“তিনি মিতব্যয়ী ছিলেন, কিন্তু কৃপণ ছিলেন না,’’ বলেন শেখ বশির।
Published : 18 Jun 2023, 01:26 AM
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও দূরদর্শিতা ও সাহসিকতার কারণে সেখ আকিজ উদ্দিনের মতো সফল উদ্যোক্তা দেশে তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতি বিষয়ক উপদেষ্টা মসিউর রহমান।
তিনি বলেছেন, “আনুষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও সেখ আকিজ উদ্দিন সফল ছিলেন। নতুন উদ্যোগ নেওয়ার সাহস দেখিয়েছেন। কোনও জিনিসের চাহিদা বাড়বে, সেসম্পর্কে আকিজ উদ্দিন ভালো বুঝতেন। এ কারণেই তিনি সফল হয়েছেন।’’
শনিবার সন্ধ্যায় ঢাকার সোনারগাঁও হোটেলে 'শেখ আকিজ উদ্দিন: জীবন ও সময়' স্মারকগ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন।
'শেখ আকিজ উদ্দিন: জীবন ও সময়' স্মারকগ্রন্থটি প্রকাশ করেছে বাণিজ্যবিষয়ক সংবাদপত্র ‘বণিক বার্তা’। অনুষ্ঠানে শেখ আকিজ উদ্দিনের স্ত্রী মনোয়ারা বেগম উপস্থিত ছিলেন।
মসিউর রহমান বলেন, ‘‘যখন আমরা নিজেদের ভাগ্য নিজেরা গড়ার চেষ্টা করলাম স্বাধীনতার পর- তখন থেকে সুযোগের সৃষ্টি হয়েছে। যারা এটির সদ্ব্যবহার করেছেন, তারা প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছেন। দেশের ও সমাজের কল্যাণে কাজ করেছেন।
“অনেকে নিজেদের স্বার্থে এ সুযোগ ব্যবহার করেছেন। তারা হয়ত চমক সৃষ্টি করেছেন সাময়িক সময়ের জন্য। কিন্তু তারা দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারেননি কেউ।’’
সেখ আকিজের উত্তরসূরিদের বিষয়ে তিনি বলেন, “আমাদের দেশে এক বা দুটো প্রজন্ম বেশ ভালো করে। তারপর পরের প্রজন্ম ভালো করে না। এই পরিবারের পরবর্তী প্রজন্ম বেশ ভালো ও নৈতিকতা সম্পন্ন। আশা করি, তারা ভালো করবেন।’’
আনোয়ার গ্রুপের চেয়ারম্যান মানোয়ার হোসেন বলেন, “আমার বাবা আনোয়ার হোসেন ও আকিজ চাচা সমসাময়িক ব্যবসায়ী। তারা সবাই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অনেক উপরে। তারা যখন ব্যবসা শুরু করেছেন, তখনও বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবসায় অনুষদ বিভাগই তৈরি হয়নি।”
বাঙালি মুসলমানদের উদ্যোক্তা হওয়ার যে ইতিহাস, সেখানে প্রথম সারিতেই সেখ আকিজ রয়েছেন মন্তব্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের চেয়ারম্যান রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বলেন, “এ ধরনের একজন উদ্যোক্তা কেন ব্যাংক করেননি- তা নিয়ে আমাদের ভাববার অবকাশ রয়েছে।”
অর্থনীতি বিশ্লেষক মামুন রশীদ বলেন, “বাংলাদেশে উদ্যোক্তাদের নিয়ে বই বা কেস স্টাডির প্রচুর অভাব। ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহীরা খেলাপি ঋণ নিয়ে সবচেয়ে টেনশনে থাকেন। ঋণ নিয়ে অনেকেই হারিয়ে যান। কিন্তু আকিজ সাহেব এক্ষেত্রে ভিন্ন ছিলেন।”
অনুষ্ঠানে আকিজ-বশির গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ বশির উদ্দিন বলেন, ‘‘আমার বাবা নিজে ভোগ্যপণ্য বানাতেন- কিন্তু তিনি কখনও ভোগে বিশ্বাস করেননি। তিনি মিতব্যয়ী ছিলেন, কিন্তু কৃপণ ছিলেন না।’’
আকিজ উদ্দিন নিজের নাম লেখার ক্ষেত্রে ‘স’ ব্যবহার করে ‘সেখ’ বানান লিখতেন। তবে মোড়ক উন্মোচন হওয়া বইয়ে ‘শ’ ব্যবহার করায় তা নিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন আকিজের ছেলে শেখ আমিন উদ্দিন।
তিনি বলেন, “বাবা তার নাম যেভাবে লিখতেন, এখানে সেভাবে লেখা হয়নি। বিষয়টি দৃষ্টি আকর্ষণ করলাম।’’
পরে গ্রন্থটিতে ব্যবহৃত কয়েকটি ঘটনা ও স্থানের বিষয়ে তথ্য সংশোধনী দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা মসিউর রহমান বলেন, “আকিজ উদ্দিনের নামের বানান নিয়ে যে সমস্যা হয়, তা আমার বেলায়ও হয়। অনেকে আমার নামের বানানে ‘শ’ ব্যবহার করেন।’’
‘যাদের বাড়ি দেখছ, তাদের দেশপ্রেম নেই’
সফল শিল্পপতি হওয়ার পরও শুধু দেশ ও মানুষের কল্যাণ ভাবনার কারণেই সেখ আকিজ উদ্দিন বিদেশে বাড়িও কেনেননি বলে স্মৃতিচারণে তুলে ধরেন তার পুত্রবধূ অধ্যাপক জামালুন্নেছা।
তিনি বলেন, ‘‘একবার লন্ডনে বেড়াতে গিয়ে অনেক বাংলাদেশি ব্যবসায়ীর বাড়ি দেখে আমার শ্বশুরকে (আকিজ উদ্দিন) বলেছিলাম, ‘আমাদের কি এত টাকা নেই যে- আমাদের লন্ডনে বাড়ি নেই’।
“জবাবে সেদিন শ্বশুর আব্বা বলেছিলেন, ‘যাদের বাড়ি দেখছ-তাদের দেশপ্রেম নেই’।’’
পরিবারের বিদেশে কোনো সম্পদ নেই জানিয়ে জামালুন্নেছা বলেন, “আমাদের পরিবারের যা আছে, সব দেশেই রয়েছে। সেখ আকিজ উদ্দিন কোনো অর্থপাচার করেননি। তার মতো দেশপ্রেমিক অনেক ব্যবসায়ী আছেন দেশেই- তারাও বিদেশে অর্থপাচার করেননি। আকিজ উদ্দিনরা অর্থপাচার করেন না।’’
অধ্যাপক জামালুন্নেছা বলেন, “মধ্যবিত্তরা সুযোগের সন্ধানে বিদেশে গিয়ে দেশে আর ফিরতে পারেন না। কিন্তু সমাজের ধনী ও উচ্চবিত্তদের তো এই সমস্যা নেই। তারা কেন বিদেশে গিয়ে থেকে যাচ্ছেন? এভাবে আমাদের দেশ থেকে অর্থ ও মেধা পাচার হয়ে চলে যাচ্ছে।’’
মেধার সঙ্গে উদ্যোক্তাও পাচার হচ্ছে জানিয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মজিদ বলেন, “বাংলাদেশে শিল্প উন্নয়নে যেসব উদ্যোক্তা ও ব্যাক্তিত্ব উজ্জ্বল হয়ে আছেন, তার মধ্যে আকিজ উদ্দিন অন্যতম। আমরা যদি নতুন প্রজন্মের উদ্যোক্তাদের কাছে এসব মানুষকে তুলে না ধরতে পারি, তাহলে অনেক বড় গ্যাপ থেকে যাবে।’’
এক গার্মেন্ট মালিকের আক্ষেপের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘‘সেদিন একজন বড় গার্মেন্টস উদ্যোক্তা খুব আক্ষেপ করে বলছিলেন, ‘আমার ব্যবসা মনে হয় শেষ’। কারণ জানতে চাইলে তিনি জানান, তার দুই সন্তান বিদেশে পড়তে গিয়ে আর দেশে ফিরতে চাইছেন না। তারা বলছেন, ‘দেশে এসব গার্মেন্টস চালায়ে কী হবে?’ আমাদের শুধু টাকা পাচার হচ্ছে না। আমাদের উদ্যোক্তা পাচার হচ্ছে। আমাদের মেধা পাচার হয়ে যাচ্ছে।”
অন্যদের মধ্যে বক্তৃতা করেন বণিক বার্তার সম্পাদক ও প্রকাশক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএর সাবেক পরিচালক ড. সৈয়দ ফারহাত আনোয়ার, স্ট্যান্ডার্ড চ্যাটার্ড বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী নাসের এজাজ বিজয়, এসিআই এগ্রোলিংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এফ এইচ আনসারী, আইপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মমিনুল ইসলাম।