‘নতুন মহামারী আসবেই’, প্রস্তুতি রাখতে বললেন গিলবার্ট

“মানুষকে দুশ্চিন্তায় ফেলার জন্য দুঃখিত। কিন্তু সব সময়ই আরেকটি মহামারী হতে পারে,” বলেন তিনি।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 Jan 2023, 06:16 PM
Updated : 7 Jan 2023, 06:16 PM

বিশ্বকে বিপদে ফেলে দেওয়া করোনাভাইরাস মহামারী এখনও শেষ না হওয়ার মধ্যেই পরের মহামারী নিয়ে সতর্ক করেছেন অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার সহ আবিষ্কারক সারাহ গিলবার্ট; রাষ্ট্রগুলোকে পরামর্শ দিয়েছেন প্রস্তুতি নিয়ে রাখার।

শনিবার ঢাকা লিট ফেস্টের তৃতীয় দিনে এক অধিবেশনে মহামারীর দুঃসহ সেই সময়ে টিকা আবিষ্কার ও উৎপাদনের পেছনের গল্প শুনিয়ে এ পরামর্শ ও সতর্কবার্তা দেন তিনি।

‘সায়েন্স ভেক্সার্স’ শীর্ষক এ অধিবেশনে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ভ্যাকসিনোলজি বিভাগের এ অধ্যাপকের কাছে অনুষ্ঠানের সঞ্চালক জানতে চান, আরও মহামারী হওয়ার ঝুঁকি কি আছে?

উত্তরে কোনো ধরনের রাখঢাক না রেখেই বিভিন্ন ভাইরাস প্রতিরোধী টিকা আবিষ্কার ও গবেষণায় প্রায় তিন দশকের অভিজ্ঞতা থাকা ব্রিটিশ এ বিজ্ঞানী বলেন, “সম্পূর্ণরূপে এবং এটা সবসময়।”

২০২০ সালের জানুয়ারিতে ব্রিটিশ কোম্পানি অ্যাস্ট্রাজেনেকার সঙ্গে মিলে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় টিকা আবিষ্কারের প্রকল্প নেয়, তাতে খ্যাতনামা এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দিক থেকে প্রকল্প প্রধান নির্বাচিত হন সারাহ গিলবার্ট।

কোভিড মহামারীর কারণে তিন বছর বন্ধ থাকার পর ঢাকা লিট ফেস্টের দশম এ আসরে বক্তৃতা করতে ব্রিটিশ এ বিজ্ঞানী বাংলাদেশে এসেছেন।

আগের দিন এক শুক্রবার আরেক অধিবেশনেও তিনি করোনাভাইরাস মহামারী, টিকা, গবেষণা ও আবিষ্কার নিয়ে কথা বলেন।

শনিবার নতুন মহামারী মোকাবেলায় প্রস্তুতি ও বিনিয়োগের পরামর্শ দিয়ে অধ্যাপক গিলবার্ট বলেন, “মানুষকে দুশ্চিন্তায় ফেলার জন্য দুঃখিত। কিন্তু সব সময়ই আরেকটি মহামারী হতে পারে।

“এবং আমাদেরকে এটা নিশ্চিত করতে হবে যে, যতটা সম্ভব প্রস্তুত হয়ে থাকা। যাতে এটা যখন ঘটবে এবং অবধারিতভাবে ঘটবে, তখন আমরা যেন ভালোমত এটাকে মোকাবিলা করতে পারি। আমরা যদি কোনো ভাইরাস মহামারীর আকার ধারণ করার আগে প্রাদুর্ভাবের মধ্যে বন্ধ করতে পারি, তাহলে বিশ্ব অর্থনীতি অনেক অর্থের ক্ষতি থেকে রক্ষা পাবে। তেমন চেষ্টা করাটাই হবে সত্যিকার অর্থে উপকারী।”

আসন্ন মহামারী মোকাবেলায় কীভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে, সেই পরামর্শ দিয়ে বিজ্ঞানী গিলবার্ট বলেন, “যেসব ভাইরাসের টিকা আছে, সেগুলো পর্যাপ্ত উৎপাদন করে মজুদ রাখতে হবে। এমন পদ্ধতি ঠিক করে রাখা যাতে নতুন ভাইরাস দেখা দিলে সেগুলো পর্যবেক্ষণের এবং দ্রুত সময়ে টিকার ব্যবস্থা করা যায়।

“বিভিন্ন ধরনের ভাইরাসের জন্য টিকা আবিষ্কার করে রাখা। যাতে আমরা সহজে বুঝে নিতে পারি, কোনটাকে কাজে লাগানো যায়। আমরা ২০২০ সালে জানতাম না যে, কী হতে যাচ্ছে এবং আমাদেরকে অধীর আগ্রহে নিয়ে বসে থাকতে হয়েছে ফলাফল কী আসবে তার জন্য।”

২০১৯ সালের একবারে শেষ দিকে চীনে এবং এরপর বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ে। এতে দিনের পর দিন মৃত্যুর সংখ্যা বাড়তে থাকে। তখন মরণঘাতি এ ভাইরাস প্রতিরোধে টিকা আবিষ্কারের মহাযজ্ঞে নামেন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের বিজ্ঞানীরা।

এ টিকা আবিষ্কারের পর বিভিন্ন ধাপের পরীক্ষা-নিরীক্ষা পেরিয়ে ২০২০ সালের নভেম্বরে মানবশরীরে পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা।

ব্রিটিশ সরকারের অনুমোদনের ধারাবাহিকতায় ২০২১ সালের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার প্রয়োগ শুরু হয়। এ টিকার আবিষ্কারক দলে ছিলেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গিলবার্ট।

করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সামগ্রিক কার্যকারিতা বিবেচনায় অন্য টিকা থেকে পিছিয়ে থাকলেও স্বল্প আয়ের দেশগুলোর টিকা প্রাপ্তি সহজ করতে তাদের আবিষ্কার করা টিকাকে সামনের সারিতে রেখেছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

এর পেছনে কারণ হিসেবে তারা বলেছেন, টিকার স্বত্বে ছাড় দেওয়ায় সবচেয়ে কম দামে পাওয়া যায় এ টিকা। অন্যদিকে, অন্যান্য টিকা বিশেষ তাপমাত্রায় রাখার বাধ্যবাধকতা থাকলেও সাধারণ রেফ্রিজারেটরে সংরক্ষণ করতে পারায় এটার পরিবহন ও প্রয়োগের কাজ ছিল খুব সহজ।

‘এই টিকা বিশ্বের জন্য’

অক্সফোর্ডের টিকা কীভাবে মানুষের জন্য, সহজ করা হল সেই গল্প শুনিয়ে সারাহ গিলবার্ট বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে আমরা চ্যারিটেবল প্রতিষ্ঠান। আমরা টিকা থেকে টাকা উপার্জন করতে পারি না। এ কারণে আমরা চেয়েছি এটাকে যতটুকু বিস্তৃত পরিসরে পৌঁছানো যায়।

“আমরা সবসময় বলতে চেয়েছি এটা টিকা বিশ্বের জন্য, এটা শুধু যুক্তরাজ্য কিংবা ইউরোপের জন্য নয়। এটা বিশ্বের জন্য টিকা।”

অ্যাস্ট্রাজেনেকার মত বড় উৎপাদকের সঙ্গে সংযুক্ত করার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “আমরা এই প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করেছি, কারণ এটা বিস্তৃত পরিসরে উৎপাদনের উপযাগী। অতি কম তাপমাত্রায় রাখার বাধ্যবাধকতা না থাকায়, এটার পরিবহনও সহজ।

Also Read: কোভিডের সব ধরনের জন্য এক টিকা? ‘আশাবাদী’ নন গিলবার্ট

Also Read: কোভিড একসময় সাধারণ ঠাণ্ডা-জ্বরে পরিণত হবে: সারাহ গিলবার্ট

“অ্যাস্ট্রাজেনেকা টিকা উৎপাদনে যুক্ত হয়েছে এমন শর্তে যে, তারা মহামারীর মধ্যে এটা থেকে মুনাফা করবে না, যাতে স্বল্প আয়ের দেশের এটা সহজে পাঠানো যায়। তবে মহামারী শেষ হলে উন্নত দেশ থেকে তারা মুনাফা করতে পারবে। তারা মুনাফা না করায় দাম খুব রাখা সম্ভব হয়েছে। আর এটা টিকা প্রাপ্তি খুব সহজ করে তুলেছে।”

তিনি বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে টিকার উৎপাদন ব্যবস্থা তৈরির জন্য ‘ঝুঁকি’ নিয়ে অ্যাস্ট্রাজেনেকা বিপুল অর্থ বিনিয়াগ করেছে।

“কারণ যখন আমরা শুরু করি তখন জানা ছিল না যে পরীক্ষার পরে টিকাটা কার্যকর হবে কি না। যদি ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে ’না সূচক’ ফলাফল আসত, তাহলে আমাদের সব টাকা জলে যেত।”

পরীক্ষার পর্যায়ে কোভিড টিকা কার্যকর হওয়ার পেছনে কতটা আত্মবিশ্বাসী ছিলেন, এমন প্রশ্নে এই বিজ্ঞানী বলেন, মার্স ভাইরাসের টিকার পরীক্ষার কাজ এগিয়ে নেওয়ার কারণে প্রক্রিয়াগত প্রস্তুতি তাদের ছিল। টিকার উৎপাদন ও বিপণনে নতুন করে বিনিয়োগ করা হলেও আগের অভিজ্ঞতা এখানে কাজে লাগতে পারে বলে বিশ্বাস ছিল তাদের।“

টিকা পাওয়া সহজ করার জন্য নিজেদের উদ্যোগের কথা তুলে ধরে সারাহ গিলবার্ট বলেন, ৩ বিলিয়ন ডোজ উৎপাদন হয়েছে ২০২২ সালের শুরুতে এসে। সেরাম ইনস্টিটিউট খুব ভালো কাজ করেছে, তারা এর প্রায় অর্ধেক উৎপাদন করেছিল।

“অ্যাস্ট্রাজেনেকা বিপুল পরিমাণ উৎপাদিত টিকা ব্রাজিলে নেয়। সেখানে সেটা বোতলে ভরে মানুষের কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছিল। পরে তারা টিকা উৎপাদনের পুরো প্রযুক্তির উন্নয়ন করেছে এবং উৎপাদন করে নিজেদের পাশাপাশি লাতিন আমেরিকার অন্যান্য দেশেও পাঠিয়েছে।

ব্যাপক চেষ্টার পরও সবার কাছে দ্রুত সময়ে টিকা পৌঁছাতে না পেরে হতাশার কথা তুলে তিনি বলেন, “অ্যাস্ট্রাজেনেকা বিশ্বের বহু জায়গায় উৎপাদনের ব্যবস্থা করার পরও এত বড় পরিসরে টিকা দেওয়ার জন্য আরও অনেক কাজ করার ছিল। অল্প কয়েক মাসের জন্য বিপুল সংখ্যক টিকা উৎপাদনের জন্য, সঙ্গে কড়া মান বজায় রাখার মাধ্যমে। বড় সংখ্যায় ডোজ পাওয়ার সময়ের প্রয়োজন ছিল।“

প্রত্যেককে দ্রুত টিকা দিতে না পারার বিষয়ে তিনি বলেন, “আমি মনে করি আমরা এ ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি ভবিষ্যতে হব না, কারণ আমরা এখন অনেকটা প্রস্তুত। টিকা তৈরির অবকাঠামো বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে তৈরি হয়েছে। এবার প্রথম হওয়ায় বেশ সময় লেগেছে।”

করোনাভাইরাসের সময় থেকে শিক্ষা নিয়ে সরকারি অনুমোদন ব্যবস্থায় ভবিষ্যতে পরিবর্তন আসবে বলেও মনে করছেন অধ্যাপক গিলবার্ট।

তিনি বলেন, কোনো ক্ষেত্রে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের অনুমোদন পাওয়ার জন্য ১৮ মাসের মত সময় লাগে। কারণ এমন প্রক্রিয়া আছে, যেটার মধ্য দিয়ে যেতে হয়, যদিও সবসময় এটার প্রয়োজনীয়তা নাই।

“২০২০ সালে আমরা সেটার সময় কমিয়ে আনতে পেরেছি। রেগুলেটর ও ইথিকস কমিটির অনুমোদনের সময় কমিয়ে আমরা সেটি কমিয়ে আনতে পেরেছি।”

‘এক টিকা আরেক টিকার প্রতিযোগী নয়’

নিজেদের টিকা আবিষ্কারের গল্প ‘ভ্যাক্সার্স: এ পাইওনিয়ারিং মোমেন্ট ইন সায়েন্স হিস্ট্রি’ বই লিখেছেন সারাহ গিলবার্ট ও আবিষ্কার দলের আরেক সদস্য ক্যাথেরিন গ্রিন।

সেখানে তারা লিখেছেন, অন্য কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠান কি টিকা আবিষ্কার করছে বা কতোটা দ্রুততার সঙ্গে কতোটা কার্যকর টিকা আবিষ্কার করছে সেই প্রতিযোগিতায় তারা ছিলেন না। বরং নিজেদের টিকাকে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে কতোটা দ্রুত মানুষের কাছে নিয়ে যাওয়ার প্রতিযোগিতায় ছিলেন তারা।

অন্য টিকার সঙ্গে অক্সফোর্ডের টিকার তুলনা করে অনুষ্ঠানে এক প্রশ্নেও একই ধরনের বক্তব্য দেন গিলবার্ট।

তিনি বলেন, “দীর্ঘ সময়ের বিবেচনায় কোন টিকা কার্যকর তা বলা কঠিন, কারণ অনেক ধরনকে মোকাবেলা করতে হচ্ছে আমাদের। আমরা সবসময় মানুষকে বলে আসছি, এটা ভিন্ন ভিন্ন ধরনের টিকা উৎপাদকদের মধ্যকার প্রতিযোগিতা নয়, কারণ বিশ্বের মানুষকে দেওয়ার জন্য অনেক ধরনের আর অনেক পরিমাণের টিকা দরকার। এটা এমন ব্যাপার নয় যে, কে জিতল?”

সারাহ গিলবার্ট আরও বলেন, “ওষুধ শিল্পে এমনভাবে চলে যে একজন সব কিছু অর্জন করবে না। আমাদের অনেক ধরনের টিকা তৈরি করা প্রয়োজন এবং সবাই যদি একই প্রযুক্তির টিকা উৎপাদন করে, তা ভালো হবে না।

“কারণ আমাদের সরবরাহ ব্যবস্থায় সংকট রয়েছে, আমাদের সংকট রয়েছে কাঁচামালের। সবাই যদি একই ধরনের টিকা তৈরি করে তাহলে আমরা এত বেশি কাঁচামাল একসঙ্গে পাব না। আমি মনে করি, কোন টিকা ব্যবহারের সব মানদণ্ড রক্ষা করে সেটা ভাবা উচিত এবং সেটার ভিত্তিতে নির্ধারণ হবে কোন কোন টিকা ব্যবহার করা হবে।”

অক্সফোর্ডের টিকা ব্যবহারের ফলে কিছু ক্ষেত্রে রক্ত জমাট বাঁধার ঘটনা প্রসঙ্গে এক প্রশ্নে তিনি বলেন, “এটা খুবই বিরল বিষয়। তবে কোনো কিছুই ঝুঁকিমুক্ত নয়। এটুকু বলতে পারি, টিকা নেওয়ার চেয়ে টিকা না নেওয়া বেশি ঝুঁকির।”

বাংলাদেশে কোভিডের অভিঘাত সেভাবে না পড়ার পেছনে তরুণ জনগোষ্ঠী বেশি হওয়াকে একটি যুক্তি হিসেবে তুলে ধরে ব্রিটিশ এ বিজ্ঞানী বলেন, “তরুণদের ক্ষেত্রে উপসর্গ সেভাবে প্রকাশিত হয় না। অনেক সময় মৃদু উপসর্গ হয়ে তা সেরে যায়।

“তবে, মৃত্যুর হার কম হলেও কোনো আক্রান্তের সংখ্যা বেশি হলে হাসপাতালে ব্যাপক চাপ পড়বে। তখন সেটা থেকে মোকাবলো কষ্টকর হয়ে যায়।”