কবির মেয়ে বলেন, “আমরা মরদেহ বাংলাদেশে আনতে পারিনি, এজন্য বাংলাদেশের মানুষের কাছে ক্ষমা চাই।”
Published : 12 Oct 2023, 05:23 PM
কবি আসাদ চৌধুরীর মরদেহ বাংলাদেশে আনতে না পারার জন্য বাংলাদেশের মানুষের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন কবির সন্তানরা।
তার ছেলে আসিফ চৌধুরী বলেছেন, কবি আসাদ চৌধুরী কানাডার মাটিতে শুয়ে আছেন ‘বাংলাদেশের মাটি বুকে নিয়েই’।
বৃহস্পতিবার বাংলা একাডেমি আয়োজিত 'কবি আসাদ চৌধুরী স্মরণসভা'য় কানাড থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে যুক্ত হন আসিফ। তার বাবার প্রতি ভালোবাসা প্রকাশের জন্য সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান।
আসিফ চৌধুরী বলেন, “আব্বুকে যখন কবর দেওয়া হয়, তার আগে এখানে আমাদের এক চাচা একটা প্যাকেট বের করে দেন, যেখানে ছিল বাংলাদেশের মাটি। তিনি আমাদের বলেন, 'প্যাকেটে বাংলাদেশের মাটি আছে'। তিনি দেশ থেকে আসার সময় নিয়ে এসেছিলেন। এখানে বাবা বাংলাদেশের মাটি বুকে নিয়েই শুয়ে আছেন। আমি কৃতজ্ঞতা জানাই আক্তার হোসেন চাচার কাছে।”
আসাদ চৌধুরী বেশ কয়েক বছর ধরেই কানাডায় ছেলে ও মেয়ের সাথে ছিলেন। গত বছর থেকে ব্লাড ক্যান্সারে ভুগছিলেন তিনি।
গত ৫ অক্টোবর কানাডার একটি হাসপাতালে মারা যান কবি। তার বয়স হয়েছিল ৮০ বছর। পরদিন সেখানেই তাকে দাফন করা হয়।
গত শতকের সত্তরের দশক থেকে কবিতার পাশাপাশি আসাদ চৌধুরী লিখে গেছেন প্রবন্ধ, শিশুতোষ গল্প ও কবিতা, অনুবাদ, ইতিহাস ও জীবনীগ্রন্থ। এ পর্যন্ত প্রায় চার ডজন বই প্রকাশিত হয়েছে তার।
সাহিত্যে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৮৭ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার ও ২০১৩ সালে একুশে পদক পান তিনি।
স্মরণসভায় বক্তব্য দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন কবির মেয়ে নুসরাত জাহান চৌধুরী। তিনিও কানাডা থেকে যুক্ত হয়েছিলেন ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে।
নুসরাত বলেন, “আমরা মরদেহ বাংলাদেশে আনতে পারিনি, এজন্য বাংলাদেশের মানুষের কাছে ক্ষমা চাই। বাবার শরীরে অনেক ক্ষত হয়েছিল। মৃত্যুর আগে তিনি অনেক কষ্ট পেয়েছিলেন। এজন্য আমরা বাংলাদেশে আনতে পারিনি।
“বাংলাদেশে আনতে গেলে ফরমালিন দিতে হবে, শরীরের উপর দিয়ে আরও অনেক কিছু করতে হবে। এজন্য আমরা পরিবার থেকে এখানে দাফন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”
আসিফ বলেন, “বাবা সবশেষ ৬ মাস অনেক কষ্ট করেছেন হাসপাতালে। শরীর এমন কোনো জায়গা ছিল না, যেখানে স্যালাইনের জন্য সুচ লাগানো হয়নি। দেশে আনতে হলে প্রক্রিয়াটা সুন্দর হত না।”
স্মরণসভায় সূচনা বক্তব্য দেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মুহম্মদ নূরুল হুদা। সভাপতিত্ব করেন একাডেমির সভাপতি ও কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন।
স্মৃতিচারণ করে বক্তব্য দেন অভিনেতা মামুনুর রশীদ, বাংলা একাডেমির ফেলো সুব্রত বড়ুয়া, কথাসাহিত্যিক আনোয়ারা সৈয়দ হক, কবি আসাদ মান্নান, কবি বিমল গুহ, কবি সরকার আমিন, লেখক-প্রকাশক রবিন আহসান, শিল্পী কল্যাণী ঘোষ, গবেষক আমিনুর রহমান সুলতান।
আসাদ চৌধুরীর লেখা 'বারবারা বিডলারকে' কবিতাটি আবৃত্তি করেন শাহাদাৎ হোসেন নিপু। কবির জামাতা নাদিম ইকবাল নির্মিত একটি তথ্যচিত্র দেখানো হয়। কবিকে নিয়ে বিভিন্নজনের লেখা থেকে পাঠ করেন পিয়াস মজিদ।
কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা বলেন, “আসাদ চৌধুরীর মত মানুষ যে সমাজে জন্মায়, সেই সমাজ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। লোকায়িত জীবন আসাদ চৌধুরীর কবিতায় উঠে আসে পরম মমতায়।”
১৯৪৩ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার উলানিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন আসাদ চৌধুরী। আরমানিটোলা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে প্রবেশিকা এবং বরিশালের ব্রজমোহন কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক শেষ করে তিনি ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
বাংলায় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করে কলেজের শিক্ষকতার মধ্য দিয়ে আসাদ চৌধুরীর চাকরিজীবন শুরু। ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজে ১৯৬৪-১৯৭২ পর্যন্ত শিক্ষকতা করেন তিনি।
আসাদ চৌধুরী পরে থিতু হন ঢাকায়, সে সময় বিভিন্ন সংবাদপত্রে তিনি সাংবদিকতাও করেন। দীর্ঘদিন বাংলা একাডেমিতে চাকরি করার পর তিনি পরিচালক হিসেবে অবসরে যান।
স্মরণসভায় মামুনুর রশীদ বলেন, “আসাদ ভাই তখন ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজের শিক্ষক। প্রতি শনিবার তিনি ঢাকায় আসতেন। আমরা প্রতি সপ্তাহে অপেক্ষায় থাকতাম। কারণ আসাদ ভাই এলেই জমজমাট আড্ডা হত। পরে আসাদ ভাই, শান্তনু কায়সারের কারণে অনেকবার গিয়েছি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়।”
বাংলা একাডেমির ফেলো সুব্রত বড়ুয়া বলেন, “আমার আসাদ চৌধুরীর সাথে প্রথম পরিচয় মুক্তিযুদ্ধের সময়। তখন তিনি জয় বাংলা পত্রিকার সাথে যুক্ত ছিলেন। দেশ স্বাধীনের পর তিনি যখন বাংলা একাডেমিতে যোগ দেন, তখন তিনি আমার সহকর্মী হন। টেলিভিশনে আমি প্রথম যে অনুষ্ঠান করেছি, সেটিও ছিল আসাদ ভাইয়ের সাথে। আমি চিরকালই তাকে বড় ভাইয়ের মত ভেবেছি। তার যে গুণটি মুগ্ধ করত, তা হল অন্যকে খুব সহজে কাছে টেনে নেওয়া।”
কথাসাহিত্যিক আনোয়ারা সৈয়দ হক বলেন, “আমি আসাদ ভাইকে প্রচণ্ড হিংসা করতাম। তিনি বরিশাল, ময়মনসিংহে, পটুয়াখালি চলে যেতেন কবিতা পড়তে। তাকে দেখে ভাবতাম, যদি আমিও এভাবে যেখানে খুশি চলে যেতে পারতাম। যদি আমি ছেলে হতাম। এটা ভাবতাম।
“তাকে বিদেশে কবর দেওয়ায় আমার মনে অনেক কষ্ট। এটা নিয়ে আমার কিছু বলার নাই। হয়ত পরিবার চেয়েছে, তাই সেখানে আছেন তিনি। অনেকে বলবেন, দেশে থাকলে কী হত, কেউ তো তাকে দেখতেও যাবে না। দেশ তো কবিকে মূল্যায়ন করে না। আমার কারো প্রতি কোনো অভিযোগ নয়, আমরা যেন আসাদ ভাইয়ের জন্য এই দেশে কিছু করি।”
কবি আসাদ মান্নান বলেন, “আসাদ চৌধুরীর স্নেহ থেকে তরুণরা কখনোই বঞ্চিত হননি। খ্যাতি, ক্ষমতা, লোভ তাকে স্পর্শ করেনি। ভালোবাসা দিয়ে তিনি আমাদের আগলে রেখেছেন। আসাদ চৌধুরীর কবিতা হাজার বছর পরে হলেও উচ্চারিত হবে। জীব মারা যায়- কিন্তু কবি মরে না। তিনি কবি, তিনি আছেন, তিনি থাকবেন।”
কবি বিমল গুহ বলেন, “আসাদ চৌধুরীর মৃত্যু একটি স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু সব স্বাভাবিক ঘটনা আমরা মেনে নিতে পারি না। আসাদ চৌধুরীর মৃত্যু মেনে নেওয়া কঠিন।”
সভাপতির বক্তব্যে সেলিনা হোসেন বলেন, “আমি এবং আসাদ চৌধুরী একই সময়ে বাংলা একাডেমিতে কর্মরত ছিলাম। আমি মনে করি আসাদ চৌধুরী আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন তার কবিতার মধ্য দিয়ে।”
তবক দেওয়া পান, জলের মধ্যে লেখাজোখা, মেঘের জুলুম পাখির জুলুম, আমার কবিতা, ভালোবাসার কবিতা, প্রেমের কবিতা, নদীও বিবস্ত্র হয়, বাতাস যেমন পরিচিত, বৃন্তির সংবাদে আমি কেউ নই, কিছু ফল আমি নিভিয়ে দিয়েছি, ঘরে ফেরা সোজা নয় তার উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ।
এছাড়া প্রবন্ধ সঙ্কলন কোন অলকার ফুল, জীবনীগ্রন্থ সংগ্রামী নায়ক বঙ্গবন্ধু, রজনীকান্ত সেন, স্মৃতিসত্তায় যুগলবন্দী এবং ইতিহাস গ্রন্থ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ তার গুরুত্বপূর্ণ কাজ।