“আমরা কিন্তু ফেব্রুয়ারি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কথা বলছি যে, কীভাবে আমরা বাণিজ্য ঘাটতিটা কমাতে পারি। আমাদের বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর ক্ষেত্রে একটা বড় টপিক হচ্ছে জ্বালানি।”
Published : 06 Apr 2025, 07:10 PM
বাংলাদেশি পণ্যে যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত শুল্কের নেতিবাচক প্রভাব ঠেকাতে এলএনজি আমদানির মাধ্যমে দেশটির সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর পরিকল্পনার কথা বলেছেন বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ ইবনে হারুন।
রোববার আসন্ন বিনিয়োগ সম্মেলন নিয়ে ডাকা সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নে তিনি বলেন, “আমরা কিন্তু ফেব্রুয়ারি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কথা বলছি যে, কীভাবে আমরা বাণিজ্য ঘাটতিটা কমাতে পারি। আমাদের বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর ক্ষেত্রে একটা বড় টপিক হচ্ছে জ্বালানি।
“ট্রাম্প প্রশাসন আসার পরে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে, উনারা এলএনজি আবার রপ্তানি করবেন। সে ব্যাপারে আমরা ইতোমধ্যে আমেরিকার সঙ্গে কথা বলছি। সুতরাং আমাদের জন্য জ্বালানি আমদানির নতুন একটা উৎস তৈরি হয়েছে, জিসিসি (গাল্ফ কোঅপারেশন কাউন্সিল) মার্কেটগুলোর বাইরে, আমেরিকা আরেকটি মার্কেট হিসাবে।”
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প তার নতুন 'রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ' নীতির অংশ হিসেবে শতাধিক দেশের পণ্যের ওপর নতুন করে শুল্ক আরোপের যে ঘোষণা দিয়েছেন, তাতে বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের সময় ৩৭ শতাংশ সম্পূরক শুল্কের মুখোমুখি হবে।
এতদিন বাংলাদেশের পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কহার ছিল গড়ে ১৫ শতাংশ। সব মিলিয়ে বাংলাদেশি পণ্যে এখন মোট শুল্ক দাঁড়াবে ৫২ শতাংশ।
বাংলাদেশি তৈরি পোশাকের সবচেয়ে বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশ ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৮৪০ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করে, যার মধ্যে তৈরি পোশাকের পারিমাণ ৭৩৪ কোটি ডলার।
নতুন করে সম্পূরক শুল্ক আরোপের ফলে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত বড় ধাক্কা খেতে পারে বলে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
এ প্রেক্ষাপটে ব্যবসায়ীদের উদ্বেগের মধ্যে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের উপদেষ্টা, বিশেষজ্ঞ ও কর্মকর্তাদের নিয়ে শনিবার জরুরি বৈঠক করেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস।
ওই বৈঠকের পর জানানো হয়, ট্রাম্পের ট্যারিফ ঘোষণার আগে থেকে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সঙ্গে এ বিষয়ে ‘যোগাযোগ রেখে’ চলেছে সরকার। আর শুল্ক নিয়ে ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে সরাসরি কথা বলবেন প্রধান উপদেষ্টা।
যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আরোপের প্রভাবের পাশাপাশি বিনিয়োগের বাধা হিসাবে শিল্পকারখানায় জ্বালানি সরবরাহে ক্ষেত্রে ঘাটতির বিষয়ে প্রশ্নের উত্তর দেন বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান।
এক প্রশ্নে তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র থেকে গ্যাস কিনলে আরোপিত শুল্কের প্রভাব মোকাবেলার পাশাপাশি জ্বালানির উৎসের বহুমুখীকরণও হবে।
“আমরা যদি ওই (যুক্তরাষ্ট্র) মার্কেটটাকে ভালোভাবে কাজে লাগাতে পারি, আমার ধারণা, জ্বালানি সরবরাহের এই যে, সংকট বা ঘাটতি আছে, সেটাকে আমরা মেটাতে পারব। সেটা করতে পারলে, আমরা মনে হয় না এটা নিয়ে সমস্যা হবে।”
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনার প্রসঙ্গ তুলে ধরে তিনি বলেন, “আমাদের প্রস্তুতি আগে থেকেই ছিল। ফেব্রুয়ারি মাস থেকে আমরা যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সঙ্গে কথা বলছিলাম যে, বাণিজ্যটা ঘাটতিটাকে কীভাবে পুনরায় ভারসাম্যপূর্ণ করতে পারি। যখন আমাদের হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ গিয়েছিলেন, তখন ইউএসটিআর থেকে বলেছিল, তোমরা এই প্রশাসনের প্রথম দেশ, যারা এসে বলেছে যে, ‘তোমরা বাণিজ্য ঘাটতিটাকে ভারসাম্যপূর্ণ করতে চাও’। এই কথাটা উনারা স্পষ্টভাষায় বলেছিলেন।
“এই কারণে আমরা গতকালকেই অস্থির হয়ে… কালকেই চিঠি দিয়ে দিতে হবে–এরকম কোনো পদক্ষেপে যাইনি। আমরা মনে করছি যে, আমাদের ইতোমধ্যে একটা এন্ট্রি পয়েন্ট আছে, কারণ উনাদের সাথে আমাদের ইতোমধ্যে যোগাযোগ আছে, সেটার উপর ভিত্তি করে আমরা ঠাণ্ডা মাথায় আমাদের সময়সীমার মধ্যেই সুন্দরভাবে একটা পদক্ষেপের দিকে যাব।”
এ বিষয়ে সরকারের অবস্থান তুলে ধরে চৌধুরী আশিক মাহমুদ বলেন, “আমরা সলিড একটা পরিকল্পনা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের সঙ্গে কাজ এগিয়ে নিতে পারব। আমরা একেবারেই চিন্তিত না।”
যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি এক্সিলারেট এনার্জি থেকে ইতোমধ্যে এলএনজি কেনা শুরু করেছে বাংলাদেশ সরকার। সর্বশেষ ১১ মার্চ সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি ওই কোম্পানি থেকে প্রায় ৬৬৪ কোটি ৪০ টাকা ব্যয়ে এক কার্গো এলএনজি কেনার অনুমোদন দেয়।
বিনিয়োগ সম্মেলনে জ্বালানি ঘাটতির বিষয়ে কী নিশ্চয়তা দেওয়া হবে–এ প্রশ্নে চৌধুরী আশিক মাহমুদ বলেন, “আমাদের প্রধান সমস্যাটা গ্যাস সরবরাহে। বাংলাদেশের গ্যাস সরবরাহের ৫০ শতাংশ আমরা উত্তোলন করি, আর বাকি ৫০ শতাংশ আমাদেরকে আমদানি করতে হয়।
“আমদানি করা গ্যাসের ক্ষেত্রে একটা বড় সমস্যা আমরা মোকাবেলা করেছি যেহেতু আমাদের ডলারের সংকট ছিল, সেই সংকটটার কারণে অনেক সময় আমরা পেমেন্টটা করতে পারিনি। পেমেন্ট করতে না পারার কারণে আমাদের সুনামের ইস্যু হয়ে গিয়েছিল। সে কারণে আমরা যখন নতুন কার্গো আনার জন্য সাপ্লায়ার কনট্রাক্টের জন্য আরএফপি (প্রস্তাব পাঠানোর অনুরোধ) করছি, তখন আমরা আসলে মূল্যের দিক থেকে ভালো কার্গো পাচ্ছিলাম না।”
ডলারের রিজার্ভে ‘স্থিতিশীলতা’ আসার পর সেই অবস্থার পরিবর্তন হওয়ার কথা তুলে ধরে বিডা চেয়ারম্যান বলেন, “গভর্নর এখন বলছেন যে, উনার হয়ত আইএমএফের অর্থায়নটা নাও লাগতে পারে, আমাদের এই স্থিতিশীলতার জন্য।
“যখন আমাদের এই তারল্যটা তৈরি হয়ে যাবে, আমরা আসলে পেমেন্টগুলা করতে পারব, তখন এই যে, ৫০ শতাংশের এই ঘাটতিটা, যেটা আমাদের আমদানি করে আনতে হয়, সেটা খুব সহজ হয়ে যাবে আমাদের জন্য।”
সরবরাহকারীদের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির বাস্তবায়ন হলে ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে বলে আশা প্রকাশ করেন চৌধুরী আশিক মাহমুদ।
তিনি বলেন, “আমরা অনেকগুলো দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি করেছিলাম, যেটা আগের সরকারের সময় করা হয়েছিল, আমি আসলে কৃতিত্ব নেব না, যেগুলো কার্যকর হবে, জানুয়ারি ২০২৬ থেকে; ফেব্রুয়ারির পর থেকে আমাদের চাপটা এমনিতে স্বাভাবিকভাবে কমে যাবে।”
পাইপলাইনের ‘হেভি প্রেশার’ গ্যাস কেবল শিল্পকারখানার জন্য নির্দিষ্ট করে দেওয়ার বিষয়ে বিডার প্রস্তাব নিয়ে সরকার কাজ করছে বলে জানান চৌধুরী আশিক।
তিনি বলেন, “শিল্প কারখানার জ্বালানি সরবরাহটাকে অনেক দেশের সরকার পুরোপুরি নিশ্চয়তা দিয়ে থাকে। বাসাবাড়ির গ্যাসের ক্ষেত্রে মানুষ এলপিজি, সিলিন্ডার প্রভৃতি ব্যবহার করে।
“কিন্তু পাইপলাইনের হেভি প্রেশার যে গ্যাস, সেটা শিল্পকারখানার জন্য নিশ্চিত করা থাকে। আমাদেরকেও সেই দিকে চলে যেতে হবে। যে ভোক্তা রান্না করার জন্য গ্যাস ব্যবহার করে, তার কিন্তু হেভি প্রেশার গ্যাসের দরকার নাই।
“রান্না করার জন্য যেগুলো তাকে কিনতে হবে, সেটা আসবে যখন সে বেতনটা পাবে। তখনই সে বেতনটা পাবে, যখনই শিল্পকারখানাটা চলবে। শিল্পকারখানার গ্যাসকে যে কোনো অগ্রাধিকার আমাদের দিতে হবে। তারপরে বাকিটার বিষয়ে আমাদেরকে পরিকল্পনা করতে হবে।”
মার্কিন শুল্ক সম্পর্কিত বিষয়ে শনিবারের সংবাদ সম্মেলনের প্রসঙ্গ ধরে বিডা চেয়ারম্যান বলেন, “বিনিয়োগ সম্মেলনের আগে এমন একটা ঘটনা ঘটল, সেক্ষেত্রে আমরা কী করতে পারি, সেই প্রশ্নটা আসতে পারে।
“আমাকে যদি জিজ্ঞেস করেন, আমি ‘গ্লাস অর্ধেক ভরা’ দেখছি। এ কারণে যে, আসলে আপনি যদি, উনারা যে পয়েন্ট অব ভিউ থেকে আসছেন, ইউএসটিআরের একটা প্রতিবেদন আছে বাংলাদেশের ব্যাপারে। এটার উপর ভিত্তি করে উনারা অনেকগুলো সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলছেন।
“সেই প্রতিবেদনে আমাদের জন্য কিছু মৌলিক সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে। যে, আমাদের নীতিগত কিছু সংস্কার দরকার, কাস্টমস, দুর্নীতি, মেধাস্বত্ব–এই রকম বেশ কিছু সংস্কারের কথা বলা আছে।”
বিডা চেয়ারম্যান বলেন, “এই সংস্কারগুলো কিন্তু আমরাও করতে চাচ্ছিলাম। আমরাও চাচ্ছিলাম, বাংলাদেশের যে বিনিয়োগ ব্যবস্থা, সেখানে ভবিষ্যতে যেন বিনিয়োগকারীদের জন্য ব্যবসা করাটা সহজ হয়।
“এই অতিরিক্ত ধাক্কাটা আমাদের জন্য উপকারী ফলাফল। বিশেষ করে, আমরা অনেকগুলো রিফর্ম আসলে আমাদের বিনিয়োগ ব্যবস্থার মধ্যে করে ফেলতে পারব। এটার মধ্যে নেতিবাচক কিছু আমি একদমই দেখি না। আমি মনে করি, আমাদের সার্বিক বিনিয়োগ পরিবেশে একটা তাৎপর্যপূর্ণ অগ্রগতি আনা সম্ভব।”
আর যুক্তরাষ্ট্র যে বহু দেশের ওপরই উচ্চ হারে শুল্ক আরোপ করেছে, সে বিষয়টি তুলে ধরে তিনি বলেন, “আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী যে দেশগুলো আছে, তারাও আমাদের সঙ্গে একই নৌকায় আছে। তাদের পথচলা যেদিকে হবে, আমাদেরটা প্রায় সেদিকেই হবে।
“কাজেই, আমি একেবারে চিন্তিত না যে, বিনিয়োগ সম্মেলনের চারদিন আগে হঠাৎ করে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিগত পরিবর্তন আমাদের জন্য বড় আকারে নেতিবাচক হয়ে গেল কি-না। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, এটা আসলে ভালো সংকেত। এটাকে সুযোগ হিসাবে নিয়ে ভবিষ্যতে আমরা আরও ভালো বিনিয়োগ পরিবেশ করার চেষ্টা করব বাংলাদেশে।”
ট্রাম্পের নীতির কারণের মন্দার যে শঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে, বাংলাদেশের বিনিয়োগ পরিবেশে তার প্রভাব কেমন হবে, সেই প্রশ্নও করা হয় বিডা চেয়ারম্যানকে।
তিনি বলেন, বৈশ্বিক সামষ্টিক অর্থনীতিতে যদি নেতিবাচক প্রভাব পড়ে, সেটা সবাইকে সমানকে প্রভাবিত করবে।
“যেমন ডনাল্ড ট্রাম্পের নতুন যে নীতি বা তিনি যে ঘোষণাটা দিয়েছেন, সেখানে কেবল বাংলাদেশ যে মূল্যস্ফীতি আর সুদের হারের ভেতর দিয়ে যাবে তা না, সবাই যাবে। সুতরাং এটা সবসময় আপেক্ষিক তুলনার দৃষ্টিতে দেখতে হবে। আমি সেদিক থেকে মনে করি না যে, সে বিবেচনায় বাংলাদেশের আপেক্ষিক প্রতিযোগিতামূলক সুবিধায় বড় রকমের প্রভাব পড়তে পারে”
তার মতে, এই নীতির কারণে যদি মূল্যস্ফীতির চাপের ভেতর দিয়ে যায়, তাহলে সেটা সবার জন্যই প্রযোজ্য হবে।
“সেক্ষেত্রে আমার মনে হয় না যে বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের জন্য বেশি ক্ষতিকারক হবে।”