নতুন কেনাকাটার বাইরে কেউবা নিজের বাহনকে ঝালিয়ে নিচ্ছেন ঈদযাত্রার আগে, চকচকে করে তুলছেন নতুন রঙে।
Published : 07 Apr 2024, 10:13 AM
পুরনো মোটরসাইকেলটি এবার বদলাতে চেয়েছিলেন ইমরান হোসেন; সারা বছর জমানো টাকায় ঈদের আগেই সেই স্বপ্ন পূরণ হল তার।
ঢাকার মিরপুরের পীরেরবাগের একটি বিক্রয়কেন্দ্র থেকে বাজাজের আড়াইশ সিসির নতুন মোটরসাইকেল কিনেছেন তিনি। বললেন, অফিসে যাতায়াত ও দূরের গন্তব্যে ছোটার ভাবনা থেকেই মডেল বদলে শখের নতুন বাইক কেনা।
একটি সফটওয়্যার কোম্পানির এই কর্মী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “চাকরি পেয়ে এক সহকর্মীর কাছ থেকে ইয়ামাহার দেড়শ সিসির একটি মোটরসাইকেল কিনেছিলাম, সেটিই জীবনের প্রথম। ওই বাইক বিক্রি আর জমানো টাকায় এবার নিলাম আরেকটি।”
এবার রোজার ঈদের আগে আগে ইমরানের মত অনেক ক্রেতাই ঢু মারছেন মোটরসাইকেলের বিক্রয়কেন্দ্রে।
ঈদ ঘিরে এমন তোড়জোড় চার চাকার গাড়ির বিক্রয়কেন্দ্রগুলোতেও। ক্রেতা ধরতে চলছে অফারের ছড়াছড়ি।
নতুন কেনাকাটার বাইরে কেউবা নিজের বাহনকে ঝালিয়ে নিচ্ছেন ঈদের আগে, চকচকে করে তুলছেন নতুন রঙে।
এতে করে ব্যস্ত সময় পার করছে গাড়ির খুচরা যন্ত্রাংশ বিক্রির দোকান ও গ্যারেজগুলোও।
দুই চাকায় ঈদের হাওয়া
ঈদ উপলক্ষে টিভিএস মোটরসাইকেল ঘোষণা করেছে ‘ঈদ ডাবল ধামাকা’ অফার। এ অফারে থাকছে ১৮ হাজার টাকা পর্যন্ত ছাড়।
বিক্রেতারা বলছেন, ঈদের সময়ে বিক্রি ২০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যায়। সে কারণেই ক্রেতা আকর্ষণে তাদের ছাড়ের ছড়াছড়ি।
ঈদের কেনাকাটায় বাজাজ অটোমোবাইল দিচ্ছে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত ছাড়। হিরো মোটরসাইকেল দিচ্ছে সাড়ে ১২ হাজার টাকা পর্যন্ত ছাড়। সুজুকিতে ৮ হাজার টাকা পর্যন্ত ছাড়ের সঙ্গে রয়েছে জ্যাকেট উপহার। ইয়ামাহার ‘ম্যাজিক্যাল মার্চ’ ক্যাম্পেইনে রয়েছে ৪-৫ হাজার টাকা ছাড়।
বাংলাদেশ মোটরসাইকেল অ্যাসেম্বলার্স অ্যান্ড ম্যানুফাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ও টিভিএস বাংলাদেশের সিইও বিপ্লব কুমার রায় বলেন, “ঈদের সময় মোটরসাইকেল বিক্রি গড়পড়তা বিক্রির চেয়ে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ বেড়ে যায়। কারণ মানুষ ঈদে অতিরিক্ত টাকা অর্থাৎ বোনাসটা পায়। তাই মোটরসাইকেল কেনার জন্য ঈদের সময়টা মাথায় রাখে মানুষ।
“ব্র্যান্ডগুলোও ঈদের আনন্দটা ভাগ করে নেওয়ার জন্য অনেক রকম অফার নিয়ে আসে। প্রায় প্রতিটা কোম্পানিই দুই ঈদে নানা ছাড় বা অফার দেয়।“
বাইক রাইডার ভ্লগার রিকু আমির বলেন, ঈদের সময় মোটরসাইকেল কেনাটা গত ছয়-সাত বছরে ট্রেন্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোম্পানিগুলোও ছাড়-অফারের মেলা লাগাচ্ছে। যে কোম্পানি ছাড় দেয়নি, তাদের যে বিক্রি কম এমনও না। ছাড় দিলেও ঈদে বাইক কিনছে, না দিলেও কিনছে।
পুরনো গাড়ির দোকানে ভিড়
ঈদ ঘিরে গাড়িও কিনছেন অনেকে। তবে রিকন্ডিশন্ড গাড়ির চেয়ে ভিড় বেশি কয়েক হাত ব্যবহৃত পুরনো গাড়ির শোরুমগুলোতেও।
রিকন্ডিশন্ড গাড়ি আমদানিকারকরা অবশ্য এবার বলছেন হতাশার কথা। বিক্রির পালে আগেরবারের মত হাওয়া লাগেনি।
পুরনো গাড়ির ব্যবসায়ী মোহাম্মদ আশফাক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডট্কমকে বলেন, প্রতি ঈদেই বাড়তি কিছু ক্রেতা যুক্ত হয়, যাদের অনেকে প্রথম গাড়ি কিনছেন। কম বাজেটের ছোট গাড়ি তাদের পছন্দ। আবার অনেকে মডেল পরিবর্তনের জন্য পুরনোটা বেচে আরেকটা কেনেন।
বাংলাদেশে সেডান কারের বাজারে জাপানি রিকন্ডিশন্ড গাড়ি বেশি। রিকন্ডিশন্ড ভেহিকলস ইম্পোর্টার্স অ্যান্ড ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বারভিডা) সভাপতি হাবিব উল্লাহ ডন বলেন, ঈদের সময় সাধারণত প্রতিটি বিক্রয়কেন্দ্রে বিক্রি ২০ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ে। কিন্তু এবার সেটা হয়নি।
“নির্বাচনের আগে যখন মারামারি-কাটাকাটি, রাজনৈতিক অস্থিরতা শুরু হয়েছিল, তখন গাড়ির বিক্রি কমে যায়। আমরা ভেবেছিলাম হয়ত নির্বাচনের পরে বিক্রি বাড়বে, কিন্তু সেটা হয়নি। এই ঈদে আমাদের যে আশা ছিল, ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে দেখলাম, সে হিসেবে সেল একদম নাই। গাড়ি ব্যবসায়ীরা হতাশ। কোনো শোরুমে কাস্টমার তেমন নাই। বিক্রিও তেমন নাই।”
এমন মন্দাভাবের কারণ হিসেবে তিনি বলেন, “একটা জিনিস সত্য ডলারের বিপরীতে টাকা অবমূল্যায়নের কারণে গাড়ির মূল্য বেড়েছে প্রায় ৩৫ শতাংশ। যে গাড়ির দাম সাড়ে ১৮ লাখ টাকা ছিল, সেটা এখন হয়ে গেছে ২৫ থেকে ২৬ লাখ টাকা। এর জন্য ক্রেতাদের নতুন গাড়ি কিনতে কষ্ট হয়ে যাচ্ছে।”
‘ফুরসত নেই’ গ্যারেজ কর্মীদের
ঈদের সময় নিজেদের বাহনটি ঠিকঠাক রাখতে খুচরা যন্ত্রাংশের দোকান ও গ্যারেজে ছুটছেন অনেকে।
মিরপুরের পীরেরবাগ এলাকায় ‘মোটরগাড়ি সারাই’ কারখানার মালিক মিলন হোসেন বলেন, ঈদে নিজের গাড়ি নিয়ে প্রচুর মানুষ গ্রামে যায়। তাই ঢাকা ছাড়ার আগে গাড়িটা একবার গ্যারেজে নিয়ে আসেন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডট্কমকে তিনি বলেন, “আমার কাস্টমার যারা গ্রামের বাড়িত যাইব, তারা আগেই ফোন দিয়া কইছে গ্যারেজে আইব। অনেকে গাড়ি সাজায়, কেউ টুকটাক রঙ করায়। বেশিরভাগই আসে সার্ভিসিংয়ের জন্য।“
বিভিন্ন কাজের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ব্রেকপ্যাড, ইঞ্জিন ওয়েল, ফিল্টার বদল হয়। রেডিয়েটর, এসি ফিল্টারের পাশাপাশি সাসপেনশনের পার্ট যেমন- সিভি জয়েন্ট, শক অ্যাবজরবারগুলো পরীক্ষা করা হয়।
তিনি বলেন, “ঈদের সময় ঢাকার বাইরে গেলে ভালো লাইটের দরকার হয়, কেউ হেডলাইটের কাম করায়, কেউ ফগলাইট লাগায়। চাকা, লাইট ঠিক আছে কিনা, চেক কইরা ছাইড়া দিই।”
অন্য সময় শুক্রবার গ্যারেজ বন্ধ রাখলেও ঈদের সময় সেদিনও দম ফেলার ফুরসত থাকে না মিলনদের।
তার ভাষ্য, “পোলাপানেরও (গ্যারেজের কর্মী) ছুটি নেওয়া বন্ধ। খুব চাপ থাকে।”
গ্যারেজের কর্মীরা বলছেন, রোজার প্রথম দিকে ভাড়ায় চালিত মাইক্রোবাস ও প্রাইভেট কার ব্যবসাও থাকে ঢিলেঢালা। ফলে তারাও ঈদের আগ দিয়ে রঙসহ ইঞ্জিনের ও অন্যান্য কাজ করিয়ে নেয়।
রোজার মাঝামাঝিতে মিরপুরের দারুসসালাম এলাকার মো. ওয়াদুদের গ্যারেজেও দেখা গেল কাজের চাপ।
ওয়াদুদ বলছেন, “ঈদের আগে অনেক লোক আসে ছোটখাট ‘টাচআপ’ করাতে। মানে গাড়ির কোথাও ডেন্ট পড়লে বা রঙ চটে গেলে বা আচড় পড়লে সেগুলো পিটিয়ে সমান করে পুডিং দিয়ে ঘষে রঙ করে দেন মিস্ত্রীরা। তাতে গাড়ি আবার নতুনের মত দেখায়। আবার গাড়ি হালকা কাজ করিয়ে চকচকে করে গ্রামে নিয়ে যেতে চান কেউ কেউ।”
মহাখালীতে গাড়ির য্ন্ত্রাংশ বিক্রির মার্কেটও ঈদের আগে জমজমাট।
এখানকার বিক্রেতা আব্দুর রশীদ বলছেন, গাড়ির সাজসজ্জার জিনিস বিক্রি হয় বেশি। ফগলাইট, মিউজিক সিস্টেম, সিট কাভার এসবও কেনেন অনেকে। চাঁদরাত পর্যন্ত চলে এই বেচাবিক্রি।
ভ্লগার রিকু আমিরের ভাষ্য, “ঈদ এলে তরুণ বাইকাররা বাইকে প্রচুর গ্রাফিক্সের কাজ করান। নতুন নতুন স্টিকার লাগানোসহ বিভিন্ন গ্রাফিক্যাল মডিফিকেশন, লাইট লাগানো ইত্যাদি চলে।“
ঢাকার ৬০ ফিট, মিরপুর ১০ নম্বর, বংশাল, রামপুরা, বাংলামোটর-সব জায়গাতেই কারিগররা খুবই ব্যস্ত থাকে। চাঁদরাতে এসব মার্কেটে দাঁড়ানোর জায়গাও থাকে না, অভিজ্ঞতা থেকে বলেন তিনি।
মিরপুর ১০ নম্বরের এক দোকানের কর্মী মো. সিয়াম বলেন, ঈদে হেলমেটও বিক্রি হয় প্রচুর। বোনাসের টাকায় বাইকাররা কেনেন দামি ব্র্যান্ডের হেলমেট।