পায়রা বন্দর নিয়ে নানা শঙ্কার জবাবে চেয়ারম্যান বললেন, ‘নির্দ্বিধায় জাহাজ আনুন’

“এটা হচ্ছে স্মার্ট পোর্ট, এখানে সবই হবে অটোমেটেড,” বলেন পায়রা বন্দরের চেয়ারম্যান সোহায়েল।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 Feb 2023, 04:58 PM
Updated : 26 Feb 2023, 04:58 PM

পায়রা বন্দর নিয়ে নানা সংশয় ব্যবসায়ীদের মনে; বড় জাহাজ ঠিকমত ভিড়তে পারবে কি না, সেখান থেকে মালামাল ছোট জাহাজে করে অন্য জায়গায় নেওয়ার নাব্য থাকবে কি না।

আবার আন্ধারমানিক সেতু না হওয়ায় সড়ক পথেও সমস্যা, পলি পড়ে বন্দরের চ্যানেল ভরাট হবে কি না, আর বন্দরেই বা ঘুষ ছাড়া কি সেবা মিলবে- এমন নানা প্রশ্নের উত্তরে তাদের অভয় দিলেন বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল মোহাম্মদ সোহায়েল।

তিনি বললেন, “পায়রা হচ্ছে দেশ স্বাধীনের পর নির্মিত প্রথম বন্দর। এখানে একদল তরুণ উদ্যম নিয়ে কাজে ‍যুক্ত হয়েছেন। এটা হচ্ছে স্মার্ট পোর্ট, এখানে সবই হবে অটোমেটেড।

“৩ মার্চ পায়রায় ভিড়ছে ৩৫ হাজার টনের জাহাজ। আপনারাও নির্দ্ধিধায় এই বন্দরে জাহাজ আনান, একবার দেখে যান আমাদের সার্ভিস।”

রোববার রাজধানীর বিআইডব্লিউটিএ ভবনের মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি মিলনায়তনে ‘পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ ও বন্দরের অংশীজনের মধ্যে মতবিনিময়’ সভায় ব্যবসায়ীদের নানা প্রশ্নের উত্তর দেন বন্দরের চেয়ারম্যান। এতে বন্দর কর্মকর্তাদের পাশাপাশি দেশের জাহাজখাতের সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা বক্তব্য দেন।

সভার শুরুতে পাওয়ার পয়েন্টে তথ্য উপস্থাপন করেন বন্দরের কর্মকর্তারা। তাদের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে বাণিজ্যিক অপারেশন শুরুর পর পায়রা বন্দর এখন পর্যন্ত মোট ২৬৯টি বিদেশি জাহাজ, ১০৫৩টি লাইটার জাহাজের মোট ৮৭ লাখ টন কার্গো হ্যান্ডেল করেছে। এ থেকে সরকার ৮০০ কোটি টাকা আয় করেছে।

এর মধ্যে প্রথম বছর ২০১৯ সালে বিদেশি জাহাজের সংখ্যা ছিল ২২টি, যেখানে ২০২২ সালে বন্দরে ভিড়েছে ১২১টি বিদেশি জাহাজ। পায়রার বহির্নোঙরে পণ্য আনা-নেওয়া চট্টগ্রাম ও মোংলার চেয়ে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ সাশ্রয়ী বলেও জানালেন কর্মকর্তারা।

উদাহরণ দিয়ে উপস্থাপনায় বলা হয়, পায়রা দিয়ে ৩০ হাজার টন পণ্য আনা-নেওয়া করলে চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ে প্রায় ৫ লাখ টাকা এবং মোংলার চেয়ে প্রায় ২৫ লাখ ৮১ হাজার টাকা সাশ্রয় করা সম্ভব।

অপরদিকে পায়রার অভ্যন্তরীণ নোঙ্গরে (ইনার অ্যাংকোরেজে) পণ্য আনা নেওয়ায় মোংলার চেয়ে ২৭ লাখ ৮২ হাজার টাকা সাশ্রয় করা সম্ভব। চট্টগ্রাম বন্দরে ইনার অ্যাংকোরেজে পণ্য খালাস হয় না, সেখানে জাহাজ থেকে জাহাজে পণ্য নামানো হয়।

পায়রায় গাড়ি খালাস করলে সেটাও চট্টগ্রাম ও মোংলার চেয়ে সাশ্রয়ী বলে দাবি কর্মকর্তাদের। সড়ক ও নৌপথে এই বন্দর ঢাকার সবচেয়ে কাছে। অচিরেই এই বন্দরে যুক্ত হচ্ছে রেল।

ঘুষমুক্ত বন্দর চান ব্যবসায়ীরা

অংশীজনদের আলোচনাপর্বে বাংলাদেশ শিপার্স কাউন্সিলের পরিচালক সৈয়দ মো. বখতিয়ার বলেন, “মোংলা একসময় করাপশনে তুঙ্গে ছিল। কাস্টমস আর বন্দর কর্মকর্তাদের অত্যাচারে সেখানে ব্যবসায়ীরা কেউ যেত না।

“… মোংলা বন্দরের কার্যক্রম একসময় স্তিমিত হয়ে গেল। তারপরে কর্তৃপক্ষ মোংলায় গাড়ি আমদানিকারকদের জন্য বিশেষ ট্যারিফ ঘোষণা করল। এরপর পুরো গাড়ি ব্যবসা মোংলায় শিফট করল।”

‘এরকম হেনস্তা’ এখন চট্টগ্রাম বন্দরে হতে হয় উল্লেখ করে তার ভাষ্য, “মোংলার মতো এখন চট্টগ্রাম বন্দরে চলছে। চট্টগ্রাম বন্দরে আমদানিকারকদের নাজেহাল হতে হয়। প্রত্যেকটা আমদানিকারককে আমরা মনে করি অসৎ। মনে করি যে, সে মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে অবৈধ মাল নিয়ে আসছে।

“আসলে এরকম করে এক-দুই বা তিনজন ব্যবসায়ী, সেটার জন্য আপনাদের ব্যবস্থাও আছে। আপনাদের ব্যবসাবান্ধব কাস্টমস ব্যবস্থা সেখানে করতে হবে।”

বখতিয়ার বলেন, “আপনারা এখানে সৎ লোক বসান। পরিকল্পনা হোক ব্যবসাবান্ধব। অর্থনৈতিক সাশ্রয় যেখানে আছে, সেখানে ব্যবসায়ীরা যাবেই। এই বন্দরটা নতুন, এখানে সেই সুযোগ আছে। এটাকে আমরা ব্যবসায়ীবান্ধব, ঘুষমুক্ত একটা বন্দরে পরিণত করতে চাই।

“যদি উদাহরণ তৈরি করতে পারি যে এখানে স্বল্প সময়ে স্বল্প খরচে পণ্য পরিবহনের সুবিধা রয়েছে, তাহলে আপনাদের আর কাউকে ডাকা লাগবে না। ব্যবসায়ীরাই আপনাদের দরজায় গিয়ে হাজির হবে।”

নানা বিষয়ে সন্দেহ তাদের

বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান সৈয়দ ইকবাল আলী শিমুল বললেন, “পায়রা বন্দর নিয়ে এতদিন কারও কাছে আশার বাণী শুনিনি। আজকে তারা অনেক তথ্য দিলেন, মনের কিছুটা পরিবর্তন হল। আমরা বলি, এখনও এই বন্দরের অনেক কিছু পরিষ্কার না।

“ওয়েবসাইটে বলছে বেসিনে ১৭ মিটার ড্রাফট (গভীর)। কিন্তু ওনারা আজকে বলছেন, সাড়ে ১০ মিটার পর্যন্ত দিতে পারবেন। আবার জাহাজ যেখানে ভিড়বে, সেখানকার গভীরতার বিষয়টা এখনও স্পষ্ট নয়। এটা যদি সত্যি সত্যি ন্যাচারালি ১০ মিটার গভীরতা থাকে, আর বার্থেও যদি আমরা ১০ থেকে ১১ মিটারের (গভীরতার) জাহাজ রাখতে পারি; তো ইট ইজ ওয়ান্ডারফুল।”

সৈয়দ ইকবাল বলেন, “পায়রা বন্দরকে আমি অনুরোধ করব, সেবার মানটা যেভাবে বলছেন- সেভাবে রাখবেন। সাথে সাথে কাস্টমসের সার্ভিস…এখন আমাদের যে লোকেরা সেখানে কাজ করেন, তাদের অনেক দৌড়াদৌড়ি করতে হয়।

“এই যে আমাদের এনবিআরের ভাইয়েরা, কাস্টমস, বন্দরের ভাইয়েরা আছেন… ওনারা যখন চেয়ারে যাবেন এবং বসবেন, ওনারা কিন্তু আগের মতোই মূর্তি ধারণ করবেন।… আমরা দ্বারে দ্বারে গিয়ে আকুতি করি। আমাদের অনেকের মিনিস্ট্রিতে ঢোকার সুযোগ হয় না।”

বন্দর থেকে অভ্যন্তরীণ নদীপথটি নিয়ে কথা বলেন বাংলাদেশ কোস্টাল শিপ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শেখ মাহফুজ হামিদ।

তার কথায়, “এখন আপনারা যেখানে বলছেন ৫ মিটার (পানির গভীরতা), আমাদের সাম্প্রতিক তথ্য বলছে খুব উঁচু জোয়ারে আমরা সেখানে সর্বোচ্চ সাড়ে ৩ মিটার পেতে পারি। বেশ কিছু বাঁক আছে, যেখানে (জাহাজ) ঘোরানো যায় না, অনেক পলি পড়েছে। আন্ধারমানিক ব্রিজও এখনও হয়নি। যার কারণে সড়ক যোগাযোগেও সমস্যা।”

তিনি বন্দরে লাইটার জাহাজের জন্য সেইফ জোন ও বিপিসির একটা (তেলের) ডিপো স্থাপনের দাবি করেন।

বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার্স অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক সুমন হাওলাদারও ব্যবসা করতে গিয়ে নাজেহাল হওয়ার কথা বললেন।

তার ভাষ্য, “পায়রা বন্দরে এখনও কাস্টমস হাউজ হয়নি। আমাদের লোকদের ৬৫ কিলোমিটার দূরে পটুয়াখালী গিয়ে কাজ শেষ করে আবারও বন্দরে আসতে হয়।”

‘নির্দ্বিধায় জাহাজ আনুন’

অনুষ্ঠানের শেষে বক্তব্য রাখেন বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান এম সোহায়েল। তিনি ব্যবসায়ীদের সব ‘সন্দেহ’ দূরে রেখে সরেজমিনে বন্দরে আসার আহ্বান জানান।

পলি পড়া নিয়ে ব্যবসায়ীদের উদ্বেগের জবাবে চেয়ারম্যান বলেন, “চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরের চ্যানেলও নিয়মিত মেইনটেন্স করতে হয়। এখানেও তার ব্যত্যয় ঘটবে না। আপনারা পলির বিষয়টি বন্দর কর্তৃপক্ষের উপরেই ছেড়ে দিন, ভরসা রাখুন।

“এর বাইরে বন্দরমুখী নদীপথের কয়েকটি জায়গায় সমস্যা আমরাও চিহ্নিত করেছি। সেজন্য বিআইডব্লিউটিএকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। সামান্য ড্রেজিংয়েই সেই সমস্যাগুলোর সমাধান সম্ভব হবে। আর আন্ধারমানিক সেতুর জয়গায় আমরা ফেরি সার্ভিস চালুর উদ্যোগ নিয়েছি। পদ্মা সেতু থেকে সেখানে ফেরি যাবে। আগামী মাসেই এই সেতুর টেন্ডার প্রক্রিয়া হয়তো সম্পন্ন হবে।”

চেয়ারম্যান সোহায়েল বলেন, “এই মার্চেই পায়রা বন্দরে ভিড়তে যাচ্ছে ৩৫ হাজার টনের একটি ‘প্যানামেক্স’ জাহাজ। সামনের এপ্রিলের মধ্যে পায়রার মূল চ্যানেল ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের কাজ শেষ হলে সেটি সাড়ে ১০ মিটার গভীরতা পাচ্ছে। জোয়ারের সময় ড্রাফট দাঁড়াবে সাড়ে ১২ মিটার।

“আগামী মে মাসেই প্রথম টার্মিনালের নির্মাণ কাজ শেষ হবে। বন্দরের ইনার চ্যানেলেই একসাথে ১০ থেকে ১৫টি মাদার ভেসেলের ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা, কন্টিনজেন্সি অ্যাংকরেজের সুবিধাসহ আরও অনেক সুবিধা থাকবে।”

পানামা খাল পার হতে পারে- এমন সর্বোচ্চ আকারের জাহাজ এই খাতে ‘প্যানামেক্স’ জাহাজ হিসেবে পরিচিত। এমন একেকটি জাহাজ ৪০ থেকে ৫০ হাজার টন ধারণ ক্ষমতার হতে পারে, বহন করতে পারে কয়েক হাজার কন্টেইনার। এদের জন্য সর্বোচ্চ সাড়ে ১২ মিটার পানির গভীরতার (ড্রাফট) প্রয়োজন হয় বলে খাত সংশ্লিষ্টরা জানাচ্ছেন। বিশ্বব্যাপী পণ্য পরিবহনে এমন জাহাজের প্রচলন বেশি।

পায়রা বন্দরের চেয়ারম্যান বলছেন, “আগামী এপ্রিল থেকেই বন্দরে প্যানামেক্স জাহাজ ভিড়তে কোনো সমস্যা হবে না। জেটি এলাকায় পানির গভীরতা এখনই সাড়ে ১৭ মিটার রয়েছে।”

তিনি বলেন, “১ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলারের এই প্রকল্প হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ১০টি বড় প্রকল্পের একটি। তিনি নিজেই প্রতিদিন এর আপডেট নেন।

“আধুনিক একটি মাস্টারপ্ল্যানের আওতায় এই বন্দরে আগামীতে যুক্ত হচ্ছে মাল্টিপারপাস টার্মিনাল, দুটি কন্টেইনার টার্মিনাল, লিকুইড বাল্ক টার্মিনাল, কোল টার্মিনাল, এলএনজি টার্মিনাল ইত্যাদি। এই বন্দরে বিপজ্জনক পণ্য খালাসের জন্য থাকবে পৃথক টার্মিনাল।

এ বন্দরকে কেন্দ্র করে শিল্প নগরী ও বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে উঠছে জানিয়ে তিনি বলেন, জাহাজ নির্মাণ ও জাহাজ ভাঙা শিল্প বিমানবন্দর, পর্যটনসহ অন্যান্য সেবাখাতের বিকাশ হচ্ছে। পদ্মা সেতু এ বন্দরের বিস্তারকে আরও তরান্বিত করেছে।

বিদেশি বিনিয়োগকারীরা এখানে বিনিয়োগের জন্য আগ্রহ দেখাচ্ছেন জানিয়ে তিনি বলেন, অদূর ভবিষ্যতে এ বন্দর হয়ে উঠবে দক্ষিণ এশিয়ার বৈদেশিক বাণিজ্যের সবচেয়ে বড় কেন্দ্র।