দিবস আসছে-যাচ্ছে, সড়ক নিরাপদ হচ্ছে না

চার বছর ধরে দেশে পালিত হচ্ছে ‘নিরাপদ সড়ক দিবস’; তা পালন শুরুর এক বছরের মাথায় শিক্ষার্থীদের নজিরবিহীন এক আন্দোলনে আরও জোরাল হয়ে উঠেছিল দাবিগুলো, তাতে আশ্বাসের ফুলঝুড়ি ফুটলেও সড়কের অনিরাপদ চিত্র বদলায়নি।

লিটন হায়দারবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 Oct 2021, 06:55 PM
Updated : 21 Oct 2021, 06:55 PM

শুক্রবার ২২ অক্টোবর ‘জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস’র পালনের আগে এই দিবস পালনের পর থেকে বছরগুলোর পরিসংখ্যান ঘেঁটে দেখা যায়, সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু বেড়েই চলেছে।

১৯৯৩ সালের ২২ অক্টোবর এক সড়ক দুর্ঘটনায় স্ত্রীকে হারানোর পর নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেছিলেন চলচ্চিত্র অভিনেতা ইলিয়াস কাঞ্চন।

‘নিরাপদ সড়ক চাই’ শীর্ষক ওই আন্দোলন আরও গতি পেয়েছিল ২০১১ সালে ১৩ অগাস্ট সড়ক দূর্ঘটনায় চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব মিশুক মুনীরের মৃত্যুতে।

এরপর ২০১৭ সালের ৫ জুন মন্ত্রিসভার এক বৈঠকে ২২ অক্টোবরকে ‘জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস’ হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার।

দিনটিতে নানা কর্মসূচিতে সড়ক দুর্ঘটনা এড়াতে জনসচেতনতা তৈরির নানা কর্মসূচি নেওয়া হচ্ছিল।

এর মধ্যেই ২০১৮ সালে ২৯ জুলাই ঢাকার বিমানবন্দর সড়কে দুই কলেজ শিক্ষার্থী বাসের ধাক্কায় মারা যাওয়ার পর শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে অচল হয়ে পড়েছিল দেশ।

তখন সড়কে মৃত্যুর মিছিল ঠেকাতে আইন কঠোর করার পাশাপাশি নানা আশ্বাস দিয়ে ঘরে ফেরানো গেলেও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি।

সড়কে মৃত্যুর মিছিল থামছে না।

পুলিশ সদর দপ্তর থেকে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, ২০১৬ সালে ২ হাজার ৫৬৬টি সড়ক দূর্ঘটনায় ২ হাজার ৪৬৩ জন নিহত হয়। পরের বছর নিহতের সংখ্যা বেড়ে ২ হাজার ৫১৩ জনে দাঁড়ায়। ২০১৮ সালে আগের বছরের চেয়ে মৃত্যুর সংখ্যা ১২২টি বেড়ে যায়।

২০১৮ সালের চেয়ে ২০১৯ সালে সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা দ্বিগুণ হওয়ার সঙ্গে মৃত্যুর সংখ্যাও দেড় হাজার বেড়ে যায়।

করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে ২০২০ সালে সড়কে গাড়ি চলাচল সীমিত থাকার মধ্যে দুর্ঘটনায় মৃত্যু কমলেও তা ছিল ৩ হাজার ৯১৮ জন।

একই অবস্থার মধ্যে চলতি বছরের অগাস্ট পর্যন্ত আট মাসে ৩ হাজার ৫০২ জন সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে। অর্থাৎ দিনে গড়ে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু ১৪ জন।

সাল

মৃত্যু

২০১৬

২৪৬৩

২০১৭

২৫১৩

২০১৮

২৬৩৫

২০১৯

৪১৩৮

২০২০

৩৯১৮

২০২১ (অগাস্ট পর্যন্ত)

৩৯১৮

পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দুর্ঘটনার অধিকাংশই ঘটছে মহাসড়ক ও আঞ্চলিক সড়কে।

২০২০ সালের তথ্যে দেখা গেছে, বাসের চেয়ে ট্রাক-কভার্ড ভ্যান দুর্ঘটনায় বেশি পড়েছে। গত বছর বাস দুর্ঘটনা ঘটেছে ৯৬৫টি, ট্রাক-কভার্ড ভ্যানে দুর্ঘটনা ঘটেছে ১ হাজার ৩১৫টি। আর মোটর সাইকেল দুর্ঘটনা ঘটেছে ৯৬১টি।

গাড়ি বেশি, চালক কম

সড়ক দুর্ঘটনা বেড়ে যাওয়ার জন্য গাড়ি ও চালকের অনুপাতের ব্যবধান বেড়ে যাওয়াকে অন্যতম কারণ হিসেবে দেখা হচ্ছে।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ জানিয়েছে, গত বছর সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নিবন্ধিত গাড়ির সংখ্যা ছিল ৪৫ লাখ ২৩ হাজার ৬০০টি। তার মধ্যে বাসের সংখ্যা ৫১ হাজার ৬৬৮টি।

এসব গাড়ির বিপরীতে চালকের লাইসেন্স প্রায় ২৪ লাখ।

ফলে অনেক গাড়ি লাইসেন্সবিহীন অদক্ষ চালক চালাচ্ছে বলে তা দুর্ঘটনা ঘটানোয় ভূমিকা রাখছে বলে ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলনের দাবি।

ফাইল ছবি

বিআরটিএর তথ্য অনুযায়ী, দেশে ২০২০ সাল পর্যন্ত নিবন্ধিত মোটর সাইকেলের সংখ্যা ৩০ লাখ ৩২ হাজার। আর লাইসেন্সধারী মোটর সাইকেল চালকের সংখ্যা ১৭ লাখ ৫৩ হাজার।

অর্থাৎ প্রায় ১ লাখ ২৮ হাজার মোটর সাইকেল চালকের লাইসেন্স ছাড়াই রাস্তায় চলছে।

এই মোটরসাইকেলকেন্দ্রিক দুর্ঘটনার বিষয়ে নিরাপদ সড়ক চাই’র পরিসংখ্যান বলছে, দেশে ২০২০ সালে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার সংখ্যা ১ হাজার ১২৭টি। ২০১৯ সালের চেয়ে এই সংখ্যা ৮ শতাংশ বেশি।

মামলাও এগোয় না

সড়ক দুর্ঘটনার জন্য মামলা হলেও তা বিচারে গড়ায় কম।

নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের সংগঠক লিটন এরশাদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দুর্ঘটনার পর মামলা না হওয়ার ঘটনাও যেমন আছে, পাশাপাশি মামলা হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে সমঝোতা হয়ে যায়। আবার আদালত ক্ষতিপূরণের রায় দিলেও তা আদায় করা কঠিন হয়ে পড়ে।”

সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮'র ৫২ নম্বর ধারা বলা হয়েছে “কোনো মোটরযান হইতে উদ্ভূত দুর্ঘটনার ফলে কোনো ব্যক্তি আঘাতপ্রাপ্ত বা ক্ষতিগ্রস্ত হইলে বা আঘাতপ্রাপ্ত হইয়া মৃত্যুবরণ করিলে, উক্ত ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি বা ক্ষেত্রমত তাহার উত্তরাধিকারীগণের পক্ষে মনোনীত ব্যক্তি ধারা ৫৩ এর অধীন গঠিত আর্থিক সহায়তা তহবিল হইতে ট্রাস্টি বোর্ড কর্তৃক নির্ধারিত ক্ষতিপূরণ বা, প্রযোজ্য ক্ষেত্রে, চিকিৎসার খরচ প্রাপ্য হইবেন।”

বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট-ব্লাস্ট দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের আইনগতভাবে ক্ষতিপূরণ আদায়ে কাজ করে থাকে। 

এই সংস্থার জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শারমিন আকতার বলেন, “সড়ক দুর্ঘটনার পর শুরুতেই সমঝোতা হওয়ায় অধিকাংশই আদালত পর্যন্ত মামলা গড়ায় না। আদালত পর্যন্ত এলেও দীর্ঘসূত্রতার কারণে বাদীপক্ষ হতাশ হয়ে যান, মুখ ফিরিয়ে নেন। ফলে দুর্ঘটনার মামলা খুব কমই এগোয়।”