রাজধানীর গাবতলীর হাটে ক্রেতা না পেয়ে হতাশ বিক্রেতারা; অনেকে গরু ফিরিয়ে নেওয়ার তোড়জোড়ও শুরু করেছেন।
Published : 28 Jun 2023, 06:00 PM
ঢাকার গাবতলীর পশুর হাটে একদিন আগে যে গরুর দাম ছিল লাখ টাকার উপরে, ঈদের ঠিক আগের দিন সেই গরুর দাম হাঁকা হচ্ছিল ৭৫/৮০ হাজার টাকা। তারপরও ক্রেতা মিলছে না বলে আক্ষেপ ঝরছিল বেপরীদের মধ্যে।
একজন বললেন, “বৃষ্টি আমাগো কপাল পুড়ছে স্যার। যে গরুর দাম ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা চাইছি একদিন আগে, আজকে ৮০ হাজার টাকাও কাস্টমার পাচ্ছি না। দুই একজন যাও আসে, তারপর দাম আরও কমাতে বলে।”
ঢাকার সবচেয়ে বড় পশুর হাট গাবতলীতে বুধবার গরু বিক্রেতাদের অনেককে এমন হতাশা প্রকাশ করতে দেখা গেল।
হাটে প্রচুর গরু থাকলেও দুপুরের পর থেকে বিকাল পর্যন্ত ক্রেতা তেমন দেখা যায়নি।
অবিরামহীন বৃষ্টির কারণে সকাল থেকেই গরুর হাটে বিক্রি কম বলে জানান সিরাজগঞ্জ থেকে আসা শামীম।
তিনি বলেন, “২০টা গরু আনছি, মাত্র ৬টা গরুর বিক্রি করতে পেরেছি। আজকে একটা গরু বিক্রি করলাম কিছুক্ষণ আগে একলাখ ১৫ টাকায়। বাজারে দাম পড়ে গেছে।”
তবে বিকালের পর বৃষ্টি কমে গেলে ক্রেতার সংখ্যাও বাড়তে থাকে কিছুটা। ধানমণ্ডি, মিরপুর, শ্যামলীসহ আশপাশের এলাকার বাসিন্দারাও যেমন আসছেন, তেমনি অন্যান্য স্থান থেকে অনেকে এসেছেন।
মালিবাগ থেকে আসা সদরুল হাসান বলেন, “সব সময় ঈদের আগের দিন গাবতলীর হাট থেকে গরু কিনতাম। এবারও এসেছি। বাজেট এক লাখ টাকার মধ্যেই।”
ক্রেতার কাছে ছোট-মাঝারী গরুর চাহিদা বেশি বলে জানালেন বিক্রেতারা।
সিরাজগঞ্জের মমিন মিয়া বলেন, “ছোট ও মাঝারী সাইজের গরুর ডিমান্ড বেশি। আমি ৭টা গরু এনেছি বড় সাইজের। এখন ক্রেতা পাচ্ছি না। যেই আসে বলে বড় গরু নেব না, মাঝারী সাইজের গরু চাই।”
‘বড় গরুর দাম নেই’
বগুড়ার শেরপুরের বাবু মোট ১৪টা গরু নিয়ে এসেছিলেন, তার মধ্যে মাত্র চারটি বিক্রি করতে পেরেছেন।
তিনি বলেন, “বড় গরুর দাম নাই। ৮ লাখ টাকার গরুর দাম চাইছি, ক্রেতা বলছে ৪ লাখ টাকা। আমি সারা বছর একটা গরুর পেছনে যে খরচ করলাম সেই দামই উঠছে না। তাহলে কি করে বিক্রি করব? এখন ট্রাকে করে নিয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় দেখছি না। পুরো লস।”
তার কাছে বিশাল সাইজের একটি গরু দেখা গেল, যার নাম দেওয়া হয়েছে ‘নবাব’। বাবু বলেন, “নবাবের দাম হাঁকছি ১২/১৩ লাখ। কিন্তু ক্রেতারা দাম বলে ৫/৬ লাখ। গতকাল নবারের দাম বলেছে ৬ লাখ, বিক্রি করিনি। আজকে দাম কমে বলছে ৫ লাখ। কিভাবে বিক্রি করব?”
৫/৬ লাখে কেন বিক্রি করতে চান না- প্রশ্ন করা হলে বাবু বলেন, “নবাবকে আমি চার বছর পালছি, সে গত বছরে যা খাইছে, তার দামই তো উঠছে না। এখন নবাব এমনি এমনিতে মরে গেলেও কিছু করার নেই।”
কুয়াকাটা থেকে ৭টা বড় সাইজের গরু এনে বিপাকে পড়েছেন আবু সাদেক। তিনি বলেন, “স্যার এত দূর থেকে গরু আনছি একটু লাভের আশায়। ৭টার মধ্যে একটা গরুও বিক্রি করতে পারিনি।”
একাধিক বিক্রেতা ক্ষোভের সুরে বলেন, “বড় গরু আর লালন-পালন করা সম্ভব হয়ে উঠবে না। বড় গরু যদি বিক্রি করতে না পারি, তাহলে কীভাবে এসব গরু পালন করব।”
গাবতলীর হাটে উঠেছে মহিষও। মহেশখালী থেকে ৪টা মহিষ এনেছেন সালাহউদ্দিন। ঈদের শেষ দিনে বাজার ‘পড়ে গেছে’ মন্তব্য করে তিনি বলেন, “গতকাল একটা মহিষের দাম চেয়েছিলাম ৪ লাখ টাকা। আজকে হাসিলসহ সেই মহিষ ১ লা্খ ৯৫ হাজার টাকায় বিক্রি করতে হয়েছে। এখনও তিনটা মহিষ পড়ে আছে।”
ছোট ও মাঝারি গরুর চাহিদা বেশি
পাবনা থেকে ১০টি মাঝারী নিয়ে এসেছেন সোলায়মান। তার ছয়টি গরু বিক্রি হয়েছে। ঈদের শেষ দিন বিকালে একটি গরু বিক্রি করতে হয়েছে গতকালের চেয়ে কম দামে।
সোলায়মান বলেন, “বৃষ্টির কারণে আজকে সকাল থেকেই ক্রেতা কম। রাতদিন বসে আছি, সেভাবে ক্রেতা আসে না। আবার আসলেও দামে বনে না। বিকালে দিকে একটা মাঝারী সাইজের গরু ২৪ হাজার টাকা কম দামে বিক্রি করেছি। আমার লস হয়েছে। কিছু করাও নেই।”
মাঝারি গরুর চাহিদা বেশি বলে ক্রেতাদের কাছ থেকে একুট লাভের আশায় কিছু বেশি দাম হাঁকালেও বিক্রেতারা পরে ২৫/৩০ হাজার টাকা কমে ছেড়ে দিচ্ছে।
“আজকে মাঝারী গরু দেড় লাখ টাকা দাম চেয়েছিলাম। শেষ মেষ এক লাখ ১৫ হাজার টাকায় ছেড়ে দিয়েছি,” বলেন পাবনার শফিক।
মিরপুরের মাজার রোডের বাসিন্দা শাহনাজ বেগম নিজে পরিবারের সদস্য নিয়ে গরু কিনতে এসেছিলেন। তাকে একটা মাঝারী সাইজের গরু পছন্দ করে দামাদামি করতে দেখা গেল।
বিক্রেতা ১ লাখ ২০ হাজার টাকা চাইলে তিনি বলেন শাহনাজ বলেন, “এইটুক গরু ১ লাখ ২০! কন কী। হাসিলসহ ৮৫ হাজার দিমু।”
শেষে বিক্রেতাও রাজি হয়ে যান।
গরু ফিরিয়ে নেওয়ার হিড়িক
অনেক বিক্রেতা গাবতলী হাটে এসে গরু বিক্রি করতে না পেরে মাথা হাত দিতে দেখা গেছে। পাবনা, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া থেকে আসার একাধিক বিক্রেতা গরু ফেরত নেওয়ার উদ্যোগও নিচ্ছিলেন।
বিকাল সাড়ে ৪টায় সিরাজগঞ্জের জহির বলেন, ‘‘স্যার কাস্টমার নাই, গরু বিক্রি করতে না পেরে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছি। কী করমু? যে গরু ১ লাখ ৬০ হাজার, সেই গরুর দাম চায় ৯০ হাজার। আমাগো জীবন শেষ।”
মানিকগঞ্জের দেলোয়ার বলেন, “গরুর দাম উঠছিল ১ লাখ ৪০ হাজার । এখন বলে ৮০ হাজার। কেমনে কী করমু। এখন বাড়ি নিয়ে যামু।”
রাতভর বৃষ্টিতে ভিজেও চারটি গরু এবং দুটি খাসি আনা নেত্রকোনার মোফাখখর বলেন, “স্যার ৯টা গরু আনছিলাম, একটাও বিক্রি করতে পারি নাই। গতকাল রাতে একটা হারিয়ে গেছে। এখনো খুঁইজা পাইলাম না। ইজারাদারকে জানাইছি।”
গাবতলী গরুর হাটের ইজারাদারের প্রতিনিধি আবুল হাশেম বলেন, “বড় গরু বিক্রির ক্রেতা একেবারেই কম। গত দুইদিনে ৬০/৭০টা গরু বেপারীরা ফেরত নিয়েছে।
“মাঝারি ও ছোট গরুর মফস্বলের ক্রেতারাও এখন টোকেনের (ছাড়পত্র) জন্য ভিড় করছে। তারা চলে যেতে চায়। তবে আমরা বলেছি, রাত ১২টার পরে স্লিপ দিয়ে দেব।”