এলপিজিতে ‘হরিলুট’: সরকারি দর যতটুকু বাড়ল, খুচরায় তারও বেশি

সরকার নির্ধারিত দাম না মানলে ‘অ্যাকশনে’ যাবে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর; শিগগির আলোচনায় বসে সমাধানের কথাও বলেছেন মহাপরিচালক সফিকুজ্জামান।

ফয়সাল আতিকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 Feb 2023, 07:02 PM
Updated : 7 Feb 2023, 07:02 PM

মিরপুরের অন্তত সাতটি দোকানে এলপিজি পাওয়া যায়নি; দোকানিরা খালি সিলিন্ডার বাইরে সাজিয়ে রেখেছেন। বাড়তি দর দিতে রাজি থাকলে ক্রেতারা অনেক স্থানেই সন্ধান পাচ্ছেন গ্যাসের।

এক লাফে ২১ শতাংশ বাড়িয়ে নতুন দর নির্ধারণের পরও রান্নার এ গ্যাসের সংকট কাটেনি এমন খবরের খোঁজখবর নিতে গিয়ে রোববার সেখানে এমনটাই দেখা গেছে।

খুচরা ব্যবসায়ীরা একে অন্যের বিরুদ্ধে অভিযোগের সুরে বলছেন, অনেকের কাছে সিলিন্ডার থাকলেও তারা নাই নাই আওয়াজ তুলছেন। বেশি দাম দিলে ঠিকই পাওয়া যাচ্ছে।

সরকারি নির্ধারিত বর্ধিত দামের চেয়েও অনেক বেশি দামে বিক্রির তথ্যও মিলছে। বেশি ব্যবহৃত ১২ কেজির সিলিন্ডারে অন্তত ২০০ টাকা, কোথাও কোথাও ৩০০ টাকাও বেশি নেওয়া হচ্ছে। এমন অবস্থাকে ‘হরিলুট’ হিসেবেই দেখছেন জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ. এইচ. এম. সফিকুজ্জামান।

এ অবস্থা থেকে উত্তরণে তথ্য সংগ্রহ ও যাচাই-বাছাই শেষে খাত সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে শিগগির আলোচনায় বসে সিদ্ধান্তে আসার কথা জানিয়েছেন তিনি। একই সঙ্গে সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি নিলে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেন তিনি।

ফেব্রুয়ারির জন্য এলপিজির ১২ কেজি সিলিন্ডারের দাম গত ২ ফেব্রুয়ারি এ খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিইআরসি ২৬৬ টাকা বাড়িয়ে ১৪৯৮ টাকা ঠিক করে দেয়। এরপরও এ দামে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না গ্যাস; এর সঙ্গে বিভিন্ন স্তরের ব্যবসায়ীরা বাড়তি মুনাফা যোগ করে খুচরায় দাম নিয়ে গেছেন অন্তত ১৭০০ টাকায়।

তবে ২ ফেব্রুয়ারি দাম বাড়ানোর সপ্তাহ খানেক আগে থেকেই সরবরাহ সংকটকে কারণ হিসেবে দেখিয়ে এর কাছাকাছি দামে বিক্রি করা হচ্ছিল মূলত রান্নার কাজে ব্যবহার হওয়া এ গ্যাস।

তবে অনেকের অভিযোগ, এলপিজির এ বাড়তি দাম আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির কারণে নয়; সরবরাহ সংকট দেখিয়েই এমন কারসাজি করা হচ্ছে বিভিন্ন পর্যায়ে।

এমন প্রেক্ষাপটে অভিযানে নেমে বাড়তি দাম নেওয়ার তথ্যপ্রমাণ পেয়েছে বাজারে ভোক্তার অধিকার সুরক্ষা ও অনিয়ম দমনে কাজ করার দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি সংস্থা জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। দাম নিয়ে অনিয়মের বিষয়টি নজরে এসেছে অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সফিকুজ্জামানের।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “সরকার দাম বাড়ানোর পরও ব্যবসায়ীরা ১২ কেজির সিলিন্ডারে আরও ২০০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত দাম বাড়িয়েছেন। পাইকারি-খুচরা প্রতিটা জায়গায় একটা হরিলুট অবস্থা চলছে।“

বিষয়টি সম্পর্কে সচেতন আছেন জানিয়ে তিনি বলেন, ফেব্রুয়ারি মাসের মূল্য ঘোষণার আগেই গত মাসের (জানুয়ারি) শেষ দিকে এলপিজির দাম বাড়িয়ে দেওয়া হয়। গত বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই অভিযান চলছে। সন্ধ্যায় বিইআরসি দাম বাড়িয়েছে। এখন দোকানে তার থেকেও ২০০ থেকে ৩০০ টাকা বাড়তি দামে বিক্রি হচ্ছে।

“আমরা বিভিন্ন রকম তথ্য পেয়েছে। সেগুলো নিয়ে এখন আমরা মাঠের তথ্যের সঙ্গে মেলাচ্ছি। বিভিন্ন রকম টেবিল ওয়ার্ক করছি। অচিরেই আমরা সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে একটা সিদ্ধান্তে যাবো,” যোগ করেন তিনি।

Also Read: ফেব্রুয়ারিতে এলপিজির দাম বাড়ল ২১%

Also Read: হঠাৎ এলপিজির সংকট, ‘রাতারাতি’ বাড়ছে দাম

ভোক্তার অবস্থা বেগতিক

ঢাকায় ফুটপাত কিংবা পথের ধারে অস্থায়ী দোকান দিয়ে চা-কফি বিক্রি করেন এমন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের মাসে ১২ কেজি ওজনের অন্তত আড়াই থেকে তিন সিলিন্ডার এলপি গ্যাস খরচ করতে হয়। হঠাৎ গ্যাসের দাম এক লাফে অনেকটা বেড়ে যাওয়ার পর এসব দোকানদারদের দুশ্চিন্তাও বেড়ে গেছে।

বাসাবাড়িতেও এখন অনেকেই নির্ভর এলপিজির ওপর। সীমিত আয়ের মানুষের গ্যাসের জন্য প্রতি মাসে আরও ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা ব্যয়ের বোঝা বড় ধরনের ধাক্কা হিসেবেই দেখা দিয়েছে।

ঢাকার মহাখালী এলাকায় ব্যবসা করা এমনই একজন ক্ষুদ্র বিক্রেতা শান্ত মিয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সকালে ১২ কেজি ওজনের একটি সিলিন্ডার দিয়ে বলে গেছে দাম ১৮০০ টাকা দিতে হবে। এটা হচ্ছে ওমেরার সিলিন্ডার। আবার বেক্সিমকোর প্লাস্টিকের বোতল কিনতে গেলে দাম নেবে ১৯০০ টাকা। আমার পাশের দোকানে একজন বলেছেন ১৭০০ টাকা হলে সিলিন্ডার দিয়ে যান, ১৮০০ টাকায় নিতে পারব না। তারপর তারা সিলিন্ডার রেখে গেছে। এখন দাম কত রাখে বলতে পারছি না।

“এরকম হলে তো আমাদের ছোট্ট এই দোকানে গ্যাস বাবদই খরচ হয়ে যাবে ৫০০০ থেকে ৬০০০ টাকা। তাহলে ব্যবসা করব কত টাকার, মুনাফাই বা করব কত? এভাবে চললে তো আমাদের অবস্থা রসাতলে যাবে।”

পরিস্থিতি বুঝতে মিরপুর স্টেডিয়ামের দক্ষিণ পাশে এলপিজির অন্তত পাঁচ দোকানে গেলে চারটির দোকানি গ্যাস ভরতি সিলিন্ডার নেই বলে জানান। গত এক সপ্তাহ ধরে গ্যাস বিক্রি করছেন না বলে সবারই দাবি।

তবে এ পর্যায়ের বিক্রেতারা একে অন্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বলেন, অনেকের কাছে গ্যাস বোঝাই সিলিন্ডার থাকলেও বাড়তি দরের জন্য তারা ক্রেতাদের ফেরত দিচ্ছেন। বেশি দামের কথা বললে ঠিকই গ্যাস দিচ্ছে।

নাম না প্রকাশ করার শর্তে একজন দোকানি বলেন, আমার কাছে সত্যিই এলপিজি নেই। এত দামে বিক্রি করে কত লাভ করবো। আশপাশে সব দোকানেই কম বেশি সিলিন্ডার আছে। কিন্তু কেউ দেখাতে চাচ্ছে না।

ওই এলাকায় গ্যাস পাওয়া গেল শুধু মাল্টি এন্টারপ্রাইজ নামের একটি হার্ডওয়্যার দোকানে। সেখানে জি-গ্যাস, ওমেরা, টোটাল, বসুন্ধরা, যমুনা, ইউনিগ্যাস, জেএমআই, বেক্সিমকো, ডেল্টা গ্যাস, আইগ্যাস, বেঙ্গল গ্যাসের খালি সিলিন্ডার দেখা গেছে। জেএমআই ও যমুনার গ্যাসভর্তি সিলিন্ডার থাকার কথাও বলেন দোকানি।

দোকানের মালিক মামুন খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, গত ২৭ জানুয়ারি ওমেরা গ্যাসের ডিলার ১৫৫০ টাকা করে ১২ কেজির সিলিন্ডার বিক্রি করে গেছে। সেটার কেনা ভাউচার আমার কাছে আছে। এখন আমরা প্রতি সিলিন্ডারে ৫০ টাকা করে লাভে বিক্রি করছি।

“কোম্পানিগুলো বলছে, এলপি গ্যাসের আমদানি নেই, ডলার সংকট। সেই কারণে সরবরাহেও সংকট চলছে। সেই সংকটের সুযোগে সবাই দাম বাড়াচ্ছে। মূলত বিভিন্ন কোম্পানির ডিপোগুলো থেকেই দাম বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে,” বলেন তিনি।

গত কয়েকমাস ধরে বাংলাদেশে মাসে এক লাখ ২০ হাজার টন এলপি গ্যাস ব্যবহার হচ্ছে। রান্নার কাজে ব্যবহৃত ভোক্তাদের পাশাপাশি সম্প্রতি শিল্পকারখানাগুলোতেও এলপিজির ব্যবহার বাড়ার তথ্য দিচ্ছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।

এলপিজি অপারেটর্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (লোয়াব) এর সভাপতি ও ওমেরা গ্যাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আজম জে চৌধুরী বলেন, শিল্প-কারখানাসহ বহুমুখী কাজে এলপি গ্যাসের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় বাজারে কিছুটা ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে শিল্প গ্রাহকদের অগ্রাধিকার দিতে গিয়ে রান্নার খুচরা গ্রাহকরা একটু কম গুরুত্ব পাচ্ছেন।

চাহিদা ও যোগানের ভারসাম্যের ওপর ভর করে দাম ঠিক হবে দাবি করে তিনি বলেন, সরকারি সংস্থা বিইআরসি যেসব প্যারামিটার দিয়ে প্রতিমাসে দাম ঠিক করে সেটা বস্তাবসম্মত নয়। সেকারণে তাদের নির্ধারিত ওই দর কার্যকর হয় না।

তার এ বক্তব্যের সঙ্গে একমত নন ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সফিকুজ্জামান।

তিনি বলেন, সরকার যেটা দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে এরচেয়ে বেশি মূল্যে বিক্রি হলে সেটা অবশ্যই আমরা ধরবো। আমরা দেখতে পাচ্ছি খুচরা দোকানে মূল্য তালিকা টানিয়ে রাখছে না। তাদের কোনো অসুবিধা থাকলে তারা এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন, জ্বালানি মন্ত্রণালয় থেকে তারা এগুলো ঠিক করে আনবে।

“কিন্তু সরকার যেটা নির্ধারণ করেছে তার চেয়ে বেশি দামে বিক্রি করলে আমরা অবশ্যই অ্যাকশনে যাব।“