ভোক্তা অধিকারকর্মী ও জ্বালানি খাত বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তেলের দাম নামমাত্র কমানোয় ভোক্তাদের স্বাস্তি মিলবে না; বরং সুবিধা পাবে এ খাতের বৃহৎ ব্যবসায়ী শ্রেণি।
Published : 11 Mar 2024, 12:23 AM
স্বয়ংক্রিয় মূল্য সমন্বয়ের প্রথম পদক্ষেপে আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যহ্রাসের সুবাদে সরকার ডিজেল-কেরোসিনে লিটারপ্রতি এক টাকা ৪৮ পয়সা দাম কমলেও ভোক্তা পর্যায়ে দাম কমেছে ৭৫ পয়সা।
অকটেনে মূসক ও করপরবর্তী দাম লিটারে ৪ টাকা ৫৮ পয়সা কমলেও ভোক্তার লাভ হচ্ছে ৪ টাকা। একইভাবে পেট্রোলের মূসক ও করপরবর্তী মূল্য লিটারে ৩ টাকা ৬৩ পয়সা কমলেও ভোক্তা ছাড় পেয়েছে ৩ টাকা।
অথচ জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী বলেছিলেন, আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি কার্যকরের মধ্য দিয়ে জ্বালানি তেলের দামে ‘বিরাট’ পরিবর্তন আসছে।
এত হাঁকডাকের পর ডিজেলের দাম লিটারে ৭৫ পয়সা কমায় ক্ষোভ প্রকাশ করলেন ঢাকার খামারবাড়ি থেকে মিরপুর-২ নম্বর সেক্টরের লেগুনা চালক টিটু।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “তেলের দাম কমবে বলে কতদিন ধরে অপেক্ষায় ছিলাম। শেষে দেখলাম যে দাম কমল কয়েক পয়সা। আমাদের তাতে কোনো লাভই হবে না।
“আমরা পাম্প থেকে তেল কিনতে গেলে ১০/১৫ টাকা বেশি রেখে দেয়। আর রাস্তার পাশের কনটেইনারে ভরে যারা তেল বিক্রি করে, তারা আগেও দাম রাখত লিটারে ১০৯ টাকা, এখনও রাখছে ১০৯ টাকা। তাহলে আমাদের কী সুবিধা হল?”
আরেক লেগুনা চালক আশরাফ হোসেন বলেন, “একটা লেগুনায় দিনে ১৫ লিটার তেল লাগে। দম যতটা কমেছে, সে অনুযায়ী দাম রাখলেও দিনে ১০ টাকা সাশ্রয় হতে পারে। এ নিয়ে কথা বলাই সময় নষ্ট।”
ভোক্তা অধিকারকর্মী ও জ্বালানি খাত বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, তেলের দাম এভাবে নামমাত্র কমানোয় ভোক্তাদের স্বস্তি মিলবে না। বরং ৭৫ পয়সা মূল্যহ্রাসের সুবিধা পাবে এই খাতের বৃহৎ ব্যবসায়ী শ্রেণি।
জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের দুটি প্রজ্ঞাপন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সমন্বয়ের কথা বলে ভোক্তার জন্য দাম কিছুটা কমানো হলেও বিপণন কোম্পানিগুলোর মার্জিনসহ বিভিন্ন খাতে লিটারপ্রতি আয় ৭৩ পয়সা করে বাড়ানো হয়েছে।
এর মধ্যে ডিজেল-কেরোসিনে বিপণন কোম্পানিগুলোর মার্জিন লিটারপ্রতি ৩০ পয়সা বাড়িয়ে আগের ৫০ পয়সা থেকে এখন ৮০ পয়সা করা হয়েছে। পেট্রোল অকটেনেও লিটারপ্রতি ৩০ পয়সা করে বাড়িয়ে আগের ৬০ পয়সা থেকে এখন ৯০ পয়সা করা হয়েছে।
সমান পরিবহন ভাড়া তহবিল হিসাব নামের একটি খাতে বিপণনকারীদের প্রাপ্য অংশ লিটারপ্রতি ৩০ পয়সা বাড়িয়ে আগের ৯০ পয়সা থেকে করা হয়েছে ১২০ পয়সা।
বিপিসির জ্বালানি তেল খাতে উন্নয়ন তহবিল হিসাব বাবদ আগে যেখানে লিটারপ্রতি ১০ পয়সা নেওয়া হত, এখন সেখানে নেওয়া হচ্ছে ২৫ পয়সা। অর্থাৎ এখানেও বেড়েছে ১৫ পয়সা।
ডিজেল-কেরোসিনের ক্ষেত্রে ডিলার ও এজেন্টদের কমিশন লিটারে ২ পয়সা করে কমিয়ে আনা হয়েছে। তারা এখন ডিজেলের ক্ষেত্রে লিটারে ২ টাকা ৯৭ পয়সা এবং কেরোসিনে ২ টাকা ১০ পয়সা কমিশন পাবেন।
অকটেনের ক্ষেত্রে ডিলার ও এজেন্টদের কমিশন লিটারে ১৭ পয়সা এবং পেট্রোলের ক্ষেত্রে ১২ পয়সা কমানো হয়েছে। ফলে এখন এক লিটার অকটেন বিক্রি করে তারা পাবেন ৫ টাকা ১৩ পয়সা আর পেট্রোল বিক্রি করে পাবেন ৫ টাকা ০৪ পয়সা।
সরকারের ব্যবসায়ী চরিত্র?
গত ৭ মার্চ ডায়নামিক প্রাইসিং বা স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে পেট্রোল, অকটেন, ডিজেল ও কেরোসিনের মূল্য ঘোষণা করে বাংলাদেশে পেট্রোলিয়াম করপোরেশন, বিপিসি। ওই দিন মধ্যরাত থেকেই নতুন দর কার্যকর হয়।
নতুন দর অনুযায়ী প্রতি লিটার ডিজেল ও কেরোসিনের দাম ১০৯ টাকা থেকে কমে হয়েছে ১০৮ টাকা ২৫ পয়সা, পেট্রোলের দাম ১২৫ টাকা থেকে কমে ১২২ টাকা এবং অকটেনের দাম ১৩০ টাকা থেকে কমে ১২৬ টাকা হয়েছে।
রাজধানীর মহাখালীতে অপেক্ষমান মোটরসাইকেল রাইডার মামুনুর রশীদ বললেন, “রাইড শেয়ার করতে দিনে সর্বোচ্চ ২ লিটার তেল লাগে। ৩ টাকা করে কমলে দিনে আমার বাঁচবে ৬ টাকা। লাভ বলতে এইটুকুই।”
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ এ বিষয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এখন জ্বালানি তেলে স্বয়ংক্রিয় প্রাইসটা চালু হলো। বর্তমানে জ্বালানি তেলের ডিপো, পরিবহন থেকে শুরু করে লোড-আনলোড সিস্টেমগুলো স্বয়ংক্রিয় করার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হচ্ছে।
“যদি আন্তর্জাতিক বাজারে দামের কোনো তারতম্য না হয়, স্বয়ংক্রিয় পরিচালন পদ্ধতি চালু হওয়ার কারণে আগামী বছর থেকে দাম আরও হ্রাস পাবে বলে আমরা আশা করছি।”
২০২২-২০২৩ অর্থবছরের হিসাব বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ওই বছর দেশে ৭৩ লাখ ৪৬ হাজার টন জ্বালানি খরচ হয়েছে। এর মধ্যে ডিজেল কেরোসিনের পরিমাণ ছিল মোট জ্বালানির ৬৮ দশমিক ২৪ শতাংশ।
এ দুই পণ্য মিলিয়ে মোট খরচ হয়েছে ৫০ লাখ টনের কিছু বেশি। পেট্রোল খরচ হয়েছে চার লাখ ৫৪ হাজার টন (৬.১৯%)। আর অকটেন খরচ হয়েছে ৩ লাখ ৯৩ হাজার টন (৫.৩৬%)।
এর মধ্যে কেবল ডিজেল কেরোসিনের হিসাব বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গত বছর মার্চ মাসে সারাদেশে ৪ লাখ ২ হাজার ৬২১ টন ডিজেল বিক্রি হয়েছিল। আর চলতি মার্চে ৪ লাখ ২৩ হাজার ৩৩৭ টন ডিজেল বিক্রি হবে বলে বিপিসি প্রাক্কলন করেছে। ফলে মূল্য হ্রাস বাবদ তাদের আয় কমবে প্রায় ৩১ কোটি ৭৫ লাখ টাকা।
কিন্তু বিপিসি ও এর অধিনস্ত তিন বিতরণ কোম্পানি পদ্মা, মেঘনা ও যমুনার মার্জিন ও পরিচালন ব্যয়ের অংশ যেভাবে বাড়ানো হয়েছে সেখান থেকেও বাড়তি ৩০ কোটি ৯০ লাখ টাকা আয়ের একটি সুযোগ রয়েছে। ফলে ডিজেল কেরোসিনের মূল্যহ্রাস বাবদ সরকারি কোম্পানিগুলোকে রাজস্ব হারাতে হবে না।
দাম নির্ধারণে সরকারের এ ভূমিকার সমালোচনা করে ভোক্তা অধিকার সংগঠন ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সরকারি কোম্পানিগুলো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান হতে পারে না, তাদের লাভ করার সুযোগ নেই। যতটুকু খরচ লাগবে, ততটুকু উসুল করবে, তারা কোনো মুনাফা করবে না।
“সেই মুনাফার বিষয়টা তারা এখন প্রতিষ্ঠিত করে নিয়েছে। ফলে রাষ্ট্রের সংবিধানের মূল চেতনা তারা ভায়োলেট করছে। জ্বালানি খাতে সরকার বরাবরই এই ব্যবসায়ী চরিত্র ধারণ করেছে।”
নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে পাশ কাটিয়ে এভাবে মূল্য নির্ধারণ নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন শামসুল আলম।
তিনি বলেন, “তারা তো বিইআরসির লাইসেন্সধারী সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান মিলে একটা পক্ষ। তারা নিজেদের মূল্য নিজেরা নির্ধারণ করে কীভাবে? একটা স্বাধীন, স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান দিয়ে বিশ্লেষণ করে মূল্যটা নির্ধারণ করতে হবে। বিষয়টি আমরা হাই কোর্টে চ্যালেঞ্জ করেছিলাম। বিচার প্রক্রিয়াধিন থাকা অবস্থায় তারা নিজেরা নিজেরা দাম নির্ধারণ করল।”
এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে বিপিসির চেয়ারম্যান এ বি এম আজাদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে সরকারের ‘পলিসি’ হল ‘বেজলাইন’।
“দীর্ঘদিন পর হঠাৎ কমানো হচ্ছে, হঠাৎ বাড়ানো হচ্ছে। সেই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার জন্যই এ স্বয়ংক্রিয় পক্রিয়া। মানুষ হয়ত আগের আচরণ অনুযায়ী ভেবে বসে আছে যে, অনেক কমবে। কিন্তু এখন আন্তর্জাতিক বাজার থেকে কেনার সঙ্গে ভ্যাট, ট্যাক্স ও অন্যান্য ব্যয়ের সংযোগ ঘটেই কিন্তু তেল ভোক্তার হাতে যাচ্ছে।
“বিপিসি এককভাবে এই দামটি নির্ধারণ করেনি। পুরো সরকারি সিস্টেমে নীতি নির্ধারকরা বসে ঠিক করছে যে, এটার মূল্য এই হবে। এখন যেটা নির্ধারিত হয়েছে এটা কেবল শুরু। এর সঙ্গে মাসে মাসে যোগ বিয়োগ করে একটা স্থিতিশীল জায়গায় পৌঁছানো যাবে। এক বছর আগের মূল্যের সঙ্গে তুলনা করতে গেলে একটা ভুল বার্তা যাবে।”
সর্বশেষ ২০২২ সালের অগাস্টে জ্বালানি তেলের দাম ৪২ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছিল। ওই মাসের শেষ দিকে এসে আবার ডিজেল, কেরোসিন, পেট্রোল অকটেনের দাম গড়ে ৫ টাকা হারে কমানো হয়।
প্লাটসের (জ্বালানি সংক্রান্ত তথ্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান) বরাত দিনে বিপিসির চেয়ারম্যান এবিএম আজাদ তখন বলেছিলেন, অগাস্টে অপরিশোধিত তেলের গড় মূল্য ছিল ব্যারেলপ্রতি (১৫৮ দশমিক ৯৯ লিটার) ১২৬ ডলার ৫৯ সেন্ট। এর সঙ্গে প্রতি ব্যারেলে ১১ ডলার প্রিমিয়াম, ট্যাক্স-ভ্যাট, ডিলার কমিশন যোগ হবে।
সর্বশেষ স্বয়ংক্রিয় মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে গত ২১ জানুয়ারি থেকে ২০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিশ্ববাজার মূল্যের গড় ধরে হিসাব করা হয়েছে বলে বিপিসির কর্মকর্তাদের কাছ থেকে জানা গেছে। প্রতি মাসে মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে এভাবেই আগের নির্দিষ্ট এক মাসের ক্রয় মূল্য বিবেচনায় নেওয়া হবে।
হিসাব করে দেখা গেছে, গত দেড় বছর আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম ৩৯ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে (১৩৭ ডলার বিয়োগ ৮৩ ডলার)।
আর বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, একই সময়ের মধ্যে টাকার বিনিময়ে ডলারের শক্তি বেড়েছে ১৩ দশমিক ৬৩ শতাংশ। অর্থাৎ ২০২২ সালের অগাস্টে এক ডলার সমান ৯৫ টাকা থাকলেও এখন সেটা ১১০ টাকায় উঠেছে।
২০২২ সালের অগাস্টের ১০ তারিখের এক সংবাদ সম্মেলনে বিপিসির চেয়ারম্যান বলেছিলেন, “এই আট দিনের গড় যদি করি, লিটারে ২৫ টাকার মতো লাভ থাকছে অকটেনে। আর ডিজেলে তখনও লোকসান হচ্ছিল লিটারে ৬ টাকা করে।”