Published : 20 Feb 2013, 12:34 AM
বায়ান্নর ফেব্রুয়ারীতে রুখে উঠেছিল বাঙ্গালী। প্রাণ দিয়ে রক্ষা করেছিল নিজের ভাষা, হাজার বছরের সমৃদ্ধ সংস্কৃতি। আজ প্রায় ছয় দশক পরে আবারো জেগে উঠেছে শকাব্দ প্রজন্মের (millennial generation) বাংলাদেশী তরুণ-তরুণী । শাহবাগের চেতনাদীপ্ত সংগ্রাম বাঙ্গালীর মনে আশার সঞ্চার করছে। স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদের আওয়াজ ক্ষমতার ভেতরে বাইরে সবাইকে সতর্ক করে দিচ্ছে- মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অবমাননা আর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে বঞ্চনা বিনাবাক্যে মেনে নেবে না জনতা। জনতার এই সংগ্রাম, যা সাম্প্রতিককালের বাংলাদেশে অভুতপূর্ব, বাংলাদেশের সমাজে শাসনব্যবস্থায় দীর্ঘমেয়াদি কি পরিবর্তন আনতে পারে তা বোঝার চেষ্টা করা জরুরী।
শাহবাগসহ সারাদেশের শহরে জনপদে সমবেত হওয়া লাখো জনতা ঠিক কোন পটভূমিতে, কি প্রক্রিয়ায়, কোন চেতনায় এত দ্রুত সংগঠিত হয়েছে? এই আন্দোলনের ফলাফল ও পরিণতি কি? এটি কি বার্তা বহন করে আগামী দিনের বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক অঙ্গনে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার চেষ্টায় কয়েক কিস্তির এই লেখার অবতারণা।
সংবাদভাষ্য অনুযায়ী ফেব্রুয়ারীর ৫ তারিখে একজন কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধীর বিচারের রায়ে দেয়া সাজার অপ্রতুলতায় জনমনে ক্ষোভের আগুন জ্বলে উঠে। একগুচ্ছ আধুনিক মুক্তমনা তরুণ বাংলা ব্লগারের তাৎক্ষণিক আহবানে ঢাকার শাহবাগ মোড়ে সমবেত হয় লোকজন। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় স্বতঃস্ফুর্ত মিছিল, মুঠোফোনে যোগাযোগ, ফেসবুকের স্ট্যাটাস আর ব্লগ পোস্টিং-এর মাধ্যমে এ ক্ষোভ দ্রুত ছড়িয়ে যায় শহরে। প্রজ্জলিত মোমবাতিসহ শাহবাগ চত্বরে সমবেত হয় রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক কর্মী নির্বিশেষে ছাত্র-ছাত্রী-জনতা । ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার কল্যাণে সমাবেশের খবর ছড়িয়ে গেলে লোক সমাগম আরো বাড়ে। যোগ দেয় বিভিন্ন পেশার নানান বয়সের লোকজন।
লক্ষ্য করার মত বিষয়টি হচ্ছে এত বড় একটি প্রতিবাদ সমাবেশ এত দ্রুত সংগঠিত হয় কোন জাতীয় রাজনৈতিক দলের আহবান কিংবা অন্য কোন ধরনের পূর্বপরিকল্পিত সাংগঠনিক আয়োজন ছাড়াই। যে ব্যাপারটি সবার চোখে পড়েছে তা হচ্ছে প্রতিবাদ সংগঠনে প্রযুক্তির সচেতন ব্যবহার। তথ্য প্রযুক্তির সাম্প্রতিক উন্নতি পারস্পরিক যোগাযোগকে সুলভ, সহজ এবং দ্রুততর করে দেয়ায় জনসংযোগের অভুতপূর্ব গণতন্ত্রায়ণ ঘটেছে। ব্যয়বহুল প্রচারণা কর্মসূচী, যেমন টেলিভিশন চ্যানেলে বিজ্ঞাপন কিংবা লিফলেট পোস্টার-ফেস্টুন ছাপানো, এসব ছাড়াই আজকাল যে কোন ব্যক্তি বা গ্রুপ অনায়াসে অতি স্বল্প ব্যয়ে অনেক লোকের কাছে একসাথে পৌঁছে দিতে পারে যে কোন ধরনের বার্তা। সাম্প্রতিককালে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় এধরনের প্রযুক্তি সহায়িত নির্দলীয় সামাজিক আন্দোলন তাৎক্ষণিক সাফল্যের মুখ দেখেছে। শাহবাগের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশেও এ ধরনের আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটল। নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হল, শাহবাগকে তাহরিরে পরিণত করার মত প্রযুক্তি এবং মেধা বাংলাদেশেরও আছে।
নূতন প্রযুক্তি এবং নূতন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার যে শিখা শাহবাগে পুনঃপ্রজ্জলিত করেছে সেই চেতনার পুননির্মাণে নব্বই-এর গণতান্ত্রিক আন্দোলনের বিজয়লব্ধ উন্মুক্ত গণমাধ্যমের একটি বড় ভূমিকা রয়েছে। গত তিন চার দশক ধরে বাংলাদেশে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির ক্রম পুনর্বাসন দেখা যাচ্ছিল। ১৯৯০ পরবর্তী দুই দশকের গণতান্ত্রিক জমানায় এসেই কেবল এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটতে থাকে। তবে সে পরিবর্তনে রাজনৈতিক দলগুলোর চেয়েও সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া অধিকতর ভূমিকা রেখেছে। ষাটের দশকের রবীন্দ্র চর্চা যেমন বাঙ্গালীর স্বাধীনতার চেতনাকে সমৃদ্ধ করেছিল ঠিক একইভাবে হারানো স্বাধীনতার চেতনাকে ফিরিয়ে আনে গত দশকজুড়ে গণমাধ্যমে অবাধ সংস্কৃতিচর্চা । স্বৈরশাসনের অবসানের সাথে সাথে গণমাধ্যমের উপর প্রত্যক্ষ রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ উঠে যাওয়ার দ্রুত বিকশিত হয় খবরের কাগজ আর পরবর্তীতে টিভি চ্যানেলগুলো। খবরের কাগজের সংখ্যা ও মান উভয়ই বেড়েছে গত দুই দশকে। যদিও এসব সংবাদপত্রগুলোর প্রায় সব কটিরই মালিকানা সুপ্রতিষ্ঠিত কিংবা উঠতি বাংলাদেশী ধনীদের হাতে, পত্রিকাগুলো জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলোর খবর বা বিশ্লেষণ করার সময় মালিক কিংবা সরকারের নিয়ন্ত্রণ থেকে মোটামুটিভাবে নিজেদের মুক্ত রাখতে পেরেছে। এছাড়া ইন্টারনেটের কারণে দেশ-বিদেশের সংবাদ মাধ্যম থেকে দ্রুত শিখেছে বাংলাদেশের সংবাদকর্মী, ভাষ্যকার আর বিশ্লেষকরা। জনপ্রিয় একটি খবরের কাগজের একটি যুক্তিপূর্ণ বিশ্লেষণ জনমত নির্মাণে রাজনৈতিক দলগুলোর মিছিল-সমাবেশ-প্রচারণার চেয়েও অনেক ফলপ্রসু। এ ব্যাপারটি বুঝতে পেরে সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলোও সংবাদপত্র প্রকাশে এগিয়ে আসে। তবে ঝকঝকে ছাপা আর লোক দেখানো বাংলাদেশী লোগোর আড়ালে তারা যে আসলে গুজব ছড়িয়ে আর কূটতর্কের অবতারণা করে স্বাধীন অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের চেতনাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চাইছে তা মনোযোগী পাঠক ঠিকই বুঝতে পারে। প্রিন্ট মিডিয়ার চেয়েও ভিস্যুয়াল মিডিয়ার আবেদন নিঃসন্দেহে অনেক বেশী। টিভি চ্যানেলগুলোতে জড়ো হওয়া প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক কর্মীদের প্রভাব আর বিদেশী চ্যানেলের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য কর্পোরেট মিডিয়ায় "বাংলাদেশ" ব্রান্ডের প্রয়োজনীয়তা, এদুই কারণে নুতন টিভি চ্যানেলগুলো্র অনুষ্ঠানমালায় বাঙ্গালী সংস্কৃতি আর বাংলাদেশী জাতীয়তার আধিক্য লক্ষ্যণীয়। রিয়েলিটি শোর তারকাদের লাল-সবুজ পোশাক পরে দেশাত্মবোধক গান করা কিংবা চারুকলার বকুলতলা থেকে ফাল্গুন উৎসবের সরাসরি সম্প্রচার সাংস্কৃতিক অসাম্প্রদায়িক চেতনার সঞ্চার করেছে বিশেষ করে নাগরিক মানসে (বেসরকারী টিভি চ্যানেলগুলো সহজে দেখা যায় কেবল নগর এলাকাগুলোতেই) । মজার ব্যাপার হচ্ছে, যেসব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চ্যানেলগুলোর আয়ের প্রধান উৎস হিসেবে কাজ করছে তাদের বিজ্ঞাপনে এমনকি পণ্যের নামকরণেও "বাংলাদেশ" নামক মার্কাটির বহুল ব্যবহার দেখা যাচ্ছে। যদিও এসব ব্যবসায়ীর মূল লক্ষ্য মুনাফা, তাদের এই "বাংলাদেশ" ব্রান্ডিং এর ধনাত্মক উপরি (Positive Externality) হিসেবে বাংলাদেশী নাগরিক সমৃদ্ধ হচ্ছে দেশপ্রেমে।
নব্বই পরবর্তী নির্বাচনী গণতন্ত্র উন্মুক্ত গণমাধ্যমের সহায়তায় আর বিকশিত ব্যক্তিখাতের স্বার্থে দেশপ্রেমের চেতনা ছড়িয়ে দিলেও দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির ক্রমাবনতি ঘটে গত দুই দশকে। ক্রমবর্ধমান আয়ের সাথে সঙ্গতি রেখে দেশের অবকাঠামোর চাহিদা মেটানো আর জননিরাপত্তা নিশ্চিত করার পরিবর্তে নবলব্ধ রাজনৈতিক ক্ষমতাকে নিজেদের আয় উন্নতি সাধনে ব্যবহারে ব্যস্ত হয়ে পড়ে বড় দলগুলোর অধিকাংশ নেতৃবৃন্দ। বড় দুদলের দেশ পরিচালনায় খুব একটা গুণগত পার্থক্য না দেখায় জনগণ প্রতিটি নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের বিপক্ষে ভোট দিয়ে তাদের অসন্তুষ্টির কথা জানায়। অপেক্ষাকৃতভাবে সৎ হিসেবে পরিচিত বাম প্রগতিশীল নেতৃবৃন্দ কোন বিকল্প গণতান্ত্রিক শক্তি গড়ে তুলতে পারলে জনগণ হয়ত তাদেরো বিবেচনা করত। বড় দুই রাজনৈতিক দলের মিউজিকাল চেয়ারের মাঝখানে কিঞ্চিৎ বিরতি নিয়ে আসে ২০০৬-এর সামরিক শাসন। সহিংস এবং দুর্নীতিপূর্ণ রাজনীতিকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়ে শুরুতে নাগরিক নেতৃশ্রেণীর ব্যাপক সমর্থন পেলেও সামরিক নেতৃত্ব, কিছুটা তাদের অভিজ্ঞতার অভাবে কিছুটা তাদের কাঠামোগত সীমাবদ্ধতার কারণে, শেষ পর্যন্ত রাজনীতিতে ব্যাপক কোন পরিবর্তন আনতে না পারলেও রাজনৈতিক সংস্কৃতির কিঞ্চিৎ উন্নতি সাধিত হয় বলে অনেকের বিশ্বাস (অন্তত এখন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের দুর্নীতির দায়ে পদাবনতি হচ্ছে)। তবে দুই বছরের নির্দলীয় এবং তুলনামূলকভাবে নিরাপদ পরিস্থিতিতেও রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কার কিংবা নূতন রাজনৈতিক শক্তির সৃষ্টি না হওয়ায় জনগণ বিদ্যমান রাজনৈতিক নেতৃত্বের আন্তরিকতা এবং দক্ষতা সম্পর্কে আরো সন্দিহান হয়ে পড়ে।
আওয়ামী লীগ মূলতঃ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিপুল ভোটে ক্ষমতায় আসে ২০০৮ সালে। বিচার শুরুতে দীর্ঘসূত্রিতা, বিচারের ব্যাপারে প্রধান বিরোধী দলের দ্বিচারী ভূমিকা, সরকারী উকিল দলের দক্ষতা আর আন্তরিকতার প্রতীয়মান অভাব, দেশে-বিদেশে বিচার প্রক্রিয়ার যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন, এসব কারণে বিচারটি নিয়ে অবিশ্বাসের জন্ম হয় জনমনে। এদিকে সামরিক শাসন আমলের কড়া ব্যবস্থার কথা ভুলে গিয়ে ক্ষমতাসীন নেতৃত্বের একাংশ পুনরায় দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়লে জনগণ আবারো হতাশ হয়। তবে অসহায় হলেও জনগণ ক্ষমতার রাজনীতির এই অচলায়তন ভাঙ্গার সুযোগ যখনই পেয়েছে তখনই তার ব্যবহার করেছে (যেমন নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে আইভী রহমানকে তার আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থীর বিরূদ্ধে ভোটে জেতানো)।
যুদ্ধাপরাধী মামলাগুলোর দ্বিতীয় রায়টির পূর্ববর্তী দিনগুলোতে জামাত শিবিরের গৃহযুদ্ধের হুমকি, তাদের তান্ডবের মুখে পুলিশ প্রশাসনের কিছুটা নমনীয় ভাব, এর পরপরই ঘোষিত রায়ে প্রথম রায়ের মত ফাঁসি না হয়ে যাবজ্জীবন হওয়া, আদালত প্রাঙ্গণে দন্ডপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধীর বিজয় চিহ্ন প্রদর্শন – এসব দ্রুত ঘটে যাওয়া ঘটনাকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরাজয় হিসেবে দেখে জনগণ। স্বাধীনতার চার দশক পরে রাজপথ আবারো স্বাধীনতা বিরোধীদের হাতে চলে যাওয়াটা সহজে মেনে নেয়নি জনগণ। ব্লগারদের ডাক দেয়ার সাথে সাথেই তাতে সাড়া দেয় লোকজন স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে, দ্রুত, পুনরুদ্ধার করতে চায় হারিয়ে যাওয়া মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ।
দেখা যাচ্ছে জনগণ তৈরীই ছিল বিদ্যমান রাজনৈতিক সামাজিক সাংস্কৃতিক অবক্ষয়ের বিরূদ্ধে রূখে দাঁড়াতে। অপেক্ষা ছিল কারো ডাক দেয়ার। আর যে বা যারা সেই ডাকটি দেয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল তাদের জন্য দরকার ছিল সঠিক একটি সময় আর এমন একটি বিষয় যার সাথে খুব সহজেই একাত্ম করা যাবে জনগণের অধিকাংশকে। কাদের মোল্লার রায়ের অব্যবহিত পূর্বের ঘটনাগুলো সে সুযোগ এনে দিয়েছে। পৃথিবীর প্রায় সকল গণ আন্দোলনই অবশ্য এইভাবে হয়েছে। এই সাধারণ ঘটনাক্রম সে অর্থে নূতন কিছু নেই। পৃথিবীর অন্যান্য দেশ কিংবা বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যান্য আন্দোলনের মতই ছাত্র-তরুণ এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়। সেটিও নূতন কিছু নয়। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ইস্যুতে সম্পূর্ণ নির্দলীয় আহবানে লোকজনকে সাড়া দিতেও আমরা দেখেছি বিরানব্বই-এ শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গঠিত গণআদালতের বিচারের সময়ে। অর্থাৎ, নির্দলীয় নেতৃত্বের ব্যাপারটিও অভূতপূর্ব নয়।
শাহবাগ আন্দোলনে নুতনত্ব, অভিনবত্ব এবং অসাধারণত্ব যে বিষয়গুলোতে, তার প্রধানতমটি হচ্ছে একটি নূতন ধরনের সামাজিক রাজনৈতিক শক্তির আত্মপ্রকাশ এওং সেই আত্মপ্রকাশের পদ্ধতি। এই বিষয়ের বিস্তারিত বিশ্লেষণ এ লেখার পরবর্তী কিস্তিতে দেয়া হবে। তবে লেখাটি শেষ করার আগে একটি কাউন্টারফ্যাকচুয়াল (counterfactual) প্রশ্নের উত্তর দেয়ার চেষ্টা করব। প্রশ্নটি আপাতঃদৃষ্টিতে খুব সাধারণ প্রশ্ন হলেও বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে বিশ্লেষকদের এই প্রশ্ন নিয়ে গলদ্ঘর্ম হতে দেখা যাচ্ছে। প্রশ্নটি হচ্ছে, ব্লগার এন্ড একটিভিস্ট নেটওয়ার্ক ডাক না দিয়ে অন্য কেউ ডাক দিলে জনগণ এভাবে সাড়া দিত কিনা? এই অন্য কেউ বলতে মিডিয়ার বেতনভোগী সঞ্চালকেরা ইলেকট্রিক মিটার রিডারদের সংগঠন বা বণিক সমিতি এমনকি কোন এন, জি, ও-র কথা বোঝাচ্ছেন বলে মনে হয় না। তারা হয়ত জানতে চাচ্ছেন এমন একটি জনপ্রিয় ইস্যু কেন কাজে লাগাতে পারল না কোন রাজনৈতিক শক্তি, তথাকথিত তৃতীয় শক্তি যার সন্ধানে অনেককেই গলদ্ঘর্ম হতে দেখা গেছে ইদানীংকালে। গণবিস্ফোরণের যে সাধারণ সূত্রের কথা বলা হয়েছে আগের অনুচ্ছেদে, এই ধরনের বিক্ষোভের সেরকম আরো একটি সাধারণ চরিত্র হচ্ছে এটি সবসময়ই প্রতিষ্ঠান বিরোধী (anti-establishment)। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ষাটের দশকের স্বাধিকারের সংগ্রাম, আশির দশকের সামরিক সরকার বিরোধী আন্দোলন, কিংবা সাম্প্রতিককালের আরব বসন্ত এর সবগুলোরই সূচনা হয়েছিল ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। বাংলাদেশে গত দুই দশকের গণতান্ত্রিক নির্বাচনী ব্যবস্থায় বড় দুই দলসহ ডান-বাম অধিকাংশ দলই ক্ষমতার বলয়ে চলে এসেছে। এ লেখার আগের অনুচ্ছেদ্গুলোতে বর্ণিত হয়েছে এই রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যাপারে জনমনে কিধরনের নেতিবাচক ধারণা তৈরী হয়েছে। বড় দলগুলোর ছাত্র সংগঠনের নেতৃত্বে জাতীয় নেতৃত্বের মতই মূল্যবোধের অবক্ষয় দেখা গেছে। ক্যাম্পাসভিত্তিক কোন আন্দোলন গড়ে না ওঠায় কিংবা জাতীয় নেতৃত্বের অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে কোন স্বতন্ত্র ধারার আন্দোলন গড়ে তুলতে ব্যর্থ হওয়ায় প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলোও সাধারণ ছাত্র সমর্থন হারিয়েছে। শ্রমিক কৃষকদের সংগঠনগুলোকেও তাদের নিজ নিজ পেশাস্বার্থের বাইরে জাতীয় ইস্যুতে কোন কথা বলতে দেখা যায় নি। অর্থাৎ জনমনে ব্যাপক অসন্তোষ তৈরী হলেও সেই অসন্তোষকে ধারণ করার মত আস্থার জায়গাটি কোন রাজনৈতিক সংগঠন তৈরী করতে তো পারেই নি বরঞ্চ তারা অবক্ষয়ী প্রতিষ্ঠানের প্রতিভু কিংবা সুবিধাভোগী হিসেবে জনমানসে পরিচিত হয়েছে। আর তাই ক্ষেত্র যখন প্রস্তুত তখনও এগিয়ে আসতে পারেনি, আসার চিন্তা করতে পারেনি পরিচিত রাজনৈতিক শক্তিগুলো। সবচেয়ে মজার ব্যাপার, সমাজ রাজনীতির এই অচলায়তনকে সচল করার জন্য একদল তরুণ যে প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছিল সেই ব্যাপারটিও নজরে আসেনি রাজনৈতিক নেতা, ভাষ্যকার বা বিশ্লেষক কারোই।