“আমাদের নির্দেশনা আছে প্রত্যেকটা জায়গায় নির্বাচনি প্রচারে থাকতে হবে। সে হিসাবেই নির্বাচনের প্রচারে যাব," বলেন স্বাচিপ মহাসচিব।
Published : 28 Dec 2023, 12:37 AM
সরকারি চাকুরেদের রাজনীতিতে জড়ানো বা ভোটের প্রচারে অংশ নেওয়ায় নিষেধ থাকলেও এবার বহু চিকিৎসক তা মানছেন না।
দেশের বিভিন্ন নির্বাচনি আসনে আওয়ামী লীগ সমর্থক চিকিৎসকদের সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ বা স্বাচিপের সদস্যরা নৌকা মার্কার পক্ষে প্রচারে ব্যস্ত।
একটি আসনে চিকিৎসকরা এ সংগঠনের সভাপতি জামাল উদ্দিন চৌধুরীর পক্ষে প্রচার চালাচ্ছেন। তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন।
স্বাচিপের মহাসচিব কামরুল হাসান মিলন সরকারি চাকরিতে থেকে নিজেও আছেন ভোটের প্রচারে। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রশ্নে তিনি বলেছেন, এ বিষয়ে আইন কী বলে, সেটি তার ‘জানা নেই’।
স্বাচিপকে আওয়ামী লীগের ‘সহযোগী সংগঠন’ হিসেবে দাবি করে তিনি জানান, তারা সব ইউনিটকে ‘নৌকার প্রার্থীদের পক্ষে’ থাকতে বলেছেন।
তবে স্বাচিপ আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন নয়; দলের ভাতৃপ্রতীম তিনটি সংগঠনের একটি।
সরকারি চাকরিতে থাকা চিকিৎসকদের এমন তৎপরতার বিরদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নজির খুব বেশি নেই।
একটি নির্বাচনি এলাকায় আওয়ামী লীগের প্রার্থীর স্ত্রী ও সেখানকার একটি হাসপাতালের চিকিৎসককে কারণ দর্শাও নোটিস দেওয়ার খবর এসেছে সংবাদমাধ্যমে। যদিও সেই নোটিসের জবাব দিয়ে আবার তিনি ভোটের প্রচারে নেমে গেছেন।
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বাংলাদেশে সরকারি কর্মচারীদের যে একটা আচরণবিধি আছে সেটাই অনেকে ভুলে যান।”
আর নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ বলছেন, তাদের কাছে এ বিষয়ে কোনো অভিযোগ আসেনি।
“সরকারি কর্মকর্তাদের ভোটের প্রচারে কারো পক্ষে অংশগ্রহণের সুযোগ নেই। অভিযোগ পেলে তা খতিয়ে দেখা হবে।”
আইন ‘জানেন না’ মহাসচিব
গত ১৮ ডিসেম্বর প্রার্থীদের মধ্যে প্রতীক বরাদ্দের পরদিন নির্বাচন কমিশনের পাশেই ঢাকার আগারগাঁওয়ের সড়কে মিছিল করেন স্বাচিপের চিকিৎসকরা।
অফিস সময়ে চিকিৎসা সেবার ব্যাঘাত ঘটিয়ে জাতীয় অর্থপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানসহ (নিটোর) আশপাশের বেশ কয়েকটি সরকারি হাসপাতাল থেকে এসে তারা মিছিলে যোগ দেন।
সরকারের পক্ষে নানা স্লোগান দেওয়ার পাশাপাশি নৌকা মার্কায় ভোট চান চিকিৎসকরা। সেই মিছিলের ভিডিও তাদের ফেইসুবক পেইজেও শেয়ার করা হয়েছে।
যোগাযোগ করা হলে স্বাচিপের মহাসচিব কামরুল হাসান মিলন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "সহযোগী সংগঠন হিসেবে আমাদের নির্দেশনা আছে প্রত্যেকটা জায়গায় নির্বাচনি প্রচারে থাকতে হবে। সে হিসাবেই নির্বাচনের প্রচারে যাব।"
কামরুল জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট হাসপাতালে কার্ডিয়াক সার্জারি বিভাগের প্রধান ও অধ্যাপক হিসেবে এখনও চাকরি করছেন।
সরকারি চাকরি করে তো ভোটের প্রচারে যাওয়া যাবে না- এই বিষয়টি জানালে তিনি বলেন, "জানা নাই, (রাজনীতিতে নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে) দেখব। আপনার কাছে থাকলে (আইন) লিংক পাঠিয়ে দেন।”
স্বাচিপ সদস্যদের ভিন্ন যুক্তি
১৯৭৯ সালের বাংলাদেশ সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা (২০০২ সালের ৩০ ডিসেম্বর সংশোধিত) ২৫(১) ধারায় বলা হয়েছে, সরকারি কর্মচারী কোনো রাজনৈতিক দল বা রাজনৈতিক দলের কোনো অঙ্গসংগঠনের সদস্য হবেন না বা অন্য কোনো উপায়ে সম্পৃক্ত হবেন না অথবা বাংলাদেশে বা বিদেশে কোনো রাজনৈতিক কার্যক্রমে কোনো উপায়ে অংশগ্রহণ বা সহায়তা করবেন না।
বিধিমালার ২৫ (৩) ধারায় বলা হয়েছে, কোনো কর্মচারী নির্বাচনে কোনো ধরনের প্রচার বা কোনোভাবে হস্তক্ষেপ বা অংশগ্রহণ করবেন না। তবে তিনি তার ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন।
২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণবিধিমালাতেও সরকারি চাকরিজীবীদের ভোটের প্রচারে অংশগ্রহণে নিষেধাজ্ঞা আছে।
কিন্তু ময়মনসিংহ-৪ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মোহিত উর রহমান শান্তর পক্ষে দল বেঁধে প্রচার চালিয়ে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের হৃদরোগ বিভাগের আবাসিক চিকিৎসক সুধীর চন্দ্র পাল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেগুলোর ছবিও পোস্ট করছেন।
তার দাবি, ‘সরকারি কর্মচারী হিসেবে নয়’, তারা স্বাচিপের ব্যানারে প্রচারে অংশ নিচ্ছেন এবং তার মতে এটা কোনো আইনবিরোধী কাজ নয়।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে সুধীর বলেন, “স্বাচিপ আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতীম সংগঠন, তাহলে স্বাচিপের হয়ে তো আমরা কাজ করতেই পারি।
“আগেও করেছি, এখনও করছি। স্বাচিপের বর্তমান সভাপতি তো নির্বাচনও করছেন। তো ময়মনসিংহে স্বাচিপপন্থি চিকিৎসক যারা, তারাই নির্বাচনে কাজ করছেন।”
ঢাকা-১৩ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী জাহাঙ্গীর কবির নানকের পক্ষে নিয়মিত প্রচার চালাচ্ছেন শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক ডা. আইয়ুব হোসেন, রেসিডেন্ট গ্র্যাজুয়েট প্রীতম রায়সহ কয়েকজন।
প্রীতম রায় প্রচার চালানোর এসব ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করছেন। গত রোববার তারা বছিলা এলাকায় নৌকার পক্ষে প্রচার চালিয়েছেন। আগের বৃহস্পতিবার ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৩৪ নম্বর ওয়ার্ড এলাকায় গণসংযোগ করেছেন।
তার সঙ্গে ছিলেন চিকিৎসক আবদুল্লাহ আল মামুন বাপ্পি, সৈকত দেব এবং জুবায়ের সৈকত। এদের মধ্যে সৈকত দেব এখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এমএস কোর্সে পড়াশোনা করছেন। তিনি এর আগে মানিকছড়ি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মেডিকেল অফিসার ছিলেন।
আবদুল্লাহ আল মামুন বাপ্পি সরকারি সংস্থা ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব প্রিভেনটিভ অ্যান্ড সোশ্যাল মেডিসিন বা নিপসমে কর্মরত, জুবায়ের সৈকতও সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক।
এ বিষয়ে কথা বলতে প্রীতম রায়ের মোবাইলে একাধিকবার কল দিলেও তিনি ধরেননি।
আগারগাঁওয়ে সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ সড়কের বিভিন্ন জায়গায় বিভাজকে ঢাকা-১২ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আসাদুজ্জামান খান কামালের পক্ষে ভোট চেয়ে ফেস্টুন টানানো হয়েছে। এসব ফেস্টুনে নাম আছে স্বাচিপের সহ-সভাপতি মো. আবু রায়হানের। তিনি শ্যামলী টিবি হাসপাতালের উপ পরিচালক।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রশ্নে আবু রায়হানও ময়মনসিংহের সুধীর চন্দ্র পালের সুরে বলেন, “হাসপাতালের চিকিৎসক নয়, স্বাচিপের সদস্য হিসেবে নির্বাচনের প্রচারণা চালাচ্ছি।”
সরকারি কর্মচারী বিধিমালা অনুযায়ী কোনো রাজনৈতিক দল বা অঙ্গ সংগঠনের সদস্য হওয়ারও যে সুযোগ নেই, সে কথা মনে করিয়ে দিলে তিনি বলেন, “বিএমএ আছে, ড্যাব আছে, স্বাচিপও আছে। এটা হলে তো কোনো সংগঠনই হবে না।”
স্বাচিপ সভাপতির পক্ষে জনসভায় যাচ্ছেন, যুক্তি ‘সেদিন শুক্রবার’
চট্টগ্রাম-৩ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করছেন স্বাচিপ কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি জামাল উদ্দিন চৌধুরী।
স্বাচিপের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে গত ২৪ ডিসেম্বর সংগঠনির চট্টগ্রাম জেলা শাখা এবং চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ শাখার সভায় সিদ্ধান্ত হয়, আগামী শুক্রবার চিকিৎসকরা জামালউদ্দিন চৌধুরীর নির্বাচনী এলাকা সন্দ্বীপে জনসভায় যোগ দেবেন।
ওই সভায় অন্যদের সঙ্গে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের হৃদরোগ বিভাগের জুনিয়র কনসালটেন্ট আবুল হোসেন শাহীন, ইউরোলজি বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ মনোয়ার উল হক, এনেসথেশিয়া বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক প্রণয় দত্ত, অর্থোপেডিক বিভাগের মিজানুর রহমান, মেডিসিন বিভাগের রেজিস্ট্রার দিলীপ চৌধুরীও ছিলেন।
সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, যারা সন্দ্বীপ যাবেন, তাদেরকে বৃহস্পতিবারের মধ্যে চিকিৎসক আরিফুল আমিন এবং আবুল হোসেন শাহীনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে।
জানতে চাইলে আবুল হোসেন শাহীন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, স্বাচিপের মহাসচিব কামরুল হাসান মিলনও সমাবেশে যাচ্ছেন।
সরকারি চাকরি করে কীভাবে এই জনসভায় যাচ্ছেন- এই প্রশ্নে আবুল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সন্দ্বীপের প্রোগ্রামটা পড়েছে বন্ধের দিন। বন্ধের দিন তো যেতেই পারে। ক্যাম্পেইন ছাড়া অন্য কাজেও তো যেতে পারে।”
শোকজের জবাব দিয়ে ফের প্রচারে বাবুর চিকিৎসক স্ত্রী
নারায়ণগঞ্জ-২ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী নজরুল ইসলাম বাবুর স্ত্রী সায়মা আফরোজ সেই নির্বাচনি এলাকাতেই চাকরি করেন। তিনি আড়াইহাজার উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা।
সায়মা তার স্বামীর পক্ষে প্রকাশ্যেই প্রচার চালাচ্ছেন। এ বিষয়ে ব্যাখ্যা চেয়ে গত ২৪ ডিসেম্বর তাকে নোটিস দেন আসনটির নির্বাচনি অনুসন্ধান কমিটির সভাপতি সিনিয়র সহকারী জজ ধীমান চন্দ্র মণ্ডল।
তার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে নির্বাচন কমিশনকে কেন সুপারিশ করা হবে না, সোমবারের মধ্যে তার জবাব চাওয়া হয় সেখানে।
সোমবার প্রতিনিধির মাধ্যমে সে বিষয়ে লিখিত ব্যাখ্যা দেন সায়মা। ওইদিন বিকেলেই খাগকান্দা ইউনিয়নের কয়েকটি এলাকায় তিনি বাবুর প্রচারে অংশ নেন।
নির্বাচন অনুসন্ধান কমিটির সভাপতি ধীমান চন্দ্র মণ্ডল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সায়মা আফরোজ প্রতিনিধি পাঠিয়ে ওই ঘটনার লিখিত ব্যাখ্যা দিয়েছেন। আমরা অনুসন্ধান কমিটির পক্ষ থেকে তদন্ত করে এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনে প্রতিবেদন দেওয়া হবে।”
সায়মা কী বলেছেন, সে প্রশ্নে তিনি বলেন, “তিনি কী ব্যাখ্যা দিয়েছেন তা তদন্তের স্বার্থে এখনই বলা যাবে না।”
আরও পড়ুন: