স্বরূপে ফিরেছে ‘ঢাকা গেইট’, উদ্বোধন বুধবার

মীর জুমলার আসাম অভিযানের ‘বিবি মরিয়ম’ কামানটিও ওসমানী উদ্যান থেকে এনে ঢাকা গেইটের পাশে স্থাপন করা হয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 Jan 2024, 05:19 PM
Updated : 23 Jan 2024, 05:19 PM

বহু বছরের অযত্ন ও অবহেলায় যে ‘ঢাকা গেইট’ হারিয়ে যেতে বসেছিল, সংস্কারের পর সেই ঐতিহাসিক স্থাপনাটি ফিরেছে স্বরূপে।

জনসাধারণের জন্য এ স্থাপনাটি বুধবার উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে বলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের তরফে জানানো হয়েছে।

মঙ্গলবার সরেজমিনে দেখা যায়, পুরনো আদলে সংস্কার করা হয়েছে ফটকটি। এর আশেপাশে দর্শনার্থীদের জন্য বসার জায়গা করা হয়েছে। মীর জুমলার আসাম অভিযানের ‘বিবি মরিয়ম’ কামানটি ওসমানী উদ্যান থেকে এনে ঢাকা গেইটের পাশে স্থাপন করা হয়েছে।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের জনসংযোগ বিভাগের কর্মকর্তা মো. আবু নাছের বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানিয়েছেন, বুধবার বিকাল ৪টায় ফটকটি উদ্বোধন করা হবে।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস, ঢাকা-৮ আসনের সংসদ সদস্য আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন ও ফটকের নতুন নকশাকার অধ্যাপক আবু সাঈদ উপস্থিত থাকবেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দোয়েল চত্বরের কাছে জরাজীর্ণ ‘ঢাকা গেইট’র নান্দনিকতা ফেরাতে ২০২২ সালে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন সংস্কারের উদ্যোগ নেয়।

গত বছরের মে মাসে সংস্কার কাজ শুরু হয়, যার কাজ সম্প্রতি শেষ হয়েছে। প্রায় ৮২ লাখ টাকা খরচ করে এ গেইট সংস্কার করেছে ঠিকাদার কোম্পানি আহনাফ ট্রেডিংস।

প্রত্নতত্ব বিশেষজ্ঞ ও ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের অধ্যাপক আবু সাঈদের নেতৃত্বে একদল বিশেষজ্ঞ ফটকটির নতুন নকশা তৈরি করেন। সেই নকশার আদলেই নতুন করে সংস্কার করা হয়েছে।

এ বিষয়ে অধ্যাপক আবু সাঈদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যেটা আগে ছিল, ওটাকেই আমরা রিস্টোরেশন করেছি। কিছু জিনিস ভেঙে গিয়েছিল, সেগুলো নতুন করে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। ফটকের উপরে কলসের মত যে জিনিসগুলো, একটা কর্নারে বুরুজ ভাঙা ছিল, সেগুলো আমরা সংস্কার করেছি।

“তার মানে আদি যে ডিজাইনটা ছিল, সেটাকেই আবার নতুনভাবে করা হয়েছে। তবে সেখানে নতুন করে বসার স্থান এবং মীর জুমলার ‘বিবি মরিয়ম’ কামানটা সংযোজন করা হয়েছে।”

ঐতিহাসিক ঢাকা গেইট তিনটি অংশে বিভক্ত। পশ্চিমাংশ পড়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স ভবনের পাশ, পূর্বের অংশ পড়েছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের তিন নেতার সমাধির প্রবেশপথের সামনে এবং মাঝের অংশ পড়েছে দোয়েল চত্বর থেকে টিএসসিগামী সড়ক দ্বীপে। বর্তমানে ফটকটির উপর দিয়ে মেট্রোরেল চলাচল করে।

কখন এবং কেন রমনার এই ফটকটি নির্মাণ হয়েছিল তা নিয়ে অবশ্য ইতিহাসবিদ ও প্রত্নতাত্ত্বিকদের মধ্যে বিতর্ক আছে।

এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে প্রকাশিত ঢাকা কোষে বলা হয়েছে, ঢাকার সীমানা চিহ্নিত করতে এবং স্থলপথে শত্রুদের আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে ১৬৬০ থেকে ১৬৬৩ সালের মধ্যে ফটকটি নির্মাণ করেছিলেন মীর জুমলা।

তবে ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন এ ধারণার সঙ্গে একমত নন। তার ‘স্মৃতি-বিস্মৃতির নগরী ঢাকা’ গ্রন্থে দাবি করা হয়েছে, ব্রিটিশ আমলে ঢাকার প্রথম ম্যাজিস্ট্রেট চার্লস ড’স ১৯২৫ সালের পর রমনার জঙ্গল পরিষ্কার করে রেসকোর্স তৈরি করেছিলেন।

মূল শহরের সঙ্গে রেসকোর্সকে যুক্ত করার জন্য ড’স রেসকোর্সের উত্তর পূর্ব দিকে তৈরি করেছিলেন একটি রাস্তা। রাস্তার প্রবেশমুখে দুটি স্তম্ভ তৈরি করেছিলেন। ‘প্রচলিত মত’ অনুসারে এ দুটি স্তম্ভের নাম মীর জুমলার ফটক।

অধ্যাপক আবু সাঈদ বলেন, “জনশ্রুতি আছে, মীর জুমলা ঢাকা উত্তরের গেইট নির্ধারণের জন্য এটি নির্মাণ করেছিলেন। কিন্তু এখন যে গেইটটা আছে, সেটা ব্রিটিশ আমলে চার্লস ড’স তৈরি করেন।

“পূর্বদিকের যে অংশটা, সেটা পাকিস্তান আমলে আজম খানের সময়ে তৈরি করা হয়েছে। রাস্তাটা যখন বড় করে, তখন ফটকটির ৫০ শতাংশ সরিয়ে ফেলা হয়।”

তবে এটি মুঘল আমলেই নির্মাণ করা হয়েছিল বলে মনে করেন প্রত্নতাত্ত্বিকরা। উপমহাদেশের খ্যাতনামা ঐতিহাসিক ও এমিরেটাস অধ্যাপক ড. এ এইচ দানীর ভাষ্য, এর গড়ন ইউরোপীয় ধাঁচের।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক এ কে এম শাহনেওয়াজ মনে করেন, এটি মুঘল আমলেই তৈরি।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেছেন, “ঔপনিবেশিক আমলে ঢাকার সীমানা আরও বড় ছিল। তখনই সেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে, নবাবদের আমলে হয়েছে শাহবাগ। ঔপনিবেশিক আমলে হলে এ গেইট আরও উত্তরে হত।

“তখন যদি এটা নির্মাণ করা হয়ে থাকে, তাহলে দেখা যাবে পেছনেও শহর এবং সামনেও শহর। মাঝখানে তো গেইট হওয়ার কথা নয়। গেইট তো হবে শহরের প্রবেশ পথ। কলোনিয়াল পিরিয়ডে গেইট দিয়ে আলাদা করার প্রবণতা দেখা যায় না। এই গেইট করার প্রবণতা মুঘল আমলেই ছিল।”