সংস্কারে ফিরল রূপ, খুলল লালবাগ কেল্লার হাম্মামখানা

যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়নে আদিরূপ পাওয়া হাম্মামখানা উদ্বোধন হয়েছে।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 22 March 2023, 04:45 PM
Updated : 22 March 2023, 04:45 PM

দৃষ্টিনন্দন কারুকাজে গড়া লালবাগ দুর্গের মুঘল হাম্মামখানা, উপরে গম্বুজাকৃতির জায়গায় বৃত্তাকার ফুটো দিয়ে অন্ধকার ভেতরে ঠিকরে পড়ত দিনের আলো; আর চারদিক দিয়ে ছিল বাতাস ঢোকার ব্যবস্থা।

কিন্তু নানা সময়ে সংস্কারের ধারাবাহিকতায় সেই ফুটো বন্ধ করে ভেতরে লাগান হয়েছিল বৈদ্যুতিক বাতি; আটকে দেওয়া হয়েছিল নির্মল বায়ু ঢোকার সব পথ।

নতুন এক উদ্যোগে এই পুরাকীর্তি সংস্কার করা হয়েছে; ফেরানো হয়েছে মুঘল আমলের সেই ঐতিহাসিক কারুকাজ।

যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়নে আদিরূপ পাওয়া সেই হাম্মামখানা সোমবার উদ্বোধন করেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ ও ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস।

সংস্কারের মাধ্যমে হাম্মামখানায় আনার ‘অপরিকল্পিত’ পরিবর্তনকে আগের জায়গায় নেওয়ার কথা তুলে ধরে অনুষ্ঠানে প্রতিমন্ত্রী বলেন, “হাম্মামখানার নানাবিধ পরিবর্তন করা হয়েছিল, আলাদা একটা সিঁড়ি লাগানো হয়েছিল। একেক দিকে দরোজা আপনমনে নিজের মতো করে তৈরি করা হয়েছিল, হাম্মামখানার উপরের দিকে আলো এবং বাতাস ঢুকবে, সেটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।

“এটিকে একটি অপরিকল্পিতভাবে একটা সংস্কার এক সময় করা হয়েছিল। সেখান থেকে আমরা জায়গাটি এজ ইট ওয়াজ, সেই জায়গাটিতে আমরা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছি।”

অনুষ্ঠানে জানানো হয়, ২০২১ সালের মার্চ মাসে যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাম্বাসেডর’স ফান্ড ফর কালচারাল প্রিজারভেশন (এএফসিপি) কার্যক্রমের আওতায় দুই বছর মেয়াদী পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণের কাজটি শুরু হয়।

১৭ শতকে তৈরি প্রাচীন লালবাগ দুর্গের তিনটি প্রধান কাঠামোর অন্যতম মুঘল হাম্মামখানার পুনরুদ্ধার ও স্থাপত্য কলার নথিবদ্ধকরণের কাজে এএফসিপি তহবিল থেকে প্রায় এক লাখ ৮৬ হাজার মার্কিন ডলার খরচ করা হয়েছে।

পুনরুদ্ধার করা মুঘল হাম্মামখানা উদ্বোধন উপলক্ষে আয়োজিত ‘রেস্টোরিং, রেট্রোফিটিং অ্যান্ড থ্রিডি আর্কিটেকচারাল ডকুমেন্টেশন অফ হিস্টোরিকাল মুঘল এরা হাম্মামখানা অ্যাট লালবাগ ফোর্ট’ শীর্ষক অনুষ্ঠানের সমাপনী অনুষ্ঠানে বক্তৃতায় রাষ্ট্রদূত হাস বলেন, "বিশ্বজুড়ে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের প্রসার, মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে সমর্থন করা এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে সংরক্ষণ করা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অগ্রাধিকার। আগামী প্রজন্মের জন্য আমাদের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে রক্ষা করতে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে।"

গত ২০ বছরে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে ১১টি প্রকল্পে যুক্তরাষ্ট্র সহায়তা দিয়েছে বলে জানান রাষ্ট্রদূত।

বাংলাপিডিয়ার তথ্য বলছে, বাংলার সুবাহদার থাকার সময়ে যুবরাজ মুহম্মদ আজম ১৬৭৮ সালে লালবাগ দুর্গের নির্মাণ কাজ শুরু করেন। কিন্তু কাজ সম্পন্ন হওয়ার আগেই মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব তাকে দিল্লিতে ডেকে পাঠান।

তার উত্তরসূরি শায়েস্তা খান ১৬৮৮ সাল পর্যন্ত ঢাকায় অবস্থান করলেও দুর্গের কাজ সমাপ্ত করেননি। ১৬৮৪ খ্রিস্টাব্দে শায়েস্তা খানের মেয়ে বিবি পরী এখানে মারা গেলে দুর্গটিকে তিনি অপয়া হিসেবে বিবেচনা করে নির্মাণ কাজ বন্ধ করে দেন বলে বাংলাপিডিয়ায় উল্লেখ রয়েছে।

হাম্মাম কমপ্লেক্সটিতে রয়েছে একটি উন্মুক্ত প্লাটফর্ম, একটি ছোট রান্নাঘর, একটি চুল্লী, একটি পানির আধার, ইট নির্মিত পাকা একটি বাথ-টাব, একটি শৌচাগার, একটি ড্রেসিং রুম এবং বাড়তি একটি কক্ষ।

হাম্মাম অংশে পানি গরম করার জন্য ভূগর্ভস্থ একটি কক্ষ এবং ঝাড়ুদারদের ব্যবহারের জন্য একটি অলিন্দ রয়েছে। হাম্মামের পশ্চিম দিকে উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত দীর্ঘ একটি বিভাজন দেওয়াল সমস্ত দুর্গটিকে দুভাগে বিভক্ত করেছে।

হাম্মামখানা সংস্কার প্রকল্পের পরামর্শক অধ্যাপক আবু সাঈদ এম আহমেদ বলেন, মুঘল স্থাপত্যের বিভিন্ন দিক ও ঐতিহাসিক অবস্থা পর্যালোচনা করে হাম্মামখানার পুনরুদ্ধার করা হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে সংস্কারের ফলে পরিবর্তন করে ফেলা অংশকে আগের মতো ফেরানোর চেষ্টা করা হয়েছে।

হাম্মামখানার পুরোপুরি পুনরুদ্ধার এবং লালবাগ দুর্গকে আদিরূপে ফিরিয়ে নিতে আরও অনেক কাজ বাকি রয়েছে বলে জানান তিনি।

এদিকে, সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ বলেন, “আজকে আমরা হাম্মামখানা সংস্কারের পর খুলে দিচ্ছি। আরও দুই লাখ ডলার তহবিল সংগ্রহ করে আমরা বাকিটা সংরক্ষণ ও পুনরুদ্ধার করব।”

প্রত্নতত্ব অধিদপ্তরের মহাপরিচালক চন্দন কুমার দে’র সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে সংস্কৃতি সচিব আবুল মনসুর বক্তব্য দেন।