“বউ-বাচ্চা নিয়ে এসেছি ছুটির দিনে। আসলে আমাদের তো আনন্দের উপলক্ষ কমে যাচ্ছে দিনকে দিন। তার মধ্যে এই মেলায় এসে একটু আনন্দ হল, এইত।”
Published : 24 Jan 2025, 11:53 PM
বাণিজ্যমেলার উদ্দেশ্যে বের হয়ে বিআরটিসির শাটল বাসের কুড়িল বিশ্বরোড কাউন্টারে পৌঁছে তো চক্ষু চড়কগাছ! সেখানে বাস ঘিরে মেলা কেন্দ্রিক শত-শত ক্রেতা-দর্শনার্থীর ভিড়; কার আগে কে উঠবে সেই চেষ্টায় ব্যস্ত সবাই।
টিকেট কাটা আর বাস ধরার ধকল পেরিয়ে পূর্বাচলে ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলায় পৌঁছে সেখানেও দেখা গেল একই চিত্রে। শুক্রবার ছুটির দিনে মেলায় ভিড় জমিয়েছিলেন হাজারো মানুষ।
সরকার পরিবর্তনের হলেও এবার ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলার ২৯তম আসর শুরু হয়েছিল আগের রীতি মেনে; জানুয়ারির প্রথম দিন থেকে। মাসব্যাপী এই মেলার পর্দা নামবে ৩১ জানুয়ারি।
শেষ সময়ে এসে মেলা জমে উঠেছে পুরোপুরি। মেলা প্রাঙ্গণ জুড়ে যেন নেমেছে উৎসবের আমেজ।
নানা বয়সী মানুষের ভিড়ে পুরো এলাকা মুখরিত। কেউ ছবি তুলছেন, কেউ আবার ব্যস্ত গৃহস্থালির পণ্য কেনায়। কারো আগ্রহ আইসক্রিমের দোকানে তো কারও ইলেক্ট্রনিক্স পণ্যের স্টলে।
সাড়া ফেলেছে ওয়ালটনের ডিসপ্লে ফ্রিজ
মেলায় ইলেকট্রনিক্স ব্র্যান্ড ওয়ালটনের ৩২ ইঞ্চি অ্যান্ড্রয়েড ডিসপ্লের ডবল ডোর ফ্রিজ বেশ সাড়া ফেলেছে। ফ্রিজটি ঘিরে ক্রেতাদের বেশ ভিড়ও লক্ষ্য করা গেছে।
রাজধানীর বাড্ডা থেকে আসা রাশেদ হাসান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এইরকম ফ্রিজ আজই প্রথম দেখলাম। ফ্রিজের দরজাটা মিরর হিসেবে যেমন কাজ করবে, তেমনি ইউটিউব ব্যবহার করে গান চালানো বা গুগল ব্যবহার করে কোনো কিছু ব্রাউজও করা যাবে।”
ওয়ালটনের কাস্টমার সার্ভিসের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা স্বপন আলী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বললেন, “এই স্মার্ট ফ্রিজে একটি ডিসপ্লে দেওয়া হয়েছে, যেখানে অ্যান্ড্রোয়েড-১৩ ভার্সন ব্যবহার করা হয়েছে। এখানে সাত থেকে আটটি মোড দেওয়া আছে। ফোন দিয়েও ফ্রিজটা কন্ট্রোল করা যাবে।
“ফোনের সব ফিচারই আপনি এখানে ব্যবহার করতে পারবেন, কল দেওয়া ছাড়া। ডোর অ্যালার্ম, বিল্ট ইন ইনভারটারসহ আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে এখানে।”
ভিড় গৃহস্থালির পণ্যের দোকানেও
বাণিজ্য মেলায় হরেক রকমের পণ্যের দোকানের মধ্যে গৃহস্থালির পণ্যের দোকানগুলোতে কম-বেশি ভিড় দেখা গেছে। মেলা উপলক্ষে দোকানগুলোতেও দেওয়া হয়েছে নানা রকম ‘অফার’, যা ক্রেতাদের বেশি আকৃষ্ট করে।
মেলায় ‘আল্লাহর দান ক্রোকারিজ কর্নার’-এ যে কোনো গৃহস্থালি পণ্য মিলছিল ১৩০ টাকায়। সেখানে টিফিন বক্স কিনছিলেন মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা গৃহিনী সাদিয়া সুলতানা।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “মেলায় কিছু-কিছু জিনিস অফারে পাওয়া যায়। যেমন এখানে ১৩০ টাকায় নানা ধরনের পণ্য পাওয়া যাচ্ছে। সেজন্যই আসা। এমনিতে তো বাজার থেকেই কেনা যায়। আরেকটা জিনিস হল, এখানে একই ধরনের অনেকগুলো দোকান থাকে। ফলে, ঘুরে-ফিরে পছন্দ করে কেনা যায়।”
জামা-জুতার আর খাবারের দোকানেও ব্যস্ততা
বাণিজ্যমেলায় জামা-জুতা আর খাবারের দোকানও ক্রেতা দর্শনার্থীদের আগ্রহের কেন্দ্রে। মেলায় ‘আয়াত’ নামে একটি দোকান থেকে আচার কিনে বাচ্চাকে খাওয়াচ্ছিলেন বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে আসা ফারিয়া রেশমি নামের একজন।
বেসরকারি এই চাকরিজীবী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “রসুনের আচার নিলাম। এটা আমার প্রিয়। জামা নিলাম নিজের জন্য। বাচ্চাকে জুতা কিনে দিয়েছি। সব মিলিয়ে ভালো একটা সময় কাটল। একটা উৎসব-উৎসব ব্যাপার আছে এখানে।”
পাশেই দোকানে জুতা দেখছিলেন ধানমণ্ডি-২৭ থেকে আসা মীর হেলাল নামের একজন। বেসরকারি এই চাকুরে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বউ-বাচ্চা নিয়ে এসেছি ছুটির দিনে। আসলে আমাদের তো আনন্দের উপলক্ষ কমে যাচ্ছে দিনকে দিন। তার মধ্যে এই মেলায় এসে একটু আনন্দ হল, এইত।”
‘ফেবার কাসল’ নামে একটি আঁকাআঁকি পণ্যের স্টল থেকে নিজের ছেলেকে আঁকার পেন্সিল কিনে দিচ্ছিলেন মগবাজারের জাহিদুল ইসলাম। তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বাচ্চাটা আঁকাআঁকি করতে ভালোবাসে। তাই কিনে দিলাম। রঙ পেন্সিল আর রেগুলার লেখার পেন্সিলও কিনলাম।”
ধুলাবালি আর ভিড়ভাট্টায় কারও-কারও মন খারাপ
মেলার যে ভেন্যু- পূর্বাচলের বাংলাদেশ-চায়না ফ্রেন্ডশিপ এক্সিবিশন সেন্টার, সেখানকার সড়কের অবস্থা তথৈবচ। ফলে পুরো এলাকা জুড়ে ধুলাবালির রাজত্ব। আর প্রচুর লোক সমাগমের কারণে সরু বাঁশের বেড়া দিয়ে ঢুকতেও বেগ পেতে হয়েছে।
বাড্ডার আলতাফ হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বললেন, “মেলার পুরো এলাকাজুড়ে ধুলাবালি। এসেই হাঁচি আর কাশি দেওয়ার মধ্যে আছি। এখানে মেলা কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে যদি পানি ছিটানো যেত, ভালো হত।”
সরকারি চাকরিজীবী আহসানুল ইসলামের আপত্তি মেলার প্রবেশমুখের বাঁশের বেড়া নিয়ে। তিনি বলেন, “এই বেড়া দেওয়ার দরকার ছিল না। এতে অনেক মানুষ একসঙ্গে ঢুকতে বেগ পেতে হচ্ছে। টিকেট যাচাইয়ের পর মানুষ যাতে নির্বিঘ্নে প্রবেশ করতে পারে, সে ব্যবস্থা রাখা দরকার ছিল।”
আরো যত আয়োজন
এবারের মেলায় সোর্সিং কর্নারে বাংলাদেশ চা বোর্ডের উদ্যোগে ছয়টি চা রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান অংশ নিয়েছে। এগুলো হল- মেঘনা, কাজী অ্যান্ড কাজী, ইস্পাহানি, আবুল খায়ের, ফিনলে ও সিটি।
সোর্সিং কর্নারে দেশের তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের দুই সংগঠন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ এবং লেদারগুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (এফএফএমইএবি) তিনটি প্যাভিলিয়ন দিয়েছে। এসব প্যাভিলিয়নে বিভিন্ন ধরনের তৈরি পোশাক, চামড়ার জুতা, ব্যাগ, বেল্ট ইত্যাদি পণ্য প্রদর্শন করা হচ্ছে।
এছাড়া কারাগারের বন্দিদের উৎপাদিত পণ্য নিয়ে স্টল বসিয়েছে কারা অধিদপ্তর। সেখানে কারারক্ষীদের তৈরি মোড়া, টুল, দোলনা, চেয়ার, লুঙ্গি, জামদানি, নকশিকাঁথা, শোপিসসহ নানা ধরনের পণ্য পাওয়া যাচ্ছে।
গেলবারের ধারাবাহিকতায় মেলায় আসা-যাওয়ার জন্য বিআরটিসির ডেডিকেটেড বাস সার্ভিসের পাশাপাশি বিশেষ ছাড়ে উবার সার্ভিসও চালু রয়েছে। মেলায় করা হয়েছে উবারের পিক আপ জোন।
এছাড়া প্রথমবারের মত মেলায় অনলাইন টিকেটিং সিস্টেম চালু করা হয়েছে। যার মাধ্যমে ফোনেই স্ক্যান করে টিকেট কেটে প্রবেশ করা যাচ্ছে। কাউন্টারে লাইনে দাঁড়ানোর লাগছে না।
যেভাবে যাতায়াত করবেন
দেশীয় পণ্যের প্রচার, প্রসার, বিপণন ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে ১৯৯৫ সাল থেকে ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলার আয়োজন করছে বাংলাদেশ। এরপর ২০২২ সালে মেলার ভেন্যু রাজধানীর আগারগাঁও থেকে নিয়ে যাওয়া হয় পূর্বাচলে। এ বছর বসেছে এই মেলার ২৯তম আসর।
শহরের বাইরে হলেও যাতায়াতে তেমন বেগ পেতে হবে না। দর্শনার্থীদের যাতায়াতের সুবিধার্থে রাজধানীর কুড়িল বিশ্বরোড, ফার্মগেইট (খেজুর বাগান/খামার বাড়ি), নারায়ণগঞ্জ ও নরসিংদী থেকে প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে বাণিজ্য মেলার উদ্দেশ্যে বিআরটিসির ২০০টির বেশি ডেডিকেটেড শাটল বাস চলে এবং মেলা প্রাঙ্গণ থেকে শেষ বাসটি ছাড়ে রাত ১১টায়।
ফার্মগেইট (খেজুর বাগান/খামার বাড়ি) থেকে মেলা প্রাঙ্গণের ভাড়া ৭০ টাকা; কুড়িল বিশ্বরোড থেকে মেলা প্রাঙ্গণের ভাড়া ৩৫ টাকা; নারায়ণগঞ্জ-মেলা প্রাঙ্গণ ভাড়া ১২০ টাকা; নরসিংদী-মেলা প্রাঙ্গণ ভাড়া ৯০ টাকা; মেলা প্রাঙ্গণ থেকে গুলিস্তান ভাড়া ৮০ টাকা এবং গুলিস্থান থেকে নারায়ণগঞ্জ ভাড়া ৪৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবারের মেলার যৌথ আয়োজক। এবারের মেলার বর্ষপণ্য ফার্নিচার।
দেশে পণ্য প্রদর্শনীর সবচেয়ে বড় এ মেলায় এবার ৩৬২টি স্টল ও প্যাভিলিয়ন রয়েছে। এর মধ্যে ৩৫১টিই দেশীয় প্রতিষ্ঠানের স্টল-প্যাভিলিয়ন। আর বাকি ১১টি স্টল সাতটি দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের।
মেলায় অংশ নেওয়া সাতটি দেশ হল- ভারত, পাকিস্তান, তুরস্ক, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া, হংকং ও মালয়েশিয়া।
মেলায় দেশীয় বস্ত্র, মেশিনারিজ, কার্পেট, কসমেটিক্স অ্যান্ড বিউটি এইড, ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেক্ট্রনিক্সস, ফার্নিচার, পাট ও পাটজাত পণ্য, গৃহ সামগ্রী, চামড়া ও আর্টিফিসিয়াল চামড়া ও জুতাসহ চামড়াজাত পণ্য, স্পোর্টস গুডস, স্যানিটারিওয়্যার, খেলনা, স্টেশনারি, ক্রোকারিজ, প্লাস্টিক, মেলামাইন পলিমার, হারবাল, টয়লেট্রিজ, ইমিটেশন জুয়েলারি, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, ফাস্টফুড, হস্তশিল্পজাত পণ্য, হোম ডেকর বিক্রির জন্য রাখা হয়েছে।
মাসব্যাপী এ মেলা প্রতিদিন সকাল ১০টায় শুরু হয়ে চলে রাত ৯টা পর্যন্ত ; আর সাপ্তাহিক ছুটির দিনে মেলা চলে রাত ১০টা পর্যন্ত। ৩১ জানুয়ারি মেলার পর্দা নামবে।
এবারের মেলার প্রাপ্তবয়স্কদের প্রবেশ টিকিটের মূল্য জনপ্রতি ৫০ টাকা, এবং ১২ বছরের নিচের শিশুদের জন্য ২৫ টাকা।