দামের পার্থক্যের জন্য খুচরা বিক্রেতারা দেখাচ্ছেন ডিলারদের; ডিলাররা দেখাচ্ছে কোম্পানিকে। কোম্পানির ভাষ্য, দর নির্ধারণ ‘বাস্তবসম্মত’ হচ্ছে না।
Published : 07 Apr 2023, 12:53 AM
এপ্রিল মাসে ১২ কেজি এলপিজির একটি সিলিন্ডারের দাম কত? সরকারি ঘোষণা ১১৭৮ টাকা। কিন্তু যারা কিনছেন, তাদের কাছে শোনা যাচ্ছে নানা রকম দাম।
পটুয়াখালী শহরে যেখানে একজন কিনছেন ১৩৫০ টাকায়, সেখানে কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার বিষ্ণুপুর গ্রামে ১২৮০ টাকায় কেনা গ্রাহক পাওয়া গেল।
ঢাকার মহাখালীর এক হোটেল ব্যবসায়ী কিনেছেন ১৪৫০ টাকায়। আবার ইস্কাটনে একজনকে গুনতে হয়েছে ১৫০০ টাকা। মিরপুরে আবার ১৩০০ টাকায় কেনার খবর মিলেছে।
এভাবে দেশের বিভিন্ন স্থানে একেক দরে বিক্রি হচ্ছে গৃহস্থালিতে ব্যবহৃত ১২ কেজির এলপিজির সিলিন্ডার; দামের হেরফের অন্য ওজনের সিলিন্ডারেও। অথচ এগুলোর বিইআরসির বেঁধে দেওয়া এক দরে বিক্রি হওয়ার কথা।
দামের পার্থক্যের জন্য খুচরা বিক্রেতারা দেখাচ্ছেন ডিলারদের; ডিলাররা দেখাচ্ছে কোম্পানিকে।
আর দর ঠিক করে দেওয়া বিইআরসি বলছে, বেঁধে দেওয়া দরে যেন বিক্রি হয়, তা নিশ্চিত করতে তারা ‘চেষ্টা’ করছেন; যদিও এলপিজি কোম্পানির বক্তব্য, বিইআরসির বেঁধে দেওয়া দর ‘বাস্তবসম্মত নয়’।
দেশে গৃহস্থালিতে পাইপলাইনে নতুন গ্যাস সংযোগ দেওয়া হচ্ছে না বলে এলপি গ্যাসের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। আমদানি করা গ্যাসের আন্তর্জাতিক বাজার দরের সঙ্গে মিল রেখে দেশের বাজারে এলপিজির দর মাসে মাসে ঠিক করে দেয় বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)।
এপ্রিল মাসের জন্য গত রোববার এলপিজির দর ঠিক করে দিয়েছিল বিইআরসি। সেদিন কমিশনের নতুন চেয়ারম্যান নুরুল আমিন বলেছিলেন, এপ্রিলে প্রতি কেজি এলপিজির খুচরা দাম হবে ৯৮ টাকা ১৭ পয়সা, যা মার্চে ছিল ১১৮ টাকা ৫৪ পয়সা। এই হিসাবে প্রতি কেজিতে দাম কমেছে ২০ টাকা ৩৭ পয়সা।
নতুন ঘোষণায়
সাড়ে পাঁচ কেজি এলপিজির সিলিন্ডার ৫৪০ টাকা
সাড়ে ১২ কেজির সিলিন্ডার ১২২৮ টাকা
১৫ কেজির সিলিন্ডার ১৪৭২ টাকা
১৬ কেজির সিলিন্ডার ১৫৭১ টাকা
১৮ কেজির সিলিন্ডার ১৭৬৭ টাকা
২০ কেজির সিলিন্ডার ১৯৬৩ টাকা
২২ কেজির সিলিন্ডার ২১৬০ টাকা
২৫ কেজির সিলিন্ডার ২৪৫৪ টাকা
৩০ কেজির সিলিন্ডার ২৯৪৫ টাকা
৩৩ কেজির সিলিন্ডার ৩২৪০ টাকা
৩৫ কেজির সিলিন্ডার ৩৪৩৬ টাকা
৪৫ কেজির সিলিন্ডার ৪৪১৮ টাকা
এলপিজি কিনতে মাসে ‘২৭০০ কোটি টাকা’ বাড়তি দিচ্ছে ভোক্তারা
এলপিজিতে ‘হরিলুট’: সরকারি দর যতটুকু বাড়ল, খুচরায় তারও বেশি
সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত ১২ কেজি এলপিজি সিলিন্ডার এপ্রিলে সর্বোচ্চ ১১৭৮ টাকায় বিক্রি হবে বলে জানিয়েছিলেন বিইআরসি চেয়ারম্যান, যা আগের মাসে ছিল ১৪২২ টাকা। অর্থাৎ দাম কমেছে ২৪৪ টাকা।
নতুন দর রোববার থেকে কার্যকর হওয়ার কথা থাকলেও তিন পরেও দেখা যায়, দেশের বাজারে একেক রকম দরে বিক্রি হচ্ছে।
ঢাকার মিরপুর ২ নম্বর সেকশনের বাসিন্দা হাসিনুর রহমান ১৩০০ টাকায় ১২ কেজির সিলিন্ডার কিনতে পারার কথা জানিয়েছেন।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গ্যাসের দাম বাড়ুক বা কমুক, এর তো বিকল্প নাই। এই দেশে বাড়লে কিছু কমে না। কিন্তু রমজানে এই উর্ধ্বমূল্যের বাজারে এলপিজির দাম কমাটা স্বস্তি দিয়েছে।”
পটুয়াখালী শহরে ১২ কেজির সিলিন্ডার ১৩৫০ টাকায় কেনার কথা জানিয়েছেন সোহেল মিয়া। কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার বিষ্ণুপুর গ্রামের মো. ফরিদ উদ্দিন তা আরও কমে ১২৮০ টাকায় নিয়েছেন।
লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার আবুল কাশেম ভূঁইয়াও একই রকম দরে কেনার কথা জানিয়ে বলেছেন, “আয়-রোজগার তো আর বাড়েনি, সব কিছুর দাম এখন উর্ধ্বমুখী, যদি এভাবে সব কিছুতে দাম কিছু কিছু কমে আসে, তাহলে অন্তত স্বাভাবিক জীবনযাপন করা যাবে।”
কুমিল্লার মুরাদনগরে ভিন্ন চিত্র দেখা গেল কুমিল্লা শহরে। রেসকোর্স এলাকার বাসিন্দা আকিব ইকবাল মারুফ বলেন, “আমাদের ৩০ কেজির সিলিন্ডার লাগে। আমি কেয়ারটেকারের কাছে ভাউচার দেখলাম ৩১০০ টাকার, যেটার সরকারি রেইট ২৪৯৫ টাকা।”
ঢাকার মহাখালীর হোটেল ব্যবসায়ী সজীব হোসেন ১২ কেজির সিলিন্ডার কিনেছেন ১৪৫০ টাকায়।
তিনি বলেন, “ওবায়দুল নামের এক লোক আমাকে গ্যাস দিয়ে যায়। আজকে সিলিন্ডার দিয়েছে ১৪৫০ টাকায়, আজকে এই রেটে দিয়ে গেছে, আগে অন্য রেইট দিছে, রেইটের কোনো হিসাব নাই, উঠানামা করে।
“ভাউচার চাইলেও দেয় না। এসে খালিটা (সিলিন্ডার) নিয়ে যায়, ভরাটা দিয়ে যায়। আগে কখনও একটানা বসুন্ধরার সিলিন্ডার দিত, আবার কখনও ফ্রেশ। এখন মিক্সড। আগে একেক কোম্পানির দাম দরে উঠানামা ছিল। এখন সবই এক রেইট।”
ওবায়দুলের কাছে দাম বেশি নেওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি দাবি করেন, তার কেনা দাম বেশি পড়ছে, সেই সঙ্গে তিনি যোগ করছেন পরিবহন খরচ।
ওবায়দুল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি তো ডিলার না, ভাইঙ্গা কিনি। আমাদের কাছে কেনা ধরে বেশি। তার উপর একটা সিলিন্ডার মনে করেন, তিব্বত থেকে মহাখালী আনা-নেওয়া করলে ১০০ টাকা বেশি।”
তাহের কোরাইশি নামের এক গ্যাস সিলিন্ডার ডিলার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পাইকারিভাবে ১২ কেজির সিলিন্ডার আমরা ১২০০ টাকা বা ১২১০ টাকায় দিচ্ছি। কোম্পানি এই রেটে বিক্রির জন্য বলে দিছে। কোম্পানি থেকে ১২০০ টাকায় কিনে ১২১০ টাকা বিক্রি করে। এর মাঝে আমাকে আবার টার্গেট দেওয়া আছে। টার্গেট না মিললে কিন্তু আমার আম-ছালা সবই যাবে।”
এলপি গ্যাস ব্যবসায়ী সমবায় সমিতি লিমিটেডের সাধারণ সম্পাদক হামিদ লতিফ ভূঁইয়া কামাল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা এক্সক্লুসিভ ডিলার, এই বিবেচনায় কোম্পানির কাছ থেকে ১০ থেকে ১৫ টাকা পাব এই হিসাবে আমরা ১২০০ টাকায় পাইকারি বিক্রি করছি। খুচরায় যারা ১০ থেকে ১২টা সিলিন্ডার নিচ্ছে, তাদের হয়ত সেটা ১২১০ টাকায় দিচ্ছি, কোম্পানি এভাবেই বলে দিয়েছে। এখন কোম্পানি যদি আমাদেরকে এই লসটা ব্যাক না করে, তাহলে আমাদের কিছু থাকবে না, পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে।”
দামের অনেক পার্থক্যের বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, “বাসায়-দোকানে সাপ্লাই দিয়ে কেউ ১৪০০ টাকা বা ১৩৫০ টাকা নিচ্ছে, এই তথ্য আমার কাছে নাই। যদি কেউ এরকম বিক্রি করে, তাহলে আমাদের নলেজে দেবেন, আমরা বলে দেব এত ব্যবসা যেন না করে। ৫০ থেকে ৬০ টাকা ব্যবসা করাই যথেষ্ট।”
এলপিজির ঘোষিত দর এবং বাজারে বিক্রির দরের পার্থক্য নিয়ে ভোক্তাদের অভিযোগ অনেক দিনের। এনিয়ে কোম্পানি মালিকদের ভাষ্য হল, চাহিদা ও জোগানের ভারসাম্যের উপর বাজার দর ঠিক হওয়ার কথা থাকলেও বিইআরসির দরে তার প্রতিফলন থাকে না।
এলপিজি অপারেটর্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (লোয়াব) সভাপতি ও ওমেরা গ্যাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আজম জে চৌধুরী গত ফেব্রুয়ারিতে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছিলেন, “বিইআরসি যেসব প্যারামিটার দিয়ে প্রতিমাসে দাম ঠিক করে, সেটা বাস্তবসম্মত নয়। সেকারণে তাদের নির্ধারিত ওই দর কার্যকর হয় না।”
তবে এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন বলছে, তাদের বেঁধে দেওয়া দরের বেশি দামে বিক্রি হলে তারা পদক্ষেপ নেবে।
খুচরাতে বেশি দামে বিক্রির খবর পাচ্ছেন বলে জানান বিইআরসি সদস্য (গ্যাস) মো. হেলাল উদ্দিন। তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা নতুন কমিশন এসেছি, এই জায়গাগুলো ঠিক করার চেষ্টা করেছি।
“সবাই এখন জানে দাম আসলে কত? কেউ যদি নির্ধারিত দামের চেয়ে ১০০ টাকাও বেশি নেয়, তাহলে সেটা আমরা দেখব। আমরা ঘোষণা দিচ্ছি এবং বাজারে যে দামে চলছে, তার মাঝে যেন গ্যাপ না থাকে, তার জন্য আমরা চেষ্টা করছি।”