লাভ ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখিয়ে পুঁজিবাজার থেকে অর্থ তুলছে কয়েকটি কোম্পানি, কিন্তু কাজ হয়ে যাওয়ার পরপরই লোকসান দেখাচ্ছে তারা, আর তখন মাথায় হাত পড়ছে প্রলুব্ধ বিনিয়োগকারীদের।
Published : 24 Apr 2014, 07:43 PM
এমন ঘটনা ঘটেছিল ২০০২ সালে পদ্মা সিমেন্টের ক্ষেত্রে। ওই বছরই আকর্ষণীয় মুনাফার ঘোষণা দিয়ে পুঁজিবাজারে শেয়ার ছাড়ে কোম্পানিটি।
এরপর ২০১০ সাল পর্যন্ত লাগাতার ক্ষতির সম্মুখীন হতে থাকে পদ্মা সিমেন্ট। শেষ পর্যন্ত ২০১২ সালে দেউলিয়া হয়ে যায় এই কোম্পানি।
সম্প্রতি খুলনা প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং লিমিটেড (কেপিপিএল) তাদের আইপিওর ঘোষণাপত্রে কোম্পানির ব্যাপক মুনাফা হয়েছে বলে দাবি করেছে।
ওই দাবির সূত্র ধরে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের অনুসন্ধানে তাদের দাবির সঙ্গে কোম্পানির আকার ও বাজারের বাস্তবতার কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায়নি।
মাছ ও চিংড়ি রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্যাকেজিং খাতের উদ্যোক্তারাও কেপিপিএলের বিক্রি বাড়ার এই হিসাবকে ‘অস্বাভাবিক ও অবাস্তব’ মনে করছেন।
চলতি বছরের ৪ মার্চ বাজার থেকে ৪০ কোটি টাকার পুঁজি সংগ্রহের জন্য ৪ কোটি শেয়ার ছাড়তে বাংলাদেশে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) কাছ থেকে অনুমতি পায় এই কোম্পানি।
তাদের আইপিওর ঘোষণাপত্রে দেখা যায়, ২০০৯-১০ অর্থবছরে কেপিপিএলের আয় ছিল ৩৪ কোটি টাকা। কিন্তু পরের বছরেই মুনাফা আকাশচুম্বী হয়ে প্রায় আড়াইশ ভাগ বেড়ে ১১৯ কোটি টাকা হয়।
এর পর ২০১১ সালের জুলাই থেকে ২০১২ সালের জুনের মধ্যে কোম্পানির বিক্রি বেড়ে ২০৮ কোটি টাকা হয়। তবে পরের অর্থবছরেই তা কিছুটা কমে ১৯১ কোটি টাকায় নামে।
প্রিন্টিং ও প্যাকেজিং এই কোম্পানির তৈরি পণ্য ব্যবহৃত হয় রপ্তানিযোগ্য হিমায়িত মাছ ও চিংড়ি প্রক্রিয়াজাতকরণের কাজে। আর এই সমস্ত পণ্যের বেশির ভাগটাই কিনে থাকে কেপিপিএলেরই সহযোগী কয়েকটি প্রতিষ্ঠান।
কেপিপিএল দাবি করেছে, তাদের প্যাকেজিং পণ্যের বিক্রি বেড়ে ২০০ কোটি টাকা হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, প্যাকেজিং কোনো ভাবেই রপ্তানির মোট খরচের ১০ শতাংশের বেশি হবে না।
“প্যাকেজিং পণ্য বিক্রি করে ২০০ কোটি টাকা আয় করতে হলে কোনো কোম্পানিকে অন্তত ২ হাজার কোটি টাকার মাছ ও চিংড়ির রপ্তানির ব্যবস্থাপনা করতে হবে।”
২০১১-১২ অর্থবছরে মাছ ও চিংড়ি রপ্তানি থেকে মোট আয় ছিল ৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। তাহলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠবে, কেপিপিএল কি একাই দেশের মোট মাছ রপ্তানির অর্ধেক নিজেরা করে?
মোটেই না, অন্তত তাদের কোম্পানির আইপিও ঘোষণাপত্র তা সমর্থন করে না।
তাতে বলা হয়েছে, প্যাকেজিং খাতে জাতীয় বাজারের মাত্র ১৮ ভাগ শেয়ার কেপিপিএলের। শরিফা প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজার্স লিমিটিডের আছে ২১ শতাংশ, বাংলা প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং লিমিটিডের আছে ১৬ শতাংশ এবং ব্র্যাক প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং লিমিটেডের আছে ২৩ শতাংশ শেয়ার।
ঘোষণাপত্রে কেপিপিএল বলেছে, তাদের আয়ের ৬৭ শতাংশই তাদের সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে আসে।
তিনি দাবি করেন, তাদের বিক্রি তিনগুণ বাড়ার বিষয়টি বিএসইসি যাচাই করে দেখেছে।
“আমরা নতুন মেশিন বসিয়েছি। তাই আমাদের বিক্রিও বেড়েছে।”
তাহলে প্রশ্ন উঠে, প্যাকেজিং পণ্যের বিক্রিতে এধরনের বৃদ্ধির সমান্তরাল সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোর আয়ও কি একইভাবে বেড়েছে?
আমজাদ বলেন, “প্যাকেজিংয়ের খরচ রপ্তানি (পণ্যের) মূল্যের ১৩ শতাংশ হতে পারে।”
এলিট প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজেস-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আরশাদ আলী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “খুলনা প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং ও আমার কোম্পানি ভিন্ন শিল্পে কাজ করে।
“কিন্তু আমি নিশ্চিত বলতে পারি, এই খাতে বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় আমাদের প্রতিষ্ঠান। কেপিপিএলের চেয়ে আমাদের ব্যবসার আকার ১০ গুণ বড়। আমরাও তো এখনো ২০০ কোটি টাকার বিক্রি করতে করতে পারিনি।”
বেঙ্গল মেরিন ফিশারিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বাংলাদেশ মাছ রপ্তানিকারক ও আমদানিকারক সমিতির সদস্য এস এ ওয়াদুদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মাছের দাম যাই হোক, প্যাকেজিংয়ের খরচ প্রতি কেজিতে ১০ টাকা।”
এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করেন বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আমিনুল্লাহও।
আর্ক সি ফুডের এমডি আমিনুল্লাহ বলেন, “৮০০ টাকা দামের এক কেজি চিংড়ির জন্য আমাদের ২০ টাকা প্যাকেজিং খরচ হয়, এটাই সর্বোচ্চ।”
কেপিপিএলের মূল কোম্পানি লকপুর ফিশ প্রসেসিং কোম্পানিও বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য।
তাদের দাবি অনুযায়ী ৯৫০ কোটি টাকার রপ্তানির হিসাবে ১০০ কোটি টাকার বেশি প্যাকেজিং খরচ হওয়ার কথা নয়।
১৯৮৫ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয় জেমিনি সি ফুড। তাদের আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, রপ্তানি করা চিংড়ির প্যাকেজিং খরচ ২ দশমিক ৫ শতাংশেরও কম।
২০১৩ সালে জেমিনির রপ্তানি আয় ছিল ৭৬ দশমিক ৭ কোটি টাকা। প্যাকেজিংসহ আনুষঙ্গিক খরচ ছিল ১ কোটি ৯ লাখ টাকা, যা মোট রপ্তানি আয়ের ২ দশমিক ৪৮ শতাংশ।
২০১২ সালে জেমিনির রপ্তানি দাঁড়ায় প্রায় ১২২ কোটি টাকা, যেখানে প্যাকেজিংসহ আনুষঙ্গিক খরচ হয় ৩ কোটি ১০ লাখ। এটা মোট রপ্তানির ২ দশমিক ৫৪ শতাংশ।
জেমিনির হিসাব নির্দেশক হিসাবে নিলে, কেপিপিলের বিক্রি বাড়ার দাবি অনেক অনেক বেশি।