‘এখন এলসি না হলে রোজায় খেজুরের দাম নাগালের বাইরে যাবে’

“একই আজোয়া খেজুর একজায়গায় ৫০০-৬০০, আবার আরেক জায়গায় ৪০০০। মানভেদে ২০০-১০০ টাকা পার্থক্য হতে পারে, তাই বলে এতো?,” ক্ষোভ ক্যাব প্রতিনিধি হান্নানের।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 Nov 2022, 02:08 PM
Updated : 20 Nov 2022, 02:08 PM

এখনই ঋণপত্রের (এলসি) ব্যবস্থা না হলে রোজায় ফলমূলের বাজার কোনোভাবেই স্থিতিশীল রাখা যাবে না; খেজুরের দাম চলে যাবে সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে।

রোববার ফলের মূল্য স্থিতিশীল রাখার লক্ষ্যে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর আয়োজিত মতবিনিময় সভায় এ সতর্কবার্তা দেন এ খাতের পাইকারি ও খুচরা ব‍্যবসায়ীরা।

এতে বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুটস ইমপোর্টার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম বলেন, “দুই মাস যাবৎ চাহিদা অনুযায়ী এলসি পাচ্ছি না ব্যাংক থেকে। চাহিদার তুলনায় আমদানি কম হচ্ছে। এখন সরকার যদি মনে করে যে ফল আমদানি বন্ধ করলে ভালো হবে, তা হলে বন্ধ করে দেন।”

ফল আমদানির জন্য জরুরিভাবে এলসি খোলা দরকার জানিয়ে ঢাকা মহানগর ফল আমদানি-রপ্তানিকারক ও আড়ৎদার ব্যবসায়ী বহুমুখী সমিতিরও এই সভাপতি বলেন, “অগাস্ট, সেপ্টেম্বর, অক্টোবর, নভেম্বর আমাদের খেজুরের সিজন। আমরা সিজনের টাইমে যদি না কিনতে পারি, রমজানের কাছাকাছি সময় যদি এলসি ওপেন করে দেয়, তখন আমাদের বেশি দামে কিনতে হবে এবং রমজানে আমাদের ওপর দোষ আসবে।”

তবে নতুন নতুন অনেকেই সম্পর্কের খাতিরে এলসি খুলতে পাচ্ছে বলে অভিযোগ করেন সিরাজুল। তার ভাষ্য, “ব্যাংকের ঊর্ধ্বতনদের সাথে যাদের ভালো সম্পর্ক আছে, তারা এলসি পেয়ে যাচ্ছে। যারা আগে কখনও ফলের ব্যবসা করেনি, তারা এই সুযোগে ব্যবসায় নেমে যাচ্ছে। ব্যাংকের পরিচালকের ছেলেও ব্যবসায় নামছে। দুই লাখ ডলারের এলসি পাইছে।”

এমনটা হলে ফলের বাজার যে মৌসুমী ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে যাবে, সে কথা উঠে আসে ভোক্তা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) এ এইচ এম সফিকুজ্জামানের কথাতেও।

তার কথায়, “যারা কখনও ব্যবসা করেন নাই, তারা লিংক দিয়ে ব্যাংক থেকে এলসি পাচ্ছে। এতে বাজারে অসম প্রতিযোগিতা তৈরি হচ্ছে। দাম নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। এ রকম হলে মৌসুমি ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে সব চলে যাবে, তারা মার্কেট ম্যানিপুলেট করবে।”

বিশ্ববাজারে পণ্যমূল্য বেড়ে যাওয়ার প্রভাবে আমদানি বিল পরিশোধ করতে গিয়ে যে ডলার সংকট তৈরি হয়েছে তা আগামী জানুয়ারি থেকে আর থাকবে না বলে বৃহস্পতিবার আশা প্রকাশ করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদারের।

জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত পণ্য আমদানিতে ‘অস্বাভাবিক’ পরিমাণে ঋণপত্র (এলসি) খোলা হয়েছিল জানিয়ে তিনি বলেছিলেন, “এটি আমরা কমিয়েছি। আগামী জানুয়ারি থেকে ডলার সংকট আর থাকবে না বলে আশা করছি।”

খেজুর আমদানিকারদের ভাষ্য, সারা বছরে যে খেজুরের চাহিদা, তার চেয়ে তিন থেকে চারগুণ চাহিদা বেড়ে যায় রোজায়। সেই চাহিদা মেটাতে ছয় মাস আগে থেকেই খেজুর মজুদ করতে থাকেন তারা। সেসব খেজুর সংরক্ষণ করা হয় হিমাগারে।

সভায় ডলার সংকটের কথা বিবেচনা করে কিছু ক্ষেত্রে আমদানি নিয়ন্ত্রণ করা যায় কি না তা নিয়ে সংশ্লিষ্টদের পর্যালোচনার পরামর্শ দেন ভোক্তা অধিকারের ডিজি।

“আমরা কঠিন সময় পার করছি। আমাদের ডলার বাইরে চলে যাচ্ছে। তাই আমদানি নির্ভরতা সংকুচিত করে দিতে হবে। ভেবে দেখতে হবে যে অতি বিলাসবহুল ফলমূল এক/দুই বছর রেস্ট্রিকটেড রাখা যায় কি না।”

এজন্য আমদানি নির্ভর ফলমূলের ক্ষেত্রে কর নিয়ে নতুন করে ভাবা দরকার আছে বলে মনে করেন তিনি।

সফিকুজ্জামান বলেন, “ডিউটি স্ট্রাকচারটা ভাবার দরকার আছে। ডিউটি বাড়িয়ে দিলে কস্টিং বাড়বে; তখন কনজাম্পশন কমে যাবে৷ তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভিন্ন, যেমন- খেজুর।”

তবে কর বৃদ্ধির প্রস্তাবে একমত নন ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতা সিরাজুল। ক্ষোভ নিয়ে তিনি বলেন, “ফল আমদানিতে আমাদের শতভাগের ওপর ডিউটি দিতে হয়। তাই ডিউটি যদি বাড়ানো হয়, তাহলে আমদানি বন্ধ করে দেওয়া হোক।”

দেশেই বিদেশি ফলের উৎপাদন বাড়ানো গেলে এ খাতে আমদানির প্রয়োজনীয়তা কমে যাবে বলে মনে করেন ভোক্তা অধিদপ্তরের ডিজি সফিকুজ্জামান।

তিনি বলেন, “আমরা তো ভাবি নাই যে আমাদের দেশে ড্রাগন বা স্ট্রবেরি হবে। এখানে এখন মাল্টা, কাজুবাদামের চাষ হচ্ছে৷

“…থাইল্যান্ড থেকে যে ড্রাগন আসে, দেশি ড্রাগনের চাইতে তার দাম ৮-১০ গুণ বেশি। আস্তে আস্তে আমাদের উচিত বিদেশি ফলের ওপর থেকে নির্ভরতা কমিয়ে আনা।”

একই পণ্যের দাম জায়গাভেদে বড় ফারাক হওয়া যে ‘অযৌক্তিক’, সে কথাও ব্যবসায়ী শ্রেণিকে মনে করিয়ে দেন সফিকুজ্জামান।

“সাধারণ দোকানে যে দামে ফল বিক্রি হয়, ইউনিমার্টের মতো কেতাদুরস্ত সুপারশপে তার দাম কয়েকগুণ বেশি, যা সম্পূর্ণভাবে অযৌক্তিক। ইউনিমার্টে যে দাম, তা অত্যধিক দাম। তাদের কোয়ালিটি ঠিক আছে, তাই বলে ৩-৪ গুণ দাম অযৌক্তিক।”

এ বক্তব্যে সমর্থন জানিয়ে কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) প্রতিনিধি কাজী আব্দুল হান্নান বলেন, “আমি হাউজ বিল্ডিং থেকে একরকম কিনব, গুলশান থেকে অন্যরকম কিনব; এটা হয় না।

“একই আজোয়া খেজুর একজায়গায় ৫০০-৬০০, আবার আরেক জায়গায় ৪০০০। মানভেদে ২০০-১০০ টাকা পার্থক্য হতে পারে, তাই বলে এত!”

এখন থেকেই ফলের বাজারে নজর রাখলে রোজায় তেমন সংকট হবে না বলে মনে করেন ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন ও অর্থ) মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার।

“কারওয়ান বাজার থেকে ফল কিনলে খুচরা দামে কিনতে পারি। একই জিনিস ধানমণ্ডি থেকে কিনলে বেশি দামে কিনতে হয়। এই দায় অ্যাসোসিয়েশনের ওপর বর্তায় মূলত।

“আমাদের সামনে ৪-৫ মাস সময় আছে। অ্যাসোসিয়েশন মূল্যটা ঠিক করে দিলে বাজার স্থিতিশীল থাকবে।”

দাম কারসাজি নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য পাকা ভাউচার সংরক্ষণে ক্রেতাদের প্রতি তিনি অনুরোধ করেন। সেই সঙ্গে ব্যবসায়ীদেরকে পারস্পরিক দোষারোপে না গিয়ে ‘মানুষ কিভাবে ভালো থাকবে’, সেই চেষ্টা চালানোর আহ্বান জানান শাহরিয়ার।

Also Read: দেশে ৮০% খেজুরই আসে ইরাক থেকে