Published : 10 Dec 2022, 03:18 PM
বিএনপির সমাবেশের ঘিরে ‘উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে’ ঢাকার সড়কগুলোতে কার্যত নীরবতা নেমেছে; প্রতিদিনের মতো গণপরিবহন চলাচল ও চিরচেনা যানজট নেই, কর্মস্থল বা গন্তব্যে ছুটে চলা মানুষও কম।
রাস্তায় দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করে বাস না পেয়ে রিকশা, মোটরসাইকেল কিংবা অটোরিকশাতেই বেশি ভাড়া দিয়ে ছুটছেন যাত্রীরা। আর সড়কে টহল ও যাত্রীদের থামিয়ে তল্লাশি চলছে পুলিশের।
শনিবার ঢাকার গোলাপবাগে সমাবেশ চলছে বিএনপির। এই সমাবেশের দুদিন আগে বৃহস্পতিবার থেকে ঢাকার সঙ্গে দূরপাল্লার বাস চলাচল কমে যায়। আর শুক্রবার ও শনিবার দূর পাল্লার বাস চলাচল কার্যত বন্ধ হয়ে যায়।
পরিবহন মালিকরা বলছেন, শুক্রবার সন্ধ্যায় ঢাকার মিরপুরে একটি বাস পুড়িয়ে দেওয়ায় মালিকরা আতঙ্কে আছেন। শনিবারের পরিস্থিতি বিবেচনা করে মানুষও কিছুটা আতঙ্কে থাকায় রাস্তায় নামেনি, যাত্রী না থাকায় বাসও চলছে না।
জাতীয় নির্বাচনের এক বছর হাতে থাকতে রাজনৈতিক তৎপরতা বাড়িয়েছে বিএনপি। গত অক্টোবরে চট্টগ্রামে জনসভা দিয়ে শুরু হয়েছিল দলটির বিভাগীয় সমাবেশের কর্মসূচি। চট্টগ্রামের পর খুলনা, বরিশাল, ফরিদপুর, ময়মনসিংহ, রংপুর, সিলেট, কুমিল্লা ও রাজশাহীতেও সভা হয়। কিন্তু কুমিল্লা ও ময়মনসিংহ বাদে সব সমাবেশের আগে সেই সেই অঞ্চলে পরিবহন ধর্মঘট ডাকা হয়েছিল। ময়মনসিংহে ধর্মঘটের ঘোষণা না থাকলেও যানবাহন চলাচল বন্ধই ছিল।
অন্যদিকে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সংবাদমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি জানিয়েছিল, ১০ ডিসেম্বর সব রুটে বাস চলাচল স্বাভাবিক রাখবে পরিবহন মালিকরা। তবে ঢাকার সড়কে দেখা গেছে এর উল্টো চিত্র।
সকালে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কাঁচপুর থেকে যাত্রাবাড়ী হয়ে গুলিস্তান পর্যন্ত পথে দূরপাল্লার কোনো বাস শহরে ঢুকতে দেখা যায়নি। মাঝেমধ্যে দুয়েকটি বাস ঢাকা ছেড়ে যেতে দেখা গেছে, একই অবস্থা ছিল নগর পরিবহনের বাসেও।
সাইনবোর্ড এলাকায় সড়কের পাশে দাঁড় করিয়ে রাখা ঢাকা-কুমিল্লা রুটের তিশা পরিবহনের একটি বাসের চালকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ওই বাসটির মালিক ঢাকার। এজন্য সকালে কুমিল্লা থেকে বাসটি ছেড়ে এসেছে। তবে পথে তিন জায়গায় তল্লাশি হয়েছে, কয়েকজন যাত্রীকে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। গাড়ি নিয়ে আসতে চেকপোস্টে পুলিশকে দিতে হয়েছে দুই হাজার টাকা।
নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক ওই চালক বলেন, “ঘোষণা দিছিল গাড়ি চলবে। এজন্য শুক্রবার কুমিল্লা গেছিলাম। কিন্তু আসার সময় পথে পথে ঝামেলা। ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট, ভবেরচরের চেকপোস্ট পার হইতে পারলেও সাইনবোর্ড থেকে আর যাইতে দেয় নাই। কয়জন যাত্রী আছিল তারা নাইমা গেছে।”
নগর পরিবহনের বাস না থাকায় অনেককে হেঁটে, কাউকে রিকশায় করে ঢাকার দিকে আসতে দেখা গেছে।
চিটাগাংরোড এলাকায় বাসের অপেক্ষায় থাকা দাউদকান্দির ব্যবসায়ী মেহরাব হোসেন বলেন, ব্যবসার একটি জরুরি কাজে তেজগাঁও লিঙ্ক রোড যাবেন তিনি। দাউদকান্দি থেকে অটোরিকশায় এই পর্যন্ত এসেছেন।
“এখন আর গাড়ি পাচ্ছি না। তেজগাঁও যাওয়া খুবই দরকার।”
নোয়াখালীর আবদুল হাইয়ের গন্তব্য সাভারে, তবে বাস না পেয়ে হেঁটেই রওনা হন তিনি।
“ধর্মঘট নাই জানি, কিন্তু রাস্তায় আইসা দেখি গাড়ি নাই। ভেঙে ভেঙে এ পর্যন্ত আসতে পারছি, এখন বাস না পাইয়া হেঁটেই যাচ্ছি, দেখি সামনে গিয়ে গাড়ি পাই কিনা।”
সাইনবোর্ডে বিভিন্ন পরিবহনের কাউন্টারের বেশিরভাগ বন্ধ দেখা যায়। শ্যামলী এনআর পরিবহনের কাউন্টারের টিকেট বিক্রেতা আজিজুর রহমান জানান, ঢাকা থেকে কোনো গাড়ি ছেড়ে আসছে না।
“দুয়েকটা গাড়ি আসতেছে, যাদের জরুরি প্রয়োজন তারা এই বাসে যেতে পারছেন, তবে ভাড়া বেশি।”
মহাখালী আন্তঃজেলা বাস টার্মিনাল থেকে কোনো বাস ছেড়ে যায়নি। টার্মিনালের সামনে কিছু যাত্রী বাসের অপেক্ষায় ছিলেন। সেখানে আনিসুর রহমান নামে এক ব্যবসায়ী জানান, তার গন্তব্য গাজীপুর চৌরাস্তা।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “টেলিভিশনের খবরে দেখলাম বাস চলাচল স্বাভাবিক থাকবে। এজন্য বাসা থেকে এসেছিলাম। কিন্তু এখন দেখি কোনো গাড়ি যাচ্ছে না।”
সৌখিন পরিবহনের একটি বাসের হেল্পার সাদেক হোসেন বলেন, শুক্রবার বিকালের গাড়ি টার্মিনালে এসেছে। এখন পর্যন্ত ছেড়ে যাওয়ার কোনো নির্দেশনা আসেনি।
“এখনও জানি না গাড়ি ছাড়মু কিনা, শুনছি মিটিংয়ের পর বিকালে গাড়ি ছাড়া যাইব।”
এদিকে বাস না চলার বিষয়ে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্লাহ বলেন, “মালিকরা চাইলেও যাত্রী না থাকায় গাড়ি চলছে না।”
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “আমরা গাড়ি চালাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু শুক্রবার সন্ধ্যায় মিরপুরে একটি গাড়িতে আগুন দেওয়া হয়েছে। এজন্য মালিকরা গাড়ি বের করছেন না। আর যাত্রীও নেই। আতঙ্কে মানুষ বাসা থেকে বের হচ্ছে না।”
দূর পাল্লার বাসের পাশাপাশি ঢাকা নগরীর ভেতরেও শনিবার সকাল থেকে বাস চলাচল কার্যত দেখা যায়নি। রাজধানীর মোহাম্মদপুর, শিয়া মসজিদ, বিজয় সরণি, ধানমন্ডি ৩২, পাস্থপথ, কাওরানবাজার, বাংলামোটর ঘুরে দেখা গেছে- প্রাইভেট কারের সংখ্যাও নেহাত কম। লোকজনেরও তেমন ভিড় নেই, ফাঁকা রাস্তায় দাঁপিয়ে বেড়াচ্ছে মোটর সাইকেল রিকশা কিংবা অটোরিকশা।
মোহাম্মদপুর শিয়া মসজিদ থেকে সকাল ১০টায় মহাখালীতে অফিসে যাওয়ার জন্য গাড়ির অপেক্ষায় ছিলেন ইশতিয়াক আহমেদ। তিনি জানান, সাধারণত বাসেই আসা-যাওয়া করেন। কিন্তু শনিবার বাধ্য হয়ে বেশি টাকা খরচ করে রাইড শেয়ারিং বাইকে করে অফিসে যাচ্ছেন।
ভোরে রিকশা নিয়ে বের হয়েছিলেন সাকিব মিয়া। ধানমন্ডি ৩২ নম্বর এলাকায় কথা হলে তিনি বলেন, “ভোরে বেড়িয়ে সকাল ৮টা পর্যন্ত কোনো যাত্রী পাইনি। রাস্তায় তো মানুষই নাই।”
মিরপুরের কাজীপাড়া এলাকা থেকে মোটর সাইকেলে বনশ্রী যাচ্ছিলেন আল মামুন। তার ভাষ্য, “সড়কে বাস একটাও নেই। বাইক নিলাম। ভাড়ার বাইকে অনেক বেশি চাইছে। তবে দামাদামি করে ৩০০ টাকায় ঠিক করলাম।”
মোটর সাইকেল চালক মো. রায়হান বলেন, “আজকে যে পরিমাণ ভাড়া পেলাম, আর যে শান্তিতে চালিয়েছি এমন এর আগে কখন হয়নি। যাত্রী আছে অনেক রাস্তায়, আবার রাস্তাও ফাঁকা, তাই বেশ সুবিধাই হলো। এটা ঈদের সময়ের মতো।”
মহাখালী থেকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় হয়ে বিজয় সরণি পর্যন্ত রাস্তার একপাশ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। একদিক দিয়ে চলছে দুই দিকের যানবাহন। বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে মহাখালী ফ্লাইওভারের বনানী থেকে জাহাঙ্গীর গেইটমুখী সড়ক।
উত্তরা হাউজ বিল্ডিং এলাকার বাসিন্দা ফাহমিদা জারিন বলছেন, “মিরপুরে একটা কাজে যাওয়ার জন্য বের হয়েছিলেন। কিন্তু রাস্তায় কোনো বাস নেই। এর মধ্যে দুটো চেকপোস্টে পুলিশ তল্লাশি করেছে; বুঝিয়ে বলেছে যে, এই দিনে রাস্তায় থাকা ঠিক নয়।”
রাজধানীর সড়কে বাস বন্ধের পাশাপাশি বুড়িগঙ্গা ও তুরাগ নদীতে নৌযান চলাচল বন্ধ রয়েছে। গাবতলীর ব্যবসায়ী মো. শামীম বলেন, তিনি নিয়মিত নৌকায় করে গাবতলী থেকে সদরঘাট, হাজারীবাগ এলাকায় যাতায়াত করেন। তবে শনিবার সকালে ঘাটে গিয়ে কোনো নৌকা পাননি।
জানতে চাইলে আমিনবাজার নৌ থানার ওসি আব্দুল্লাহ আল মামুন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নৌকা চলছে, তবে খুবই কম। যাত্রী নেই সেই কারণে হয়তো মাঝিরা নৌযান চলাচল বন্ধ রেখেছেন।”
সড়রঘাট এলাকায় নদী পারপারের খেয়া নৌকাগুলোও বন্ধ। তবে সদরঘাট নৌ থানার ওসি শফিকুর রহমান বলেন, বিকালে বেশ কিছু নৌকা চলাচল করেছে।
শনিবার বিএনপির ঢাকা বিভাগীয় সমাবেশ নিয়ে কয়েকদিন ধরে উত্তেজনা চলছে দেশে। এর মধ্যে গত বুধবার নয়া পল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে পুলিশের সঙ্গে বিএনপির নেতাদের সংঘর্ষ হয়। আটক করা হয় বিএনপির কয়েকশ নেতাকর্মীকে।
সমাবেশ ঘিরে সংঘর্ষের পর থেকেই ঢাকায় নজরদারি বাড়িয়েছে পুলিশ। ঢাকার প্রবেশপথ ও যাত্রীবাহী বাসসহ অন্যান্য গণপরিবহনে তল্লাশি চালাচ্ছে পুলিশ। অনেক স্থানে রাস্তার একপাশ বন্ধ করে করে দিয়ে অপর পাশ ধরেই উভমুখী যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করছে পুলিশ।
সড়কে মানুষের ভিড় না থাকলেও পুলিশ, র্যাব ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা টহল দিচ্ছেন। সড়কে বা ফুটপাতে কোথাও জমায়েত হতে দেওয়া হচ্ছে না। ফুটপাতের অনেক চায়ের দোকানও বন্ধ। দু-একটা দোকান খোলা রাখলেও পুলিশ আসলেই বন্ধ করা হচ্ছে। সেসব দোকানেও মানুষের জটলা নেই।