্যা তথ্য দিয়ে ঋণ বা আর্থিক সুবিধাকেও ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করার কথা জানিয়ে সচিব মাহমুদুল বলেন, “কোনো ব্যাংক কোম্পানি বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে জালিয়াতি, প্রতারণা বা মিথ্যা তথ্য প্রদানের মাধ্যমে নিজের বা তার পরিবারের সদস্যদের নামে আর্থিক সুবিধা গ্রহণ করলে, সেটাকেও ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপির আওতায় আনা হয়েছে।”
এছাড়া কোনো ব্যাংক কোম্পানি বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে যে উদ্দেশ্যে ঋণ অগ্রিম, বিনিয়োগ বা অন্য কোনো আর্থিক সুবিধা গ্রহণ করা হয়েছিল, সেই উদ্দেশ্য যদি সে এটা ব্যয় না করে এটাকেও ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণগ্রহীতার সংজ্ঞায় আনা হয়েছে বলেও জানান এই কর্মকর্তা।
তিনি জানান, “আইনের সংশোধনী পাস হলে ঋণ বা অগ্রিমের বিপরীতে প্রদত্ত জামানত ঋণ বা অগ্রিম প্রদানকারী কোনো ব্যাংক কোম্পানি বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের লিখিত পূর্বানুমতি ব্যতিরেকে হস্তান্তর বা স্থানান্তর করা যাবে না।”
মাহমুদুল বলেন, “অন্য আইনে যা-ই থাকুক না কেন, নোটিশ প্রদানের দুই মাসের মধ্যে ঋণ খেলাপি গ্রহীতা তার কাছে পাওনা টাকা পরিশোধ ব্যর্থ হলে অর্থ ঋণ আদালতে মামলা করা যাবে।
“কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান যদি ঋণ খেলাপির তালিকা না পাঠায়, সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক সর্বনিম্ন ৫০ লাখ এবং সর্বোচ্চ এক কোটি টাকা জরিমানা করতে পারবে। তারপরও যদি লঙ্ঘন অব্যাহত রাখে তাহলে প্রতিদিনের জন্য এক লাখ টাকা করে জরিমানা আরোপিত হবে।
“ব্যাংক সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে লেনদেন, ব্যাংক কোম্পানির পরিচালক ও তাদের পরিবারের সদস্যদের ঋণ প্রদান ও জামানত গ্রহণ- এ বিষয়টি নতুন অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।”
এ বিধানে সকলের ক্ষেত্রেই, ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য বা তার আত্মীয় যেই হোক না কেন তাকে অবশ্যই জামানত বা বন্ড বা সিকিউরিটি দিয়ে তারপর ঋণ নিতে হবে। এর বাইরে কিছু করা যাবে না, যোগ করেন তিনি।
তিনি বলেন, “ব্যাংক কোনো পরিচালক বা পরিচালকের পরিবারের সদস্যকে জামানতি ঋণ বা অগ্রিম ব্যতীত অন্য কোনো ঋণ বা অগ্রিম মঞ্জুর করবে না।
“বা পরিচালক বা পরিচালকের পরিবারের সদস্যকর্তৃক দায় গ্রহণের ভিত্তিতে জামনতি ঋণ বা অগ্রিম ব্যতীত ঋণ, অগ্রিম, গ্যারান্টি বা অন্য কোনো আর্থিক সুবিধা প্রদান করবে না।”
সচিব বলেন, “আগে হয়ত ক্ষমতার অপব্যবহার করে এগুলো করা হতো, এখন একেবারে সুনির্দিষ্ট করা হয়েছে যে, সে যেই হোক না কেন, প্রত্যেকের ক্ষেত্রে ‘কোল্যাটারাল’ থাকতে হবে। জামানত, বন্ধকি যেটাই হোক থাকতে হবে। এটা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে সবার ক্ষেত্রে।”
ব্যাংক কোম্পানির অধীনে পরিচালিত প্রতিষ্ঠান বা ফাউন্ডেশনে বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়মিত পরিদর্শন করতে পারে, সেই ধারা এখানে সংযোজনের প্রস্তাব করা হয়েছে বলেও জানান এই কর্মকর্তা।