যাত্রাপালা - যে লোকজ বিনোদন ধারণ করে ঐতিহ্যকে

‘না না না আজ রাতে আর যাত্রা শুনতে যাবো না’- মান্নাদের কণ্ঠে বিখ্যাত গান| কিন্তু যাত্রার আকর্ষণ এমনি যে না গিয়েও পারা যাবে না। বাংলার জনজীবনের এমনই এক অবিচ্ছেদ্য বিনোদন ছিল যাত্রা।

শান্তা মারিয়াবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 April 2016, 09:16 AM
Updated : 14 April 2016, 10:09 AM

রাতের পর রাত জেগে বাংলার সাধারণ মানুষ কৃষক, তাঁতী, কামার ,কুমার, জেলে দেখেছে যাত্রায় কাহিনি আর মেতেছে পালা গানের সুরে। কখনো ভক্তি, কখনো ভালোবাসা, কখনো দেশপ্রেম তাকে কাঁদিয়েছে, হাসিয়েছে। আবার সামন্ত রাজা, জমিদার ও অভিজাত শ্রেণির মানুষও যাত্রা দেখেছে। জমিদারবাবু তো আর সাধারণ প্রজার সঙ্গে যাত্রার আসরে গিয়ে বসবেন না। বরং তার প্রাসাদের নাটমণ্ডপেই বসবে যাত্রার আসর। জমিদারবাড়িতে থাকতো বিশাল নাটমণ্ডপ। সেখানেই যাত্রা, পালাগান, কীর্তনের আসর বসতো। চিক বা পর্দাঘেরা বারান্দায় বসতেন জমিদার গৃহিনী, রানীমা, পরিবারের নারী সদস্যরা। তারা চিকের আড়াল থেকেই দেখতেন যাত্রা পালা।

যাত্রাপালার ঐতিহ্য অত্যন্ত প্রাচীন। অষ্টম ও নবম শতকেও এদেশে পালাগান ও পালার অভিনয় প্রচলিত ছিল। শ্রী চৈতন্যদেবের আবির্ভাবের আগেও রাঢ়, বঙ্গ, সমতট, গৌড়, পুণ্ড্র, চন্দ্রদ্বীপ, হরিকেল, শ্রীহট্টসহ সমগ্র ভূখণ্ডে পালাগান ও কাহিনিকাব্যের অভিনয় প্রচলিত ছিল। ধর্মীয় বা কোনো উৎসবে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাওয়ার যে রীতি সেখান থেকেই যাত্রা শব্দটি এসেছে। এদেশে শিবের গাজন, রামযাত্রা,কেষ্টযাত্রা, সীতার বারোমাসী, রাধার বারোমাসী প্রচলিত ছিল। সেসময় বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনি অভিনয় করে দেখানো হতো। সেখান থেকেই যাত্রার উৎপত্তি। নবদ্বীপে শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাবের পর কৃষ্ণযাত্রা ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। কৃষ্ণযাত্রায় মূলত রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলা, কৃষ্ণের বাল্যকাল, মা যশোদার সঙ্গে কৃষ্ণর বাল্যক্রীড়া, কৃষ্ণের কংসবধ, মথুরা জয় ইত্যাদি কাহিনি অভিনয় ও গানের মাধ্যমে দর্শকদের পরিবেশন করা হতো। দর্শকরা তা দেখে ভক্তিরসে সিক্ত হতেন। রুক্মিণী হরণ নামে একটি কৃষ্ণযাত্রায় চৈতন্যদেব নিজেই অভিনয় করতেন। তিনি রুক্মিণী সাজতেন।

অষ্টাদশ শতকে(১৭০০ সাল) যাত্রা বাংলা ভূখণ্ডের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। সে সময় শিশুরাম, পরমানন্দ অধিকারী, সুবল দাস ছিলেন যাত্রার জগতে প্রসিদ্ধ।

উনবিংশ শতকে পৌরাণিক কাহিনিভিত্তিক যাত্রা খুব জনপ্রিয়তা পায়। মতিলাল রায় ও নীলকণ্ঠ মুখোপাধ্যায়ের যাত্রাদল প্রসিদ্ধি পায়। সে সময় কৃষ্ণলীলা এবং রামায়ণ-মহাভারতের পৌরাণিক কাহিনির পাশাপাশি বিদ্যাসুন্দর, লাইলি মজনু, ইউসুফ জোলেখা, বেহুলা লখিন্দর, মা মনসা, লক্ষ্মীর মহিমা, কমলাবতী রানী, ইত্যাদি প্রেমকাহিনি ও লোকজ কাহিনির অভিনয়ও প্রচলিত ছিল।

উনবিংশ শতকের শেষে এবং বিশশতকের শুরুর দিকে যাত্রায় দেশপ্রেমমূলক কাহিনির অভিনয় শুরু হয়। এক্ষেত্রে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ মুকুন্দ দাশ। তার প্রকৃত নাম ছিল যজ্ঞেশ্বর। তিনি বিক্রমপুর থেকে বরিশাল গিয়ে দেশপ্রেমিক বিপ্লবী অশ্বিনী কুমারের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। মুকুন্দ দাশ যাত্রার মাধ্যমে দেশপ্রেম ও ব্রিটিশবিরোধী বক্তব্য প্রচার করেন। তিনি সমাজ সংস্কার মূলক বক্তব্য, পণপ্রথা, জাতিভেদে ইত্যাদির বিপক্ষেও বক্তব্য প্রচার কররেন। তিনি ‘স্বদেশী যাত্রা’র সূচনা করেন। সে কারণে তাকে কারাবন্দিও থাকতে হয়। মুকুন্দ দাশের প্রেরণায় আরও অনেক স্বদেশী যাত্রার দল গড়ে ওঠে। তারা গ্রামে গ্রামে যাত্রার প্রদর্শন করে দেশপ্রেমমূলক কাহিনি প্রচার করতে থাকে। সে সময় ঈশা খাঁ, প্রতাপচন্দ্র, বারো ভুঁইয়া, সোনাভান, নবাব সিরাজউদ্দৌলা, ক্ষুদিরাম ও অন্যান্য বিপ্লবীর নামেও কাহিনি অভিনয় হতে থাকে। স্বদেশী যাত্রা একসময় ইংরেজ শাসকদের রোষানলে পড়ে।

মুকুন্দ দাসের আগে ঢাকায় কৃষ্ণকমল গোস্বামী নামে একজন পালাকার ‘স্বপ্নবিলাস’, ‘দিব্যোন্মাদ’, ‘বিচিত্রবিলাস’ পালা লিখে আলোড়ন তুলেছিলেন। ১৮৬০-১৮৭৮ এর মধ্যে তার পালা গ্রন্থাকারে প্রকাশ পায় এবং ঢাকাতেই প্রথম মঞ্চায়ন হয়। মনোমহন বসু নামেও আরেকজন পালাকার বেশ বিখ্যাত ছিলেন। নওগাঁজেলার ধামুরহাট থানার শ্রামপুর গ্রামে নফরউদ্দিন নামে আরেকজন পালাকার প্রথমে রাজনীতিকেন্দ্রিক পালা লিখে বেশ খ্যাতি পান। পরে তিনি মধুমালা, সাগরভাসা, কাঞ্চনবতী, বিন্দুমতি, পুষ্পমালা ইত্যাদি রূপকাথাভিত্তিক পালা লেখেন। বিখ্যাত সাহিত্যিক মীরমোশাররফ হোসেনও পালা লিখেছেন। তিনি বেহুলা নিয়ে যাত্রাপালা লেখেন।

সে সময় গ্রামে গঞ্জে বিষাদসিন্ধুর কাহিনি নিয়েও যাত্রা অভিনয় হতো। কারবালার কাহিনি নিয়ে যাত্রা পালা লেখা হতো।মানিকগঞ্জের ধানেশ্বরের আব্দুল করিম, নরসিংদির জালাল উদ্দিন, হিরেন্দ্র কৃষ্ণদাস, মুন্সিগঞ্জের আরশাদ আলী , ঢাকার কেরাণীগঞ্জের রফিকুল,পটুয়াখালির দুধল গ্রামের মাস্টার সেকেন্দার আলি, খুলনার ডুমুরিয়ার এম এ মজিদ (অগ্রদূত), ময়মনসিংহ জেলার নান্দাইলের কফিল উদ্দিন ও মানিকগঞ্জ সদরের ডা. আবেদ আলীসহ অনেকেই সেসময় যাত্রা পালা লিখতেন।

বিশ শতকে রূপবান-রহিম বাদশাহ, মালকা বানু, সয়ফুল মুলুক বদিউজ্জামাল, গুনাইবিবি, দুর্গামনি, কমলা রানীর বনবাস, কাজল রেখা, মলুয়া, ভেলুয়া সুন্দরী, সোনাভান, বীরাঙ্গনা সখিনা, গাজী কালু চম্পাবতী, বনবিবি ইত্যাদি পালা বেশ জনপ্রিয়তা পায়।

১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর অনেক পালাকার ও যাত্রাদল পূর্ববঙ্গ ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গে চলে যায়। পাকিস্তানি শাসকরা এদেশের লোকজ সংস্কৃতিকে কখনও সুনজরে দেখেনি।যাত্রাপালা ধর্মবিরোধী কাজ এমন ফতোয়াও জারি হয়েছে কখনও কখনও। অনেক গ্রামে ধর্মান্ধ গোষ্ঠি একত্রিত হয়ে অভিনয় বন্ধ করে দিয়েছে।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পর দেশ স্বাধীন হলে অনেক যাত্রাদল নতুনভাবে গড়ে ওঠে। মাইকেল মধুসূদন, দেবদাস, রক্তাক্ত বাংলা, স্বাধীন বাংলা, বিজয় এনেছি, মা মাটি মানুষ, সোনার বাংলা, সোজন বাদিয়ার ঘাট, লালন ফকির, ইত্যাদি পালা বেশ জনপ্রিয়তা পায়। অমলেন্দু বিশাস, জ্যোস্না বিশ্বাসসহ অনেক যাত্রাশিল্পী ছিলেন নামকরা। সত্তর দশকের শেষভাগ এবং বিশেষ করে আশির দশকে যাত্রাশিল্পে অবক্ষয় শুরু হয়। তখন যাত্রার নামে অশ্লীল নৃত্য পরিবেশিত হতে থাকে। আবহমান কাল ধরে চলে আসা এই শিল্প ধ্বংসের মুখোমুখি হয় যাত্রার আসরে জুয়া ও অশালীন নাচের কারণে। যাত্রার আসরে সখী নৃত্য একসময় প্রচলিত ছিল যা কিছুটা অসংস্কৃত হলেও তাকে ঠিক অশালীন বলা যেত না। কিন্তু পরবর্তীতে গ্রামগঞ্জে পর্নগ্রাফির প্রভাবে প্রিন্সেসের নাচের নামে যাত্রার আসরে অশালীনতা ছড়িয়ে পড়ে। পরে যাত্রার প্রিন্সেস, সখীনৃত্য ইত্যাদির নামে চলে অশালীন নৃত্য।

যাত্রাকে অশালীনতা থেকে মুক্ত করতে এবং যাত্রা শিল্পকে বাঁচাতে নতুন শতকে তৈরি হয় যাত্রা নীতিমালা। ২০১২ সালে যাত্রা নীতিমালা গেজেটভুক্ত হয়। ২০১৩ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ৮৮টি যাত্রাদলকে নিবন্ধন করেছে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি। এখনকার নামকরা যাত্রাদলগুলো হলো যশোরের আনন্দ অপেরা, চ্যালেঞ্জার অপেরা, অগ্রগামী নাট্টসংস্থা, মাগুরার চৈতালি অপেরা, নারায়ণগঞ্জের ভোলানাথ যাত্রা সম্প্রদায়, কোহিনূর অপেরা, গাজীপুরের দিশারী অপেরা,  ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তিতাস যাত্রা ইউনিট, খুলনার স্বদেশ অপেরা, রাজমহল অপেরা, রঙমহল অপেরা, ফরিদপুরের মধুচ্ছন্দা যাত্রা ইউনিট, নাটোরের পদ্মযাত্রা ইউনিট, বাগেরহাটের সুন্দরবন অপেরা, লক্ষ্মীপুরের কেয়া যাত্রা ইউনিট ইত্যাদি।

বাঙালির বিনোদনের একটি প্রধান অনুসঙ্গ ছির যাত্রা পালা।‌ এর মধ্য দিয়ে শুধু বিনোদন নয় পুরাণ, ইতিহাস, লোকজ সাহিত্য সম্পর্কে শিক্ষাগ্রহণ চলতো।এখন সিনেমা, টেলিভিশনের কল্যাণে বিনোদনের রূপ পালটেছে। কিন্তু যাত্রার আবেদন গ্রামের মানুষের কাছে এখনও রয়েছে। রাতের পর রাত জেগে যাত্রার কাহিনি, অভিনয়, গানের মাধ্যমে লোকজ নীতিবোধ, শুভ-অশুভের দ্বন্দ্ব সম্পর্কে শিক্ষা নেয় দর্শকরা। যাত্রা আমাদের লোকজ সংস্কৃতির মূল্যবান সম্পদ। যাত্রা শিল্পকে বাঁচাতে প্রয়োজন সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের অধিকতর পৃষ্ঠপোষকতা।