কেন্দ্রীয় ব্যাংক পরিচালনায় নানামুখী চাপ সহ্য করেও সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে শক্ত অবস্থানে থাকতে হয়, বলেন সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ।
Published : 18 Dec 2022, 12:24 AM
দেশের ব্যাংক থেকে যে পরিমাণ টাকা লুট হয়েছে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিও এত টাকা নিয়ে নিয়ে যেতে পারেনি বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য শামীম হায়দার পাটোয়ারী।
শনিবার ঢাকার মহাখালীর ব্র্যাক সেন্টারে সিপিডি (সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ) ‘সংকটে অর্থনীতি: কর্মপরিকল্পনা কী হতে পারে?’ শীর্ষক সংলাপে তিনি এ মন্তব্য করেন।
তিনি বলেন, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিও এত টাকা লুট করেনি যত টাকা আমাদের দেশের ব্যাংক থেকে লুট হয়ে গেছে। কয়েকবার দেশের শেয়ারবাজারে ধস নামিয়েও বিপুল পরিমাণ টাকা পাচার করা হয়েছে।
“যখন কোনও গোষ্ঠী বা ব্যক্তি হিউজ টাকা অবৈধভাবে আর্ন করে তার লক্ষ্যই থাকবে কীভাবে সে সেইফলি টাকাটা অবৈধভাবে বিদেশে পাচার করে দিতে পারে।”
সংসদে বিরোধীদলের এ সদস্য বলেন, “এটার একটা চক্র হয়ে গেছে। অবৈধভাবে টাকা আয় করা অবৈধভাবে ডিফল্ট লোন নেওয়া, লোনগুলোকে অবলোপন করা এবং টাকা পাচার করা। এই চক্রের মধ্যে আমলারা জড়িত, রাজনীতিবিদ জড়িত এবং একটা দুষ্কৃতিকারী ব্যবসায়ী চক্র জড়িত।“
ব্যাংকলুটের অশুভনীয় উদাহরণগুলোর কারণে শোভনীয় ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করতে অনুৎসাহিত ও নিষ্ক্রিয় হচ্ছেন বলে মনে করেন তিনি।
এই পরিস্থিতি থেকে দেশের অর্থনীতিকে বের করে আনার ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, এটা কোনওভাবেই আর চলতে দেওয়া যায় না। এখান থেকে দেশের অর্থনীতিকে বের করে আনতে হলে পরিবর্তন ও সংস্কার করতে হবেই।
দ্রুত রেমিটেন্স বাড়িয়ে উদ্ভুত পরিস্থিতি মোকাবেলায় বিদ্যমান আড়াই শতাংশ প্রণোদনা বাড়িয়ে ৫ থেকে ১০ শতাংশ করার পরামর্শ দেন তিনি।
সংলাপে সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক পরিচালনায় নানামুখী চাপ সহ্য করেও সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে শক্ত অবস্থানে থাকতে হয়।
“নতুন ব্যাংক দেওয়ার বিষয়ে অনেক চাপ ছিল আমার ওপর। আমি তখন সরকারের কাছে দুইবার ফেরত দিয়েছি।
“আমি বলেছি না আমি দেব না… ফেরত দিয়েছি, যা হওয়ার হবে, আমি দেইনি। সুতরাং এগুলো নিয়ে যদি খুব শক্ত অবস্থান না নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক তাহলে খুব ডিফিকাল্ট হবে।”
টাকা ও ডলারের বিনিময় হারে আমদানি ও রপ্তানির ক্ষেত্রে একেক রকম হওয়ার সমালোচনা করে তিনি বলেন, মুদ্রার বিনিময় হার হবে একটা। এখন রপ্তানির জন্য একটা, আমদানির জন্য একটা। এজন্যই রেমিটেন্স প্রেরণকারীরা ঝামেলায় না গিয়ে হুন্ডিতেই বেশি আগ্রহী হন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শক্তভাবে আইন প্রয়োগের পরামর্শ দিতে গিয়ে উদাহরণ দিয়ে বলেন, “এখন আমি কোনও দিন দেখিনি যে সিআরআর, এসএলআর মাফ করে দেয়, আবার পুঁজি পুনর্ভরণ করে। এটা কিন্তু ব্যাংকের দোষ না।
“এতে সফট হলে কি করে হবে?” প্রশ্ন করেন তিনি।
এসময় ওভার ইনভয়েসিংয়ের একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করে সাবকে এ গভর্নর বলেন, “আমার সময়ে এক প্রতিষ্ঠান বিদেশ থেকে এক কেজি সিম ১৭৫ ডলারে আমদানির তথ্য দিয়েছিল। আমরা ওই প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বাতিল করে দিয়েছিলাম।”
সংলাপে মূল প্রবন্ধে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, “ইউক্রেইন যুদ্ধ দেশের অর্থনীতি সংকটে পড়ার একটি কারণ হলেও দীর্ঘ মেয়াদে কাঠামোগত দুর্বলতার কারণেই আমাদের অর্থনীতি নানামুখী সংকটে পড়েছে।
“বেশ কয়েক বছর ধরেই ডলারের বিপরীতে টাকার মান কৃত্রিমভাবে ধরে রাখা হয়েছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজারে ডলার ছেড়ে টাকার মান ধরে রখেছিল। এখন আমাদের প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় টাকার মান কিছুটা কমে এসেছে, এর ফলে এখন আমাদের রপ্তানি প্রতিযোগিতা কিছুটা বাড়বে।”
এদিকে সিপিডি তাদের গবেষণাপত্রে জানায়, খেলাপি ঋণের পরিমাণ গত ১০ বছরে ৩ গুণের বেশি বেড়েছে। ২০১২ সালে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৪২ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সেই খেলাপির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩৪ হাজার ৩০০ কোটি টাকা।
রাজনৈতিক বিবেচনায় ব্যাংক পরিচালকদের নিয়োগ, একইভাবে ঋণ অনুমোদন, বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনতার অভাব এবং ঋণ খেলাপিদের উল্টো সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার কারণে এই অবস্থা তৈরি হয়েছে বলে মনে করে গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি।
সিপিডির চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহানের সভাপতিত্বে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান ও স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড বাংলাদেশ এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নাসের ইজাজ বিজয় সংলাপে বক্তব্য দেন।