একতা অপেরার যাত্রাশিল্পীদের সাথে কিছুক্ষণ

বোরহান বিশ্বাস
Published : 17 July 2020, 06:27 PM
Updated : 17 July 2020, 06:27 PM

খিলগাঁও তিলপাপাড়ার কালভার্ট রোডের পাশে যাত্রাদল একতা অপেরার অস্থায়ী কার্যালয়। দলের প্রধান আব্দুল আজিজ ফকির; যিনি আজিজ নামেই পরিচিত বেশি।  বাসা-বাড়ির পানির লাইন কিংবা গ্যাস লাইনের কাজ করাতে মালিকরা প্রায়ই তার খোঁজ করে থাকেন।

সেদিন ছিল আষাঢ়ের বৃষ্টিহীন আকাশ আর ভ্যাপসা গরম। গাছের ছায়ায় সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে কথা হল একতা অপেরার সদস্যদের সাথে। জানলাম তাদের জীবনের গল্প।

ততক্ষণে কাজে সামান্য বিরতি দিয়ে আব্দুল আজিজ উপস্থিত হয়েছেন। আরও দুজনের আসার কথা। এই ফাঁকে কথা চলছিল আজিজের সঙ্গে।

যাত্রায় আসা হল কীভাবে?

ময়মনসিংহের নান্দাইলে জন্ম নেওয়া আজিজ বলেন,  "খুব অল্প বয়সে গ্রামের হাটবাজারে, স্কুলে যাত্রাপালা দেখে আকৃষ্ট হয়েছিলাম। প্রবল আগ্রহ থেকে এক সময় বিভিন্ন দলের সঙ্গে যোগাযোগ করি।

"শেষে নবরঞ্জন অপেরায় সুযোগ হল। বেশ কয়েক বছর সেখানে কাজ করলাম। জীবিকার তাগিদে ২০০০ সালে ঢাকায় চলে আসি। এখানে এসে একতা অপেরা নামে একটি যাত্রার দল করি। ২০০২ সালে শিল্পকলায় দলের নিবন্ধন করি।"

এরমধ্যে আলোচনায় যোগ দিয়েছেন দলের অন্য দুই সদস্য; নূরুল ইসলাম (বন্ধু) ও আব্দুল কাদির।

যাত্রাপালার প্রধান প্রতিবন্ধক 'অশ্লীল নৃত্য' নিয়ে কথা উঠতেই আজিজ বললেন, "অশ্লীল নৃত্যের কাছে আজ যাত্রাপালা, লোকনাট্য অসহায়। মাঠ মালিকদের একটা ইঙ্গিতপূর্ণ দাবি থাকে আমাদের কাছে। সেটা মেটাতে না পারার পাশাপাশি যাত্রাশিল্পের সার্বিক অবনতিশীল পরিস্থিতির জন্য এখন তেমন একটা ডাক পাই না।"

কারা এই মাঠ মালিক?

দলের অন্যতম অভিনেতা আব্দুল কাদির বলেন,  "দুটো মালিক পক্ষ আছে। একটি দল মালিক, অন্যটি মাঠ মালিক। দলের মালিক মানে দলের প্রধান। আর মাঠ মালিক হচ্ছে, যাদের সঙ্গে যাত্রা করার চুক্তি হয়। তারাই আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন যাত্রাপালার জন্য।

"আয়োজকদের কেউ কেউ অতি উৎসাহী হয়ে নিজেরাই অশ্লীল নৃত্যশিল্পী জোগাড় করে আনেন। অনুষ্ঠানের নাম দেন ভ্যারাইটি শো। এমন অনেকবার হয়েছে যে, যাত্রার আগে অশ্লীল নৃত্য পরিবেশন করায় আমরা সেদিন আর মঞ্চেই উঠতে পারিনি। মন খারাপ করে চলে এসেছি।"

কাদিরের কথার রেশ ধরে দলপ্রধান আজিজ জোর দিয়েই বললেন, "যাত্রার প্রয়োজনে আমরা যে গান করি সেটা ক্লাসিক্যাল গান, লোকগান। এটাতে সমাজের কোনো ক্ষতি হয় না।

"অন্যদিকে অশ্লীল নৃত্যের সঙ্গে কুরুচিপূর্ণ রেকর্ড করা গান ছেড়ে দেওয়া হয়। এটা সমাজের জন্য ক্ষতি, যাত্রাশিল্পের জন্য ক্ষতি। মাঝে মাঝে ভাবি, যাত্রার জন্য আমাদের সময়, শ্রম ও টাকা সবই বুঝি নষ্ট হল।"

৪০ বছর ধরে যাত্রাপালার সঙ্গে জড়িত আছেন নূরুল ইসলাম। তিনিও যোগ দিয়েছেন আমাদের আলোচনায়।

যাত্রা পরিচালনার গুরু দায়িত্ব পালনকারী নূরুল ইসলাম বলেন,  "৮০'র দশকেও যখন গ্রাম-গঞ্জে যাত্রা করতে যেতাম অনেক সম্মান পেতাম। ধীরে ধীরে সেই জায়গা নষ্ট হয়ে এখন অনেকেই আমাদের ঠাট্টা-তাচ্ছিল্যের চোখে দেখেন।

"এটা একজন শিল্পী হিসেবে অনেক কষ্টের। সারা দেশে সাত-আট লাখের মতো যাত্রাশিল্পী নিদারুণ কষ্টের মধ্যে আছে। যাত্রাপালা তো হয়ই না, সেই সঙ্গে অর্থ কষ্টও সবার ঘরে ঘরে। শিল্পীদের মধ্যে কেউ রিকশা, ভ্যান, কেউ তরকারি বিক্রি করে জীবন চালাচ্ছেন।"

তিনি বলেন, "সুদিনে প্রেসক্লাবেও যাত্রা করেছি। গ্রাম থেকে গ্রামে ঘুরে বেড়িয়েছি। যাত্রাপালা আর অশ্লীল গান এখন মিলেমিশে একাকার। অথচ দুটো সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়।"

এই পেশা জীবনে কোনো মজার অভিজ্ঞতা হয়েছে?

শুরু করলেন দলপ্রধান আব্দুল আজিজ।

"সিলেটের সাতছড়ি চা বাগানে একবার যাত্রা করেছিলাম। তিনটি যাত্রা করতে হয়েছিল তখন। সাগর বাদশা, আলোমতি প্রেমকুমার ও জীবন নদীর তীরে। সাগর বাদশায় ভিলেন বাবুর চরিত্রে অভিনয় করেছিলাম। পরের দিন বাগান ম্যানেজার (কেউ কেউ তাকে টিলাবাবু নামেও ডাকে)  আমাকে তার বাংলোয় ডেকে পাঠান। কেউ একজন আমাদের রুমের সামনে এসে বলছিলেন, ভিলেন বাবু আছেন নাকি? ওই নাম ধরে যে আমাকেই খোঁজ করা হচ্ছিল সেটি বুঝতে পেরে সবাই বেশ মজা পেয়েছিল।"

স্মুতি থেকে আরো একটি ঘটনা তুলে  এনে আজিজ বলেন, "কয়েক বছর আগে ঢাকার মেরুল বাড্ডায় যাত্রা মাঠে 'একটি পয়সা'য় চোরাকারবারির চরিত্রে অভিনয় করেছিলাম। যাত্রা শুরুর আগে মেকাপ নিয়ে বসেছিলাম। গোঁফ-দাড়ি থাকায় কিছু লোক এসে আমাকে ফিল্মের নাসির খান বলে সম্বোধন করতে লাগলেন।

"যাত্রা শেষে সেখানে উপস্থিত দু'জন পুলিশ আবেগে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। কোথায় থাকি, কী পেশা জিজ্ঞেস করলেন। ওই ঘটনায় আমিও আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছিলাম।"

আব্দুল কাদির বলেন, গত বছর তারা কালি পূজায় সিলেটে চা বাগানে যাত্রা পরিবেশন করেছিলেন। দুইশটি যাত্রার দল সেখানে অংশ নেয়। এতে ঢাকার দল 'একতা অপেরা' অর্থাৎ তাদের দল প্রথমস্থান অধিকার করে।

সিলেটের জেলা প্রশাসক স্বয়ং তাদের এ খবর জানান। স্থানীয় পত্রিকাগুলোতেও এ সংক্রান্ত খবর প্রকাশিত হয়। এমন ঘটনা গৌরবের বলে মনে করেন কাদির।

যাত্রার পাণ্ডুলিপি নিয়ে আজিজ বলেন, "আমরা সাধারণত স্ক্রিপ্ট জোগাড় করে কাজ করি। এর মধ্যে কবি জসীম উদদীন, সৈয়দ শামসুল হক, কলকাতার হীরন্দ্র কৃষ্ণ দাস, নরসিংদীর জালাল সাহেবের লেখাগুলো নিয়ে বেশি কাজ করেছি।"

একতা অপেরা এ পর্যন্ত শিল্পকলায় সরকারি পর্যায়ে বেশকিছু যাত্রাপালা করেছে। বিটিভিতে এই দলের সদস্যরা কাজ করছেন ৮ বছর ধরে। সর্বশেষ লকডাউনের আগে বিটিভিতে একটি যাত্রাপালা করেছিলেন তারা।

যাত্রাশিল্পীদের একজন হিসেবে নূরুল ইসলাম সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের কাছে বাংলার চিরায়ত এই লোক ঐতিহ্যের প্রতি দৃষ্টি দেওয়ার বিশেষ অনুরোধ জানিয়ে বলেন, "আমরা আবার মাঠে-ঘাটে যাত্রাপালা করতে চাই। লাখ লাখ যাত্রাশিল্পী এখন সরকারের দিকে চেয়ে আছে। তারা যেন আমাদের দিকে একটু সহানুভূতির দৃষ্টিতে তাকান।"

আলোচনার শেষে দিকে নুরুল ইসলামের মোবাইলে একটি ফোন এলো। এ পাশ থেকে সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বললেন তিনি। ধরে নিয়েছিলাম তিনি হয়তো ওই এলাকারই মানুষ। পরে জানতে পারি তার গ্রামের বাড়ি কুমিল্লায়। যাত্রা দলের সঙ্গে থেকে বিভিন্ন অঞ্চলের ভাষা রপ্ত করে নিয়েছেন নূরুল।

এদিকে ডাক পড়লো আব্দুল আজিজেরও। যাত্রারদলের ভাবনা এক পাশে সরিয়ে রেখে দ্রুত ছুটলেন তিনি বেঁচে থাকার প্রয়োজনে করা কাজের উদ্দেশে।

ছবি: আব্দুল আজিজ ফকিরের কাছ থেকে সংগ্রহিত