চিনির সঙ্কটের ৩ কারণ দেখালেন ব্যবসায়ীরা

চিনির বাজার স্বাভাবিক হচ্ছে, বললেন ভোক্তা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 Oct 2022, 03:27 PM
Updated : 24 Oct 2022, 03:27 PM

কাঁচামালের সঙ্কট না থাকলেও চিনির বাজারে চলছে অস্থিরতা; এজন্য তিনটি কারণ দেখালেন ব্যবসায়ীরা।

সোমবার ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে এক মতবিনিময় সভায় এসে শিল্পগ্রুপগুলোর প্রতিনিধিরা গ্যাস সঙ্কটকেই বড় কারণ হিসেবে দেখান। এর সঙ্গে এলসি খোলা ও ডলার সঙ্কটকেও কারণ দেখান তারা।

চিনি পরিশোধনকারী প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধরা বলেন, কেবল গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক থাকলেই হবে না, পর্যাপ্ত চাপও নিশ্চিত করতে হবে।

জবাবে পেট্রোবাংলার প্রতিনিধি গ্যাস সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দেন।

সরকারের বিপণন সংস্থা টিসিবির হিসাবে দেশে চিনির দাম এক বছরে ১৯.৫০ শতাংশ বেড়েছে। সম্প্রতি বাজারে চিনি সরবরাহও কমে যায়।

এর মধ্যেই ভোক্তা অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ের সভাকক্ষে চিনির সরবরাহ ও মূল‍্য স্থিতিশীল রাখার লক্ষ‍্যে মতবিনিময় সভার আয়োজন হয়।

সভায় বাংলাদেশ সুগার রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব ও দেশবন্ধু চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম রহমান বলেন, “আমাদের কাঁচামালের দাম বেড়েছে। আমাদের ডলারের দাম অনেক বেশি। আর এখন চলছে গ্যাসের সমস্যা। এগুলা সমাধান করলে চিনির সমস্যা হবে না।”

কাঁচামালের কোনো সমস্যা নেই জানিয়ে মেঘনা গ্রুপের ডেপুটি অ্যাডভাইজর শফিউর রহমান বলেন, “গ্যাসের সাপ্লাই কমায় আমরা উৎপাদন করতে পারছি না। গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারলে উৎপাদনে কোনো সমস্যা হবে না।”

তার কথার সূত্র ধরেই আব্দুল মোনেম গ্রুপের এজিএম মোস্তাফিজুর রহমান খান বলেন, “গ্যাস থাকলেই হবে না। ১৪-১৫ পিএসআই যদি থাকে, এ প্রেসার দিয়ে প্রোডাকশন করা যাবে। নয়তো হবে না। বর্তমানে আমাদের ২০ শতাংশ প্রোডাকশন হচ্ছে; যা প্রোডাকশন হচ্ছে, সেগুলো আমরা ডেলিভারি দিচ্ছি।

“আরেকটা হলো, ডলার। আর এখন এলসি করা যাচ্ছে না, বাংলাদেশ ব্যাংক এলসির অনুমতি দিচ্ছে না। অন্যান্য ব্যাংকগুলোও এলসি খুলতে চাচ্ছে না। এর সমাধান তো সরকারকে করতে হবে। গ্যাসের সংকট, ডলারের সেটেলমেন্ট, এলসি খোলা এই তিনটার সমাধান যদি করা যায়, তাহলে চিনির কোনো সমস্যা হবে না।”

“যা চিনি আছে, আগামী ৩-৪ মাস চলবে। তারপর কী হবে, তা বলা যাচ্ছে না,” বলেন তিনি।

Also Read: বাজারের চিনি গেল কোথায়?

Also Read: চিনি উৎপাদন কমেছে, গ্যাস সংকটকে দুষছে সিটি ও ফ্রেশ গ্রুপ

সিটি গ্রুপের উপদেষ্টা অমিতাভ চক্রবর্তী বলেন, “যদি মিলগুলো চালানো যায়, তাহলে আমাদের ৫ গ্রুপের সক্ষমতা ১৪-১৫ হাজার মেট্রিক টন। আমাদের প্রত্যেকের ৩ মাসের মতো কাঁচামাল আছে। এলসিও করা আছে অনেকের। আমাদের মূল সমস্যা গ্যাস।

“আমাদের স্টিম চালাতে হয়। স্টিমের জন্য একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ গ্যাসের চাপ লাগে। প্রেসার না পেলে প্রোডাকশন হবে না। তাই এই গ্যাসের সমস্যা সমাধান হলে বাজারে চিনির অভাব হবে না।”

অমিতাভ জানান, প্রতিদিন ৫০০০ মেট্র্রিক টন চিনি উৎপাদন করার সক্ষমতা থাকলেও রোববার তারা গ্যাস সমস্যার কারণে মাত্র ১৪০০ মেট্র্রিক টন চিনি উৎপাদন করতে পেরেছেন। 

“আপনারা যদি গ্যাসের সমস্যা সমাধান করে দিতে পারেন, তাহলে এটুকু নিশ্চয়তা দিচ্ছি যে বাজারে চিনির অভাব হবে না। সবারই কম বেশি মজুদ আছে, চিনিটা দিতে পারব।”

তবে এস আলম গ্রুপের সিনিয়র জেনারেল ম্যানেজার কাজী সালাউদ্দিন আহমেদ জানান, তাদের কারখানায় গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক থাকায় তাদের উৎপাদনও স্বাভাবিক আছে।

“আমাদের ক্যাপাসিটি হল ৮০০-৯০০ টন। আমরা শতভাগ ক্যাপাসিটিতে সরবরাহ দিচ্ছি এই মুহূর্তে। আমরা ভাগ্যবান এই কারণে যে আমাদের গ্যাসের সাপ্লাই মারাত্মক আকার ধারণ করেনি। আমাদের সরবরাহ ঠিক আছে। আমাদের ৪-৫ মাসের মতো স্টক আছে আরও।”

সভায় ভোক্তা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, “গ্যাসের যে চাপের বিষয়টি, তা আমি দেখছি। আমি প্রতিনিয়ত পেট্রোবাংলার সাথে যোগাযোগ রাখছি।”

এই আলোচনায় সভায় উপস্থিত পেট্রোবাংলার এক মুখপাত্র বলেন, কিছু কিছু জায়গায় গ্যাসের প্রেসার কম আছে। তবে তা আগামী দুই-একদিনের মাঝেই ঠিক হয়ে যাবে।

চিনির বাজার ‘স্বাভাবিক হচ্ছে’

ভোক্তা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সফিকুজ্জামান বলেন, “চিনির প্রোডাকশন বাড়ানো হচ্ছে, বাজার আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হবে। এইটা আমি বলতে পারব না যে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে হবে। আমরা প্রোডাকশন এবং ডিস্ট্রিবিউশন নিশ্চিত করছি। এটার ইম্প্যাক্ট শিগগিরই পড়বে। এটুকু বলতে পারি যে কালকেই ৫ টাকা দাম কমে যাবে। কিন্তু পঞ্চগড় পর্যন্ত চিনি যেতে সাপ্লাই চেইনে ৬-৭ দিন লাগে। এটুকু আপনাদের ধৈর্য ধরতে হবে।”

কাঁচামালে সঙ্কট না থাকলেও সরবরাহ ঘাটতির পেছনে কারসাজি রয়েছে বলে সন্দেহ প্রকাশ করেন সফিকুজ্জামান। এজন্য অধিদপ্তরের অভিযান চালিয়ে যাওয়ার কথা বলেন তিনি।

ব্যবসায়ীদের আশ্বস্ত করে তিনি বলেন, “অভিযান হলে আপনারা দোকান বন্ধ রেখে চলে যান। আমি কথা দিচ্ছি, পাকা ভাউচার রাখলে কোনো অফিসার যাবে না। নির্ধারিত দামে চিনি বিক্রি করবেন, অভিযান হবে না। তবে স্টক রাখলে সেখানে অভিযান চলবে।”

চিনির জোগানের বিষয়ে সফিকুজ্জামান বলেন, “আমাদের প্রতিদিন ৫০০০ মেট্রিক টন কনজাম্পশন আছে। সবমিলিয়ে ৩৫০০ মেট্রিক টন উৎপাদন হচ্ছে। মেঘনা বা সিটি গ্রুপ একাই কিন্তু ৫০০০ মেট্রিক টন উৎপাদন করতে পারেন। তাদের কাছে সেই র ম্যাটেরিয়ালও আছে। আমরা যদি উৎপাদন ৫০০০ মেট্রিক টন করতে পারি এবং তা ডিস্ট্রিবিউট করতে পারি, তাহলে সমাধান হবে।

“প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিবের সাথে সকালে মিটিং করেছি। আজকে রাতের মাঝে চিনির সাপ্লাই ঠিক হবে, এটি তারা কমিট করেছে। আগামীকাল থেকে বাজারে এর প্রভাব পড়বে। চিনি নিয়া দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নাই। প্যানিকড হয়ে বাজারে চাপ সৃষ্টি করবেন না।”

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মঞ্জুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার বলেন, “প্রত্যেকটা মিলে ৪০-৫০% উৎপাদন কম হচ্ছে। সবচেয়ে বড় বিষয়, সরবরাহ মিল থেকে কমে গেছে। কারওয়ান বাজার এবং মৌলভীবাজারে সাপ্লাইটা বাড়ানোর জন্য বলেছি।”

ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, “মানুষ যেন হয়রানির শিকার না হয়। মিল মালিকদেরকে বলছি, তাদের পকেটের টাকা কিন্তু ভোক্তার পকেটের টাকা।”

দেশবন্ধুর এমডি গোলাম রহমান বলেন, তাদের চিনিকলেও যথেষ্ট মজুদ রয়েছে।

“আজকে সরকারের উচ্চ মহলের সাথে কথা বলেছি। খুচরা ব্যবসায়ীদের বলছি যে চিনি লাগলে আমাদের সাথে যোগাযোগ করবেন। আমরা চিনি দিয়ে দেব, সরকারি রেটে পেমেন্ট করবেন। আপনার কয় গাড়ি চিনি লাগে, আমার কাছে চাইয়েন; কোনো চিনির সমস্যা নাই।”

সিটি গ্রুপের অমিতাভ চক্রবর্তী বলেন, “আপনাদের আশ্বাস দিচ্ছি, যেখানে যেখানে সাপ্লাই কম আছে, আমাদেরকে বললে আমরা প্রত্যেকটা মিল থেকে সেটা দেব। ভবিষ্যতে আর কোনো সমস্যা থাকবে না।”

তবে তিনি চিনির দাম আবার পুনর্বিবেচনার সুপারিশ করেন।

মজুদ কত?

বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের উপ-পরিচালক মাহমুদুল হাসানের উপস্থাপিত একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে প্রায় ১ লাখ ৫৪ হাজার ৭৫ মেট্রিক টন অপরিশোধিত চিনি মজুদ আছে এবং ২ লাখ ২১ হাজার ৬০০ মেট্রিক টন অপরিশোধিত চিনি আমদানির পাইপলাইনে রয়েছে।

তিনি বলেন, “বর্তমানে যা মজুদ আছে, তা দিয়ে ৩৫-৪০ দিন চলার অবস্থা রয়েছে। স্টকে কোনো ঘাটতি নেই। পাইপলাইন এবং লোকাল স্টক মিলে প্রায় ৩ মাস ভালোভাবে চলতে পারব।”

মাহমুদুল জানান, বাংলাদেশে মোট ১৮-২০ লাখ মেট্রিক টন পরিশোধিত চিনির চাহিদা রয়েছে এবং চাহিদার ৯৫ শতাংশের বেশি মেটানো হয় আমদানিকৃত অপরিশোধিত চিনি পরিশোধনের মাধ্যমে।

এদিকে, স্থানীয়ভাবে শুধু আখ থেকে প্রায় ৩০-৩৫ হাজার মেট্রিক টন চিনি উৎপাদন হয়।

দেশের বড় চিনি উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলোর কার কাছে কত মজুদ আছে, তাও তুলে ধরেন বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের উপ-পরিচালক মাহমুদুল।

  • সিটি গ্রুপে বর্তমানে অপরিশোধিত চিনির মজুদ ৩৮ হাজার মেট্রিক টন এবং পাইপলাইনে প্রায় ৬১ হাজার মেট্রিক টন।

  • মেঘনা গ্রুপে ২৩ হাজার মেট্রিক টন মজুদ আছে, পাইপলাইনে ৫৫ হাজার ৬০০ মেট্রিক টন।

  • এস আলম গ্রুপে মজুদ আছে ৬৬ হাজার ৬৭৫ মেট্রিক টন, পাইপলাইনে আছে ১ লাখ ১০ হাজার মেট্রিক টন।

  • আব্দুল মোমেন স্যুগার রিফাইনারিতে মজুদ আছে ২২ হাজার মেট্রিক টন, ৫৫ হাজার মেট্রিক টন আছে পাইপলাইনে।

  • দেশবন্ধুতে মজুদ রয়েছে ৪ হাজার ৪০০ মেট্রিক টন, ৫৫ হাজার মেট্রিক টন পাইপলাইনে।

মাহমুদুল বলেন, “২০২১ সালে যে হারে চিনি চিনি এসেছিল, ২০২২ সালেও সমান হারে এসেছে, তাই চিনির ঘাটতি থাকার কথা না।”

গত ৬ অক্টোবর চিনি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বৈঠকে প্রতি কেজি খোলা চিনি ৮৫ টাকা এবং পরিবেশক মূল্য ছিল ৮৭ টাকা এবং সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ৯০ টাকা নির্ধারণ হয়েছিল। প্যাকেটের ক্ষেত্রে মিল রেট ছিল ৯০ টাকা এবং সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ছিল ৯৫ টাকা।

“কিন্তু গতকালকে মার্কেট থেকে যে চিত্র আসছে, তাতে দেখা যায় যে প্রতি কেজি খোলা চিনি ১০০-১০৫ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে, যা সরকার নির্ধারিত মূল্যের থেকে ১০-১৫ টাকা বেশি,” বলেন মাহমুদুল।