আপত্তি নিয়েই সংশোধন হল ব্যাংক কোম্পানি আইন

বাইরে সমালোচনা এবং সংসদে বিরোধীদলীয় সদস্যদের ওয়াকআউটের মধ্যে সংশোধন হল ব্যাংক কোম্পানি আইন, এতে ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদে একসঙ্গে এক পরিবারের চার সদস্যের থাকার সুযোগ তৈরি হল।

সংসদ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 Jan 2018, 02:11 PM
Updated : 16 Jan 2018, 02:36 PM

মঙ্গলবার অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সংসদ অধিবেশনে ‘ব্যাংক-কোম্পানি (সংশোধন) বিল-২০১৮’ পাসের প্রস্তাব করলে এটি কণ্ঠভোটে পাস হয়ে যায়।

তার আগে বিলের উপর দেওয়া জনমত যাচাই, বাছাই কমিটিতে পাঠানো এবং সংশোধনী প্রস্তাবগুলো নাকচ হয়। এসময় ওয়াকআউট করেন জাতীয় পার্টির সদস্যরা।

বিরোধী দলীয় সদস্যদের অভিযোগ, সংশোধিত আইন দেশের ব্যাংক খাতকে ধ্বংস করবে।

আইনে এই সংশোধন ব্যাংকগুলোকে ‘পরিবারতন্ত্র’ কায়েমের পথ তৈরি করবে বলে অনেকের অভিযোগ। 

এসব বিরোধিতায় কান না দেওয়ার কথাই প্রকাশ পায় সংসদে আসার আগে সকালে সচিবালয়ে অর্থমন্ত্রীর কথায়।

তিনি সাংবাদিকদের প্রশ্নে বলেন, “আপত্তি থাকুক, সব সময়ই থাকে। যেসব আইন করি, তাতে অনেকেরই আপত্তি থাকে।”

এতে ব্যাংকে পরিবারের কর্তৃত্ব বাড়বে কি না- সে প্রশ্নে মুহিত বলেন, “এখন তো পুরা পরিবার কন্ট্রোল করে, আমরা তো মনে হয় স্পেসিফিক করছি।”

গত বছরের ৮ মে মন্ত্রিসভার বৈঠকে সংশোধিত আইনটির খসড়া অনুমোদনের পর থেকে ব্যাংক খাত সংশ্লিষ্টরা সরকারের এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে আসছিলেন। তারা বলছিলেন, প্রভাবশালীদের সুযোগ দিতে আইনে এই সংশোধন আনা হচ্ছে।

বিদ্যমান আইনে এক পরিবার থেকে সর্বোচ্চ দুজন সদস্য একটি ব্যাংকের পরিচালক হতে পারেন।আর তিন বছর করে পরপর দুই মেয়াদে মোট ছয় বছর একই ব্যক্তি পরিচালক হতে পারেন। এরপর তিন বছর বিরতি দিয়ে আবারও পরিচালক হতে পারেন।

বিদ্যমান আইনে অনেকেরই পরিচালক থাকার মেয়াদ শেষ হয়ে আসছিল। এর মাধ্যমে ব্যাংক পরিচালকদের কাছে সরকারের নতি স্বীকার হল বলেও মনে করেন অনেকে।

এসব সমালোচনা নিয়েই গত বছরের ১২ সেপ্টেম্বর বিলটি সংসদে তোলা হলে তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ৬০ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটিতে পাঠানো হয়।

এরপর গত অক্টোবরে সংসদীয় কমিটির সভাপতি আব্দুর রাজ্জাক বলেছিলেন, কোন যুক্তিতে আইন সংশোধনের এই প্রস্তাব আনা হয়েছে, তা অর্থমন্ত্রীর কাছে জানতে চাইবেন তারা।

সংসদীয় কমিটির বৈঠকে বেশ কয়েকজন সংসদ সদস্য আইনটি সংশোধনে আপত্তি জানালেও শেষমেশ কোনো যোজন-বিয়োজন ছাড়াই বিলটি পাসের সুপারিশ করা হয়।

এরপর মঙ্গলবার তা পাসের জন্য অধিবেশনে উত্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী মুহিত।

আইন সংশোধনের কারণ নিয়ে সংসদে লিখিত ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, “বিদ্যমান আইনের কয়েকটি ধারায় অস্পষ্টতা রয়েছে। পরিচালনা পর্ষদের পরিচালকগণ সংক্রান্ত তিনটি ধারায় অস্পষ্টতা দূর করা না হলে ব্যাংকগুলোর গতি বৃদ্ধির প্রচেষ্টা ব্যাহত হতে পারে বলে আশঙ্কা থেকে যায়।”

তিনি যুক্তি দেখান, “কোনো পরিবারের কেউ পৃথকভাবে ব্যবসা করলে এবং নিজেই করদাতা হলে তাকে পরিবারের উপর নির্ভরশীল বলা যায় না।”

বিলটির উপর জনমত যাচাই ও বাছাই কমিটিতে পাঠানোর প্রস্তাব দিয়ে স্বতন্ত্র সদস্য রুস্তম আলী ফরাজী বলেন, “বিলটি আমাদের বিস্মিত করেছে। ব্যক্তি স্বার্থের জন্য পাঁচবার করা সংশোধন হয়েছে, জনস্বার্থের জন্য নয়। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত দেওয়ার কৌশল।

“পরিচালকরা ব্যাংকিং সেক্টরের উন্নতি চায় না। আত্মীয় স্বজনের নামে ঋণ নেয়। একসময় খেলাপি হয়ে যায়। এই টাকা আদায় করা যায় না। কয়েকজন লুটেরার জন্য আইন সংশোধন করতে পারি না। তারা টাকা লুট করে বিদেশে পাঠায়।”

জাতীয় পার্টির ফখরুল ইমাম অর্থমন্ত্রীকে কটাক্ষ করে বলেন, “যখন আপনি বলেন ‘রাবিশ’; এটা দেশপ্রেম, স্বাধীনতার চেতনা থেকে বলেন। যখন বলেন, ব্যাংকে সাগর চুরি হচ্ছে, সেটাও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে বলেন।

“আপনাকে বোঝানোর কিছু নেই। আপনি জাতির গর্ব। আপনার অভিজ্ঞতার কাছে আমাদের তুলনা হয় না।”

সংসদে আনা বিলটি প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, “ব্যাংককে কেউ নিজের বলে দাবি করতে পারে না। স্পন্সর ডিরেক্টরদের স্বার্থে যদি আইন করেন তাহলে বাকি ৯০ ভাগকে বঞ্চিত করা হয়। বিলটা তুলে নিলে জাতি উপকৃত হবে।“

বিরোধীদলীয় হুইপ নুরুল ইসলাম ওমর বলেন, “একই ব্যক্তি এক পদে দীর্ঘদিন থাকলে আধিপত্য দেখা যায়। দিন দিন আমানতকারীদের সুবিধা কমানো হচ্ছে। আমানতকারীদের সুদের হার কমিয়ে দেওয়া হচ্ছে।”

নুরুল ইসলাম মিলন বলেন, “ব্যাংকিং ব্যবস্থা ধ্বংসের মুখোমুখি। অর্থমন্ত্রী বিজ্ঞ ও অভিজ্ঞ। মানুষ এখন ব্যাংকে টাকা রাখতে ভয় পায়। ২০১৭ সাল ব্যাংকখাতের দুর্যোগময় অবস্থা। বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো নিয়ন্ত্রণ আছে বলে মনে হয় না। ব্যাংক খাতকে সমূলে ধ্বংস করতে বিলটি আনা হয়েছে। বিলটি প্রত্যাহার করে নেওয়াই উচিৎ।”

রওশন আরা মান্নান বলেন, “ব্যাংক মালিকদের চাপে এই আইন সংশোধন করা হচ্ছে। দেশবাসী ব্যাংকিং খাত নিয়ে উদ্বেগে আছে।”

পরে অর্থমন্ত্রী মুহিত বিলটির যৌক্তিকতা তুলে ধরে বলেন, “দেড় থেকে দুই বছর বিলটি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। কয়েক বছর ধরে আইনটি আমরা পর্যবেক্ষণ করছি। সেই পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতেই সংশোধনের জন্য আনা হয়েছে। সংসদীয় কমিটিতে আলোচনা হয়েছে। সেখানে আমিও ছিলাম। অনেক কথার জবাব দিয়েছি। মাননীয় সদস্যরা যে প্রস্তাব দিয়েছেন তা প্রত্যাহার করে নেওয়ার অনুরোধ করছি।”

আবুল মাল আবদুল মুহিত (ফাইল ছবি)

এরপর বিরোধীদলীয় প্রধান হুইপ তাজুল ইসলাম চৌধুরী দাঁড়িয়ে ফ্লোর চাইলে অধিবেশনে সভাপতিত্বকারী ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী মিয়া বলেন, “বিল নিয়ে আলোচনার মধ্যভাগে এভাবে দাঁড়ানো কোন রুল পারমিট করে না। আমি দিতে পারছি না বলে দুঃখিত।”

ডেপুটি স্পিকার এসময় তাদের সংশোধনী প্রস্তাব নিয়ে আলোচনার সময় কথা বলার আহ্বান জানান। তবে তাজুল ইসলাম তার দলীয় সদস্যদের নিয়ে অধিবেশন কক্ষ ত্যাগ করেন।”

ওয়াকআউটের পরে অধিবেশন কক্ষের বাইরে তাজুল সাংবাদিকদের বলেন, “অর্থমন্ত্রী তার বক্তব্যে বলে দিয়েছেন বিলটি পরিবর্তন, পরিবর্ধন করার সুযোগ নেই, সংশোধনী মানা সম্ভব নয়, আপনারা সংশোধনী প্রস্তাব প্রত্যাহার করেন।

“আমাদের বিল পাসের পুরো প্রক্রিয়ায় সংসদে থাকার উদ্দেশ্য ছিল। কিন্তু আমরা সংশোধনী দেওয়ার আগেই তিনি নাকচ করে দিয়েছেন। বলে দিয়েছেন মানা সম্ভব নয়। অর্থমন্ত্রী এটা বলতে পারেন না।”

অর্থমন্ত্রী তার বক্তব্যে বাছাই কমিটিতে পাঠানোর প্রস্তাব প্রত্যাহারের অনুরোধ করেছিলেন।

বিল পাসের পর জাতীয় পার্টির সদস্যরা অধিবেশন কক্ষে ফিরে আসেন। মন্ত্রিসভায় জাতীয় পার্টির সদস্যদের এদিন অধিবেশনে দেখা যায়নি।

ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১ পাস হওয়ার পর থেকে বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে পরিচালকদের মেয়াদ-সম্পর্কিত ধারাটি পাঁচবার সংশোধন করা হয়েছে।

এই ধারায় ব্যাংকের পর্ষদে একজন পরিচালক কত বছর পরিচালক থাকতে পারবেন, সে কথা বলা রয়েছে। সর্বশেষ ধারাটি সংশোধন করা হয় ২০১৩ সালে। এবার ষষ্ঠবারের মতো সংশোধন হল।

আইনের প্রস্তাবিত সংশোধনীতে পরিচালকের মেয়াদ সংক্রান্ত ধারায় বলা হয়েছে, এই আইন কার্যকর হওয়ার পরে কোনো ব্যক্তি কোনো ব্যাংক-কোম্পানির পরিচালক পদে একাদিক্রমে নয় বছরের বেশি থাকতে পারবেন না।

একই ধারায় বলা হয়, একাদিক্রমে নয় বছর পদে থাকার মেয়াদ শেষ হওয়ার পর তিন বছর অতিবাহিত না হলে তিনি পরিচালক পদে পুনঃনিযুক্তির জন্য যোগ্য হবেন না।

এই ধারার ব্যাখ্যায় বলা হয়, কোনো ব্যক্তি পরিচালক পদে তিন বছরের চেয়ে কম সময় অধিষ্ঠিত না থাকলে একাদিক্রমে নয় বছর গণনার ক্ষেত্রে ওই সময়েও অন্তর্ভুক্ত হবে।