“শুধু অবকাঠামো করলেই হবে না, ব্যবস্থাপনায় উন্নতি ঘটাতে হবে। যতক্ষণ পর্যন্ত আইনের মাধ্যমে শৃঙ্খলা আনা সম্ভব না হবে, ততক্ষণ কাজের কাজ কিছুই হবে না,” বলেন ইলিয়াস কাঞ্চন।
Published : 22 Oct 2023, 11:35 AM
কুমিল্লার দাউদকান্দিতে গত বৃহস্পতিবার বিকেলে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে অটোরিকশাকে চাপা দিয়ে একটি বাস খাদে পড়ে গেলে তিনজন নিহত হন। নিহত তিনজনই অটোরিকশার যাত্রী, আহত হন বাসের ৩০ জন। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, সেখানে সড়কে বিভাজক থাকলেও কাছের একটি সংযোগ সড়কে ঢোকার জন্য অটোরিকশাটি তখন উল্টোপথে চলছিল।
সড়ক নিরাপত্তার জন্য জাতিসংঘ ঘোষিত পাঁচটি পিলারের প্রথমটি হল সড়ক নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা। বাংলাদেশের মহাসড়ক ব্যবহারকারী বাস-ট্রাকের মালিক ও নিরাপদ সড়কের দাবিতে কাজ করা ব্যক্তিরা বলছেন, দেশজুড়ে অনেক নতুন নতুন সড়ক, সেতু, সড়ক বিভাজক হয়েছে, অনেক জায়গায় বাঁকা সড়কের নকশা পরিবর্তন করে সোজা করা হয়েছে। কিন্তু সড়কে কেউ আইন মানে না।
ফলে সড়কের বিশৃঙ্খলা কমেনি। সড়ক বিভাজক হওয়ার পরও তিন চাকার বাহনগুলো আগের মতই দাপটের সঙ্গে উল্টোপথে চলছে।
“মহাসড়কগুলোতে আপনি বড় গাড়ি নিয়ে চলবেন কীভাবে। ঢাকা-সিলেট রোডটার কথাই ধরেন। ঢাকা থেকে নরসিংদী একেবারে ভৈরব পর্যন্ত রাস্তার দুই পাশে পুরাই বাজার। সমানে তিন চাকার যানবাহন চলতেছে। আর দুর্ঘটনা ঘটলে দায় কিন্তু বড় গাড়ির, বলেন এনা পরিবহনের মালিক খন্দকার এনায়েত উল্লাহ, যিনি বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব।
হাইওয়ে পুলিশ বলছে, প্রতিমাসে ২৫ থেকে ৩০ হাজার মামলা হচ্ছে, মাসে ১০ হাজারের বেশি তিন চাকার বাহনকে জরিমানা করা হচ্ছে। কিন্তু তিন চাকার যানবাহনগুলো গ্রামীণ অর্থনীতির সঙ্গে এমনভাবে জড়িয়ে গেছে, তাদের থামানো যাচ্ছে না।
গত বছরের ডিসেম্বরে একযোগে একশ সড়ক মহাসড়কের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আগের মাসেই তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে একশ সড়ক সেতু উদ্বোধন করেন। ঢাকা থেকে পদ্মাসেতু হয়ে ফরিদপুরের ভাঙা পর্যন্ত এক্সপ্রেসওয়ে হয়েছে, উত্তরবঙ্গের পথে গাজীপুরের চন্দ্রা থেকে টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা পর্যন্ত প্রশস্ত এক্সপ্রেসওয়ে হয়েছে। সিরাজগঞ্জ থেকে রংপুর পর্যন্ত চার লেইন সড়কের কাজ শেষের দিকে।
নতুন নতুন অবকাঠামো হলেও সড়কে শৃঙ্খলা আনা যায়নি বলেই মনে করেন অভিনেতা ইলিয়াস কাঞ্চন, যিনি দেশের সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করছেন তিন দশক ধরে।
১৯৯৩ সালের ২২ অক্টোবর সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন তার স্ত্রী জাহানারা কাঞ্চন। এরপর ইলিয়াস কাঞ্চন গড়ে তোলেন ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলন। তার দীর্ঘদিনের চেষ্টায় ২০১৭ সালে সরকার ২২ অক্টোবরকে জাতীয়ভাবে নিরাপদ সড়ক দিবস হিসেবে পালনের ঘোষণা দেয়।
ইলিয়াস কাঞ্চন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, শুধু অবকাঠামো করলেই হবে না, ব্যবস্থাপনায় উন্নতি ঘটাতে হবে। যতক্ষণ পর্যন্ত আইনের মাধ্যমে শৃঙ্খলা আনা সম্ভব না হবে, ততক্ষণ কাজের কাজ কিছুই হবে না।
“যেমন দেখেন ঢাকার মধ্যে যে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে হয়েছে, সেখানে সর্বোচ্চ গতিসীমা ৮০ কিলোমিটার। কিন্তু আমি প্রতিদিন দেখি গাড়িগুলো অহরহ অতিরিক্ত গতিতে চলে। এটা দেখার দায়িত্ব পুলিশের। কিন্তু কোনো মনিটরিং নেই। একসময় এগুলো অভ্যাসে পরিণত হবে, প্রাণহানি ঘটবে।”
ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, “সড়কটা নিরাপদ করে বানালাম, কিন্তু এখানে যে অনিরাপদ গাড়িগুলো চলছে, তাতে নিরাপত্তা থাকল কোথায়। নতুন সড়ক আইনে ২৫ বছরের পুরনো গাড়ি ডাম্পিংয়ে পাঠানোর কথা বলা হয়েছে। কিন্তু পরিবহন মালিকদের কারণে তা হচ্ছে না।
“একটা গাড়ির ফিটনেসের তো একটা বয়স থাকে। ওই গাড়ি যখন সড়কে যাচ্ছে তখন নিরাপত্তা থাকল কোথায়। ফোর লেইন, সিক্স লেইন রাস্তা হয়েছে, ডিভাইডার হয়েছে। কিন্তু সেখানে উল্টোপথে যে গাড়িগুলো আসে, সেটা দেখবে কারা? এনফোর্সমেন্ট তো করবে পুলিশ। এসব ক্ষেত্রে পুলিশের একটা অবহেলা আছে।”
হাইওয়ে পুলিশের প্রধান (অতিরিক্ত আইজিপি) মো. শাহাবুদ্দিন খান অবহেলার অভিযোগ মানতে রাজি নন। তবে সত্যিই ‘কাজের কাজ’ কিছু হয়েছে, তেমনটাও তিনি দাবি করতে পারছেন না।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “যেহেতু হাই কোর্টের একটা নির্দেশনা ছিল, মন্ত্রণালয়ের একটা নির্দেশনা ছিল বড় পাঁচটা হাইওয়েতে আমরা যেন তিনচাকার বাহন নিয়ন্ত্রণ করি। সে লক্ষ্যে হাইওয়ে পুলিশের পাশাপাশি পুলিশের অন্যান্য ইউনিটগুলোও কাজ করছে।
“এ বিষয়ে আইনের প্রয়োগ ক্রমান্বয়ে আমরা বৃদ্ধি করছি। শাস্তিমূলক ব্যবস্থা, জরিমানা ইত্যাদির পাশাপাশি তারা যেন মহাসড়কে না আসে সেজন্য স্থানীয় মানুষকে সঙ্গে নিয়ে সামাজিক একটা প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা ইত্যাদি আমরা করছি। কিন্তু আমি বলব না যে এটা খুব সন্তোষজনক বা আমরা নিরঙ্কুশভাবে তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছি।”
উন্নতি তাহলে কোথায় হয়েছে? শাহাবুদ্দিন খান বলছেন, যে মহাসড়কগুলোর দুই পাশে সার্ভিস লেইন আছে সেখানে কোনো থ্রি হুইলার মহাসড়কে উঠছে না।
“যেমন ঢাকা থেকে পদ্মাসেতু হয়ে ভাঙা পর্যন্ত এক্সপ্রেসওয়ে, গাজীপুরের চন্দ্রা থেকে টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা পর্যন্ত নতুন মহাসড়ক এবং সিরাজগঞ্জের হাটিকুমরুল থেকে নাটোরের বনপাড়া পর্যন্ত যে সড়কটি রয়েছে, দুপাশে সার্ভিস রোড রয়েছে। এই সড়কগুলোতে কিন্তু আমাদের থ্রি হুইলারের কারণে কোন সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে না এখন।”
এক্ষেত্রে সরকার ‘সঠিক পথেই এগোচ্ছে’ দাবি করে এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, “বাকি সবগুলো বড় মহাসড়কে ডেডিকেটেড সার্ভিস লেইন তৈরি করা হচ্ছে। সেগুলো হয়ে গেলে এই সমস্যাগুলো থাকবে না, আমাদের পুলিশের পেরেশানিও কমবে।”
তবে অন্যান্য আঞ্চলিক সড়ক বা যেসব মহাসড়ক ‘সিক্স লেইন’ হয়নি, সেসব জায়গায় তিন চাকার বাহনের দাপট কমানোর বিষয়ে খুব একটা আশার কথা শোনাতে পারলেন না হাইওয়ে পুলিশের প্রধান।
তিনি বলেন, “এগুলোর ব্যবহারকারী প্রচুর। এই গাড়িগুলোর ওপর বিপুল সংখ্যক মানুষের জীবিকা নির্ভর করছে। স্বল্প খরচে যাতায়াত ও মালামাল পরিবহনের মাধ্যম হিসেবে আমাদের গ্রামীণ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে এই যানবাহনগুলো একেবারে মিশে গেছে।
“এগুলোর প্রয়োজনীয়তা এখন এত বেশি হয়ে গেছে এবং এগুলোর ওপর মানুষ এত নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে যে এই জায়গাগুলোতে ক্রমান্বয়ে এগুলো বাড়ছে। শাস্তি দিয়ে, জরিমানা করেও কিন্তু সড়ক থেকে তাদের সম্পূর্ণভাবে সরানো যায়নি। স্কুলে যাবে, বাজারে যাবে ইত্যাদি বিভিন্ন কাজে এগুলো দরকার হচ্ছে। আর মহাসড়কগুলোর পাশেই আমাদের স্কুল-কলেজ, হাটবাজার সবকিছুই।”
এসব থ্রি হুইলারের কোনো লাইসেন্স নাই, চালকদেরও লাইসেন্স লাগে না। তাহলে কোন আইনের ভিত্তিতে তাদের নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চলছে?
শাহাবুদ্দিন খান বলেন, “২০১৮ সালের যে সড়ক পরিবহন আইন রয়েছে, সেখানে এ ধরনের গাড়িতে প্রসিকিউশন দেওয়ার একটা সুযোগ রয়েছে। প্রতি মাসে অন্তত ১০ হাজার গাড়িতে জরিমানা করা হয় শুধুমাত্র তিন হাজার কিলোমিটার হাইওয়ে এলাকায়।
“মহাসড়কে আগে ১০ হাজার প্রসিকিউশন হত। এখন প্রতিমাসে ২৫ থেকে ৩০ হাজার মামলা হচ্ছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ক্যামেরা বসানোর কাজও প্রায় শেষের দিকে, এ বছরের শেষ নাগাদ হয়ত আমরা চালু করতে পারব। এছাড়া আরও কিছু প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে।”
অতিরিক্ত আইজিপি শাহাবুদ্দিন বলেন, “আমি যেটা মনে করি, ম্যানুয়ালি আমরা যা কিছু করার চেষ্টা করি, প্রযুক্তির ব্যবহার তার চেয়ে অনেক কার্যকর হচ্ছে। দেশব্যাপী মহাসড়কও হয়তো একসময় প্রযুক্তির আওতায় আসবে।”
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরীও মনে করেন, প্রযুক্তি সড়ককে নিরাপদ করতে সহায়ক হতে পারে।
“সড়কে ই-ট্রাফিকিং সিস্টেম চালু করা গেলে দুর্ঘটনা ৮০ শতাংশ কমে আসবে। সড়কে ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা বসানো থাকবে। কোন যানবাহন আইনের বাত্যয় ঘটালে চালক ও মালিকের ব্যাংক হিসাব থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে জরিমানা আদায়ের পদ্ধতি চালু করতে হবে। তাহলে আইন মেনে চলার প্রবণতা বাড়বে।”
মোজাম্মেল বলছেন, “সড়ক দুর্ঘটনা কমানো সরকারের অন্যতম নির্বাচনী অঙ্গীকার হলেও সড়ক নিরাপত্তায় বিগত বছরগুলোতে দৃশ্যমান কোনো কার্যক্রম ছিল না। সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ে প্রতি বছর হাজার কোটি টাকা বাজেট থাকলেও সড়ক দুর্ঘটনার মহামারী থেকে মানুষকে রক্ষায় কোন উদ্যোগ ছিল না। ফলে প্রতি বছর দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি বাড়ছেই।”
নিরাপদ সড়ক দিবস উপলক্ষ্যে শনিবার এক সংবাদ সম্মেলনে মোজাম্মেল বলেন, তার সংগঠনের হিসাবে, প্রতিবছর সড়ক দুর্ঘটনায় প্রায় ৮ হাজার মানুষ মারা যায়।
আর সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে, সড়কে প্রতিদিন গড়ে ৬৪ জনের প্রাণহানি ঘটছে, সেই হিসেবে বছরে দুর্ঘটনায় মারা যায় ২৩ হাজার ৩৬০ জন। প্রায় সাড়ে তিন লাখ মানুষ আহত হয়।
প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় প্রায় ৮০ হাজার মানুষ প্রতিবন্ধী হয়ে পড়ছে। এর মধ্যে ১২ হাজারের বেশি ১৭ বছর বা তার কম বয়সী শিশু।
আর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে, প্রতি বছর বাংলাদেশের সড়কে মারা যায় ২৪ হাজার ৯৫৪ জন। সড়ক দুর্ঘটনার কারণে জিডিপির ক্ষতি হয় ৫ দশমিক ৩ শতাংশ।
পুরনো খবর