Published : 13 Aug 2015, 11:01 PM
.
গ্রীষ্মকালীন ছুটি শেষ হয়েছে। শিক্ষার্থীরা যথারীতি যেতে শুরু করেছে স্কুলে। সুকুমার পেলব কোমল পিঠগুলোর উপর আবার চেপে বসেছে বইয়ের বিরাট ভার। কিন্তু অনেক অভিভাবকের হয়তো ধারণাই নেই, এ ভার তাদের সন্তানের স্বাস্থ্যকে কতখানি ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে। এ ভার শিশুর মেরুদণ্ড ও দেহভঙ্গিমার জন্য গুরুতর ও স্থায়ী ক্ষতির কারণ হতে পারে। শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড—একথা অনস্বীকার্য, কিন্তু বইয়ের ভারে যদি শিক্ষার্থীর মেরুদণ্ড ভাঙতে বসে তবে তার চেয়ে দুঃখজনক আর কী হতে পারে?
এখনকার ছাত্র-ছাত্রীরা স্কুলে যায় পিঠে ব্যাকপ্যাক নিয়ে। ব্যাকপ্যাক বই-খাতা, পানির বোতল, কলম-পেন্সিল বহন করার ক্ষেত্রে সুবিধাজনক বটে। কিন্তু বোঝার ভার এতো বেশী যে তা শিশুর জন্য মোটেই স্বাস্থ্যসম্মত নয়। পশ্চিমে এ নিয়ে গবেষণা ও বিতর্ক অনেক আগেই শুরু হয়েছে। ভারতের মহারাষ্ট্র সরকার স্কুলব্যাগ সংক্রান্ত আইন করেছে। আমাদের দেশে হাইকোর্ট রুল জারী করেছে। কিন্তু বিষয়টি জনসাধারণের কাছে এখনও ভালভাবে পৌঁছেনি বলেই মনে হয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, কোনো ব্যাগের ওজন বহনকারী শিক্ষার্থীর ওজনের ১৫%-এর বেশী হওয়া একেবারেই অনুচিত; তবে অনেকে ১০%-এ সীমিত রাখার পরামর্শ দিয়েছেন। উল্লেখ্য, মহারাষ্ট্র সরকার ১০%-কেই সীমা করে আইন করেছে। আমাদের দেশে বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীকেই বাস্তবে তার ওজনের ২০ থেকে ২৫ শতাংশ ওজনের বই-খাতা ভরা ব্যাকপ্যাক বহন করতে হচ্ছে।
পশ্চিমা বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, প্রতিদিন এভাবে বইয়ের ভার বহন করার ফল ভাল নয়। এতে পিঠে ব্যথা, মেরুদণ্ডে গুরুতর ক্ষতি ও কাঁধের আকার বিনষ্ট হওয়ার সমূহ সম্ভাবন রয়েছে। পিঠ, কাঁধ ও ঘাড়ের হার ও মাংসপেশী—সবই হুমকির মধ্যে এবং সমস্যা দীর্ঘমেয়াদে অপ্রতিবিধেয় ও স্থায়ী হয়ে উঠতে পারে। চৌদ্দ বছরের মধ্যেই অর্ধেক শিশু পিঠের ব্যথায় আক্রান্ত হচ্ছে। স্কোলিওসিস'সহ মেরুদণ্ডের অস্বাভাবিক পরিবর্তনজনিত নানা রকমের স্বাস্থ্য-সমস্যার সংখ্যা বাড়ছে।
প্রখ্যাত শিশু ও নবজাতক বিশেষজ্ঞ ডক্টর জিনাল উনাদকাত'য়ের মতে, বইয়ের ভারী বোঝার কারণে শিশুদের স্কুলে যাওয়ার আগ্রহ কমে যেতে পারে। বইয়ের ভার তাদের মনের উপর বোঝা হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে, যার ফলশ্রুতিতে ক্লাসে তাদের মনোযোগ হ্রাস পেতে পারে।
ডক্টর জুবায়ের প্যাটেল ব্যাখ্যা করে বলেন, ভারী ব্যাকপ্যাক কাঁধে নিলে শিশুকে সামনের দিকে ঝুঁকতে হয়; ফলে দেহভঙ্গিমার ক্ষতি হয়। মেরুদণ্ড কোমল তরুণাস্থি (ভার্টিব্রাল ডিস্ক) দ্বারা পৃথগায়িত কতগুলো হারের বিন্যাস (ভার্টিব্রাল কলাম), যেগুলো আবার পেশী ও লিগমেন্ট দিয়ে ঘিরে আছে। অতিরিক্ত ভার এ মাস্ল, লিগামেন্ট ও ডিস্কের উপর অসমীচীন চাপ প্রয়োগ ক'রে এগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, ভার্টিব্রাল কলামের ঋজুতাকে বিনষ্ট করে।
ব্যাক-কেয়ার প্রতিষ্ঠানের শন ম্যাকডুগাল'য়ের মতে, এ অবস্থা স্বাস্থ্যের জন্য টাইমবোমার মতো, যা পরবর্তী জীবনে অসহনীয় যন্ত্রণার কারণ হয়। এতো অল্প বয়সেই যার পিঠে ব্যথা হয়, পরের ৭০/৮০ বছর ভয়াবহ শারীরিক-মানসিক সংকটে তাকে জীবন কাটাতে বাধ্য হতে হয়। শিশু-কিশোর বয়সে মেরুদণ্ড বর্ধনশীল অবস্থায় থাকে বলে পিঠে অতিরিক্ত ভার বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।
মার্কিন কনজ্যুমার প্রোডাক্ট সেফটি কমিশন-এর উল্লেখ মতে, কেবল ২০১৩ সালেই ৫৪১৫ জনকে ব্যাকপ্যাক সংশ্লিষ্ট আঘাতের জন্য ইমার্জেন্সি রুমে চিকিৎসা দিতে হয়েছে। ইনজ্যুরিগুলো ছিল একিউট ব্যাক পেইন থেকে ক্রনিক ব্যাক পেইন পর্যন্ত। এ অবস্থার আলোকে কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ ব্যাকপ্যাকের বিপদ সম্বন্ধে সতর্ক হবার কথা তোলেন। বোস্টোন বিশ্ববিদ্যালয়ের ওকুপেশনাল থেরাপি বিষয়ক ক্লিনিক্যাল প্রফেসর ও স্কুল এরগোনোমিক্স বিশেষজ্ঞ ক্যারেন জেকবস বলেন, ভুলভাবে বা অতিরিক্ত ওজনের ব্যাকপ্যাক কাঁধে নেয়া অস্বস্তি, অবসাদ, পেশীর ব্যথা এবং মেরুদণ্ডে—বিশেষ করে নিচের অংশে—ব্যথার ঝুঁকি তৈরি করে। তবে এ পরিসংখ্যানটি নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।
বিতর্ক সামান্য যা-ই থাকুক, ঝুঁকির বিষয়টিকে আমরা একেবারে উড়িয়েও দিতে পারি না। বিষয়টিকে গুরুত্বের সাথে নেয়া দরকার। শিক্ষা মন্ত্রণালয়, স্কুল কর্তৃপক্ষ এবং অভিভাবক—সকলকেই এ বিষয়ে এগিয়ে আসতে হবে। বই-খাতার ভার কমানোর উপায় খুঁজে বের করতে হবে। সকলকে সচেতন করে তুলতে হবে।
প্রাথমিক করণীয় সম্বন্ধে কয়েকটি কথা তুলে ধরা গেল সকলের বিবেচনার জন্য:
১। স্কুলব্যাগের মোট ওজন শিক্ষার্থীর ওজনের ১০%-এর মধ্যে সীমিত রাখা; তবে কোনো অবস্থায়ই তা যেন ১৫%-এর বেশী না হয় তা নিশ্চিত করা; এবং মনিটর করার জন্য স্কুলে ওজন মাপার যন্ত্র রাখা।
২। স্কুলব্যাগের নিরাপদ সর্বোচ্চ ওজন নির্ধারণে সরকার কর্তৃক গবেষণা করা এবং রেডিও-টিভি-পত্রিকার মাধ্যমে গণসচেতনতা বৃদ্ধিতে প্রচার কাজ করা।
৩। স্কুলে শিক্ষার্থীদের জন্য বই-খাতা রাখার ব্যবস্থা করা। যদি তা না করা যায় তবে ক্লাস-ওয়ার্কের জন্য একটি মাত্র খাতাই সকল বিষয়ের জন্য ব্যবহার করার ব্যবস্থা করা।
৪। সব অবস্থায়ই হোমওয়ার্কের জন্য লুজশীট ব্যবহার করা, যা ফেরত পাওয়ার পর ঘরে আলাদা আলাদা ফাইলে সংরক্ষণ করা।
৫। বড় আকারের বইগুলো একাধিক খণ্ডে প্রকাশ করা। সরকার একটি বইয়ের পৃষ্ঠার সর্বোচ্চ সংখ্যা ঠিক করে দিতে পারে।
৬। যেসব স্কুল খাতা সরবরাহ করে সেসব স্কুল কর্তৃক খাতার সাইজ ছোট রাখা।
৭। অপ্রয়োজনে ব্যাকপ্যাক কাঁধে না রাখা এবং কোথাও অপেক্ষা করার সময় তা নামিয়ে রাখা।
৮। ভবনের উপরের তলায় ব্যাকপ্যাক উঠানোর জন্য লিফট ব্যবহার করা।
৯। ব্যাকপ্যাক বহনে অভিভাবকরা সহায়তা করতে পারেন। তারা তা স্কুলের গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিতে পারেন।
১০। ব্যাকপ্যাক কাঁধে থাকা অবস্থায় দৌড়াদৌড়ি না করা।
১১। ব্যাকপ্যাক প্রস্তুতকারীদের জন্য এরগোনোমিক ব্যাকপ্যাক নীতিমালা ও নির্দেশনা প্রস্তুত করা এবং মান নিয়ন্ত্রণে বি.এস.টি.আই কর্তৃক উদ্যোগ নেয়া।
১২। শিক্ষার্থীদেরকে সচেতন করা যেন পিঠে বা কাঁধে সামান্য ব্যথা অনুভূত হলে সাথে-সাথেই অভিভাবককে অবহিত করে।
১৩। অভিভাবকের কর্তব্য হবে পিঠের ব্যথাকে গুরুত্বের সাথে নেয়া; ব্যাকপ্যাকের ওজন আরও হ্রাসের উপায় বের করা।
তথ্যসূত্র:
ভারী স্কুলব্যাগ বহনের কষ্ট আর নয়: কালের কণ্ঠ, ২৫ জুলাই ২০১৫
ভারী স্কুলব্যাগ ব্যবহার বন্ধে রুল জারি: এনটিভি অনলাইন, ১১ আগস্ট ২০১৫